রবিবার, ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

ধ্বংস হয়ে যাওয়া যত শহর

আবদুল কাদের

ধ্বংস হয়ে যাওয়া যত শহর

ডগারল্যান্ড [গ্রেট ব্রিটেন]

সময়কাল : ৬২২৫-৬১৭০ খ্রিস্টপূর্ব

খুব কম মানুষই জানেন, উত্তর সাগরের সৈকতের তীরে বিশাল একটি হারিয়ে যাওয়া শহর রয়েছে। যেখানে আদি হোমিনিডরা উত্তর ইউরোপে প্রথম পায়ের ছাপ রেখেছিল। সময়টা তখন প্রায় ৬২২৫-৬১৭০ খ্রিস্টপূর্বেরও অনেক আগের। ডগারল্যান্ড এক সময় প্রাচীন গ্রেট ব্রিটেনের একটি উপদ্বীপ হিসেবে পরিচিত ছিল। এখন ভূখন্ডটি ‘ডগার লিটোরাল’ নামেই পরিচিত। ন্যাশনাল জিওগ্রাফির তথ্যমতে, ৬৫০০ খ্রিস্টপূর্বে ডগারল্যান্ড ভূখন্ডটি ছিল ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জ তথা তৎকালীন গ্রেট ব্রিটেনের পূর্বের একটি উপদ্বীপ। এই ভূখন্ডটি গ্রেট ব্রিটেনকে ইউরোপ মহাদেশের সঙ্গে সংযুক্ত করেছিল। ভূতাত্ত্বিক বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্তমানে এটি গ্রেট ব্রিটেনের পূর্ব উপকূল থেকে নেদারল্যান্ডস, জার্মানির পশ্চিম উপকূল, জুটল্যান্ডের ডেনিশ উপদ্বীপ পর্যন্ত বিস্তৃত। দুর্ভাগ্য, আজকের দিনে শহরটি দক্ষিণ-উত্তর সাগরের নিচে নিমজ্জিত। ন্যাশনাল জিওগ্রাফির তথ্যসূত্র, বরফ যুগের শেষে হিমবাহ গলে গ্রেট ব্রিটেনের উপদ্বীপ ডগারল্যান্ড পানির নিচে হারিয়ে যায়।  সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে- মধ্য প্রস্তর যুগের (মেসোলিথক) শিকারিদের বেশ কয়েকটি গ্রাম পানির নিচে তলিয়ে যায়। পরিস্থিতি আরও জটিল করে- স্টোরগা স্লাইডের বিশাল সুনামি এবং নরওয়ের উপকূলের ভূমিধস। ফলে ডগারল্যান্ডের আরও বেশি উপকূল সমুদ্রের পানির নিচে প্লাবিত হয়ে যায়।

 

আইতাপে [পাপুয়া নিউগিনি]

সময়কাল : ৪০০০ খ্রিস্টপূর্ব

পাপুয়া নিউগিনির সান্দাউন প্রদেশের উত্তর উপকূলের ছোট্ট একটি শহর- নাম আইতাপে। এক সময় এখানে ১৮ হাজার মানুষের বসবাস ছিল। এটি ছিল উপকূলীয় বসতি যা প্রাদেশিক রাজধানী ওয়েওয়াক এবং ভ্যানিমো থেকে প্রায় সমান দূরত্বে অবস্থিত। রাজধানী দুটির মধ্যবর্তী মহাসড়কের মধ্যের প্রাচীন শহর আইতাপে ১৯২৯ সালের ঘটনা। ভূতাত্ত্বিকগণ আইতাপে শহরের কাছাকাছি একটি অঞ্চলে আবিষ্কার করেন বেশ কয়েকটি প্রাচীন মানব খুলি। বিজ্ঞানীরা দাবি করেন, এগুলো আধুনিক মানুষের পূর্বপুরুষ হোমো ইরেক্টাস প্রজাতিদের। যদিও দাবির পক্ষে কোনো দলিল দেখাতে পারেননি তারা। তবে ধারণা করা হচ্ছে, আবিষ্কৃৃত মাথার খুলিগুলো খিস্ট্রপূর্ব প্রায় ৪ হাজার থেকে ৬ হাজার অব্দকালীন। গবেষকদের ধারণা, আবিষ্কৃত প্রাচীনতম মানব দেহাবশেষগুলো পৃথিবীর প্রাচীনতম আদিবাসীদের। বিজ্ঞানীরা বলেন, এলাকাটি এক সময় একটি উপকূলীয় উপহ্রদ ছিল। যা প্রায় ৬ হাজার বছর আগে এক ভয়ানক সুনামির আঘাতে বিধ্বস্ত হয়েছিল। ফলে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল সেখানকার জনপদ। বিজ্ঞানীরা ওই এলাকায় প্রাচীনতম ধ্বংসাত্মক আঘাতের চিহ্ন খুঁজে পেয়েছেন। গবেষক অধ্যাপক গফ বলেন, ওই অঞ্চলের ভূগর্ভের ‘ভৌগোলিক মিল’ দেখাচ্ছে যে, সেখানকার মানুষ হাজার হাজার বছর ধরে সুনামির আঘাতে হারিয়ে গিয়েছিল।

 

হামরেস্যান্ডেন [নরওয়ে]

সময়কাল : ৪০০০-৩৬০০ খ্রিস্টপূর্ব

২০১০ সালে নরওয়ের প্রত্নতাত্ত্বিকরা উত্তর সাগরের কাছে গ্রাম হামরেস্যান্ডনের সমুদ্রকূল ঘেঁষে প্রাচীন এক নগরী আবিষ্কার করেন। ধারণা করা হচ্ছে, আবিষ্কৃত অঞ্চলটি আদি প্রস্তর যুগের। বিজ্ঞানীদের মতে, প্রায় ৫ হাজার বছরেরও বেশি আগে অর্থাৎ ৪০০০-৩৬০০ খ্রিস্টপূর্বে বালি ঝড়ের কবলে অঞ্চলটি সমাহিত হয়ে থাকতে পারে। ভূতাত্ত্বিকগণ একে ‘মিনি পম্পে’ নামে আখ্যায়িত করেন। এটি দক্ষিণ নরওয়ের কেজেভিকের ক্রিস্টিয়ানস্যান্ডের বিমানবন্দর থেকে খুব দূরে নয়। বিজ্ঞানীদের ভাষ্যমতে, বসতিটি প্রায় তিন ফুট বালির নিচে চাপা পড়ে ৫ হাজার ৫০০ বছর ধরে হামরেস্যান্ডনের সঙ্গে অবিচ্ছিন্ন রয়েছে। বলা হচ্ছে, আবিষ্কৃত অঞ্চলটি হামরেস্যান্ডেন হ্যানেসের গ্রোভিখিয়া থেকে ভে পর্যন্ত বিস্তৃত। ডিসকভার ম্যাগাজিন জানায়, সমুদ্র উপকূল থেকে প্রায় ৮০ মিটার (২৬২ ফুট) দূরত্বে খনন করে প্রাচীন জনপদটির সন্ধান পাওয়া যায়। অসলো বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক ইতিহাসের গবেষক দল প্রথমে একে একটি প্রাচীরযুক্ত অবকাঠামো বলে মনে করলেও পরবর্তীতে তাদের ধারণা পাল্টে যায়। গবেষক দলের প্রধান লার্স সান্ডস্ট্রোম বলেন, প্রাথমিকভাবে এটি স্ক্যান্ডিনেভিয়ান প্রস্তর যুগের মনে করেছিলাম। কারণ, এটি ছিল অত্যন্ত খারাপভাবে সংরক্ষিত। পরবর্তীতে আবিষ্কার করি, এটি পুরু বালির নিচে চাপা পড়ে আছে।

 

হামিন মাংহা [চীন]

সময়কাল : ৩০০০ খ্রিস্টপূর্ব

প্রাচীন পৃথিবী মানুষের কাছে বরাবরই ছিল রহস্যময়। উত্তর-পূর্ব চীনের ‘হামিন মাংহা’ নামক প্রাচীনতম গ্রামটি তেমনি এক রহস্যেঘেরা গ্রাম। এটি চীনের সবচেয়ে বড় এবং সেরা-সংরক্ষিত প্রাচীনতম গ্রামগুলোর একটি। ২০১৫ সালে এই গ্রামকে ঘিরে নানা রহস্যের দানা বাঁধে। চীনের প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষক দল গ্রামটিতে অনেক কুঁড়েঘরে অসংখ্য মানবদেহের দেহাবশেষের সন্ধান পান। অদ্ভূত ব্যাপার হলো- দেহাবশেষগুলো ছিল সম্পূর্ণ পোড়া কঙ্কাল। বিজ্ঞানীদের দাবি, এই পোড়া কঙ্কালগুলো প্রায় ৫ হাজার বছর আগের। ডিসকভারি চ্যানেলে বলা হয়েছে, প্রত্নতাত্ত্বিকরা জানান, আবিষ্কৃত গ্রামটির প্রাচীন নাম ‘হামিন মাংঘা’। যা খ্রিস্টপূর্ব ৩ হাজার বছর আগের। সেখানকার বাসিন্দারা সে সময় অপেক্ষাকৃত ছোট বসতিতে বাস করত, যা ছিল মাত্র ১৪/১৫ ফুট আকৃতির। তারা ফসল ফলাতে এবং খাবারের জন্য শিকার করত। ধ্বংসাবশেষে পাওয়া তীর-বর্শা তারই প্রমাণ। প্রাচীন গ্রামটির একটি ঘর ৯৭টি পোড়া কঙ্কালে পরিপূর্ণ ছিল। যার সবগুলোই ছিল কিশোর, মধ্য বয়স্ক ও বয়স্কদের। বিজ্ঞানীরা বলেন, পুড়িয়ে ফেলার আগে তাদের একত্রে বস্তাবন্দি করা হয়েছিল। বিজ্ঞানীরা বলেন, সম্ভবত এক ধরনের মহামারি গ্রাস করেছিল গ্রামবাসীদের। তাই তারা আক্রান্তদের কবর দেওয়ার চেয়ে পুড়িয়ে মারাকে ভালো মনে করে।

 

হরপ্পা সভ্যতা [পাকিস্তান]

সময়কাল : ২২০০-২০০০ খ্রিস্টপূর্ব

খ্রিস্টপূর্ব ৫ হাজার বছর বা তারও আগে থেকে প্রাচীন সভ্যতা গড়ে উঠেছিল; যা সিন্ধু সভ্যতা নামে পরিচিত। হরপ্পা সভ্যতা এই সিন্ধু সভ্যতার অংশ। হরপ্পা হলো বর্তমান পাকিস্তানের সাহিবাল (জেলা শহর) থেকে ৩৫ কিলোমিটার পশ্চিমে নদীর পুরনো খাদের কাছে অবস্থিত একটি স্থান। এখন এটি একটি ছোট পাকিস্তানি শহর। ২২০০-২০০০ খ্রিস্টপূর্বে হরপ্পা সভ্যতার দুটি উন্নত শহর ছিল। শহর দুটির নাম মহেঞ্জোদারো এবং হরপ্পা। এই সভ্যতার অনুসন্ধানের সূত্রপাত ঘটে খ্রিস্টীয় ১৮ শতকের প্রথম দিকে। তারপর দীর্ঘ সময় ধরে ধারাবাহিক অনুসন্ধানের ফলে এই সভ্যতা সম্পর্কে বিস্ময়কর দিকগুলো উন্মোচিত হয়। ১৯২১ সালে ব্রিটিশদের তত্ত্বাবধানে মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পায় খনন শুরু হয়। প্রথমে স্থানটিকে বৌদ্ধ বিহারের ধ্বংসস্তূপ বলে মনে করা হয়। তবে কালক্রমে বেরিয়ে আসে হরপ্পা সভ্যতার অসংখ্য নিদর্শন। যা থেকে ধীরে ধীরে উন্মোচিত হতে থাকে হরপ্পা সভ্যতা। হরপ্পা সভ্যতার নগর পরিকল্পনা আর পানির ব্যবস্থা ছিল অনেক উন্নত। প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষকদের মতে, প্রাচীন ওই নগরীতে প্রায় ৫০ লাখ লোকের বসবাস ছিল। তবে দুর্ভাগ্যবশত দীর্ঘ ২০০ বছরের খরা বিশাল এই জনপদ এবং সভ্যতাকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে গেছে। ফলে অঞ্চলটিতে দেখা দেয় অর্থনৈতিক সংকট ও দুর্ভিক্ষ। তাতে বিলীন হয়ে যায় হরপ্পা নগরী।

 

আক্রোতিরি [গ্রিস]

সময়কাল : ১৬২০ খ্রিস্টপূর্ব

গ্রিসের প্রাচীনতম দ্বীপপুঞ্জ ‘থেরা’। বর্তমানে এটি সান্তোরিনি নামেই ব্যাপক পরিচিত। এর অন্যতম আকর্ষণ প্রাচীন আক্রোতিরি। এটি গ্রিসের অন্যতম উল্লেখযোগ্য প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান। সান্তোরিনির দক্ষিণে অবস্থিত প্রাচীন বসতি আক্রোতিরি। পাশেই বিখ্যাত সান্তোরিনি ‘রেড বিচ’। প্রাচীন এই প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানকে ঘিরে রয়েছে নানা রহস্য। আকস্মিক আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতে মিলিয়ে যাওয়া আক্রোতিরি ছিল উন্নত এবং সমৃদ্ধ মানুষের প্রাচীন বসতি। এক গবেষণায় বিজ্ঞানীরা আক্রোতিরি সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারছেন। এক সময় আক্রোতিরিতে ব্রোঞ্জ যুগের মতো উন্নত ছিল। ১৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের কাছাকাছি সময়ে আগ্নেয়গিরি ছাইয়ে পরিণত করে সম্পূর্ণ আক্রোতিরিকে। গবেষকদের ভাষ্য, খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দের মাঝামাঝি সময় থেরান অগ্ন্যুৎপাতের ফলে আক্রোতিরি সমাহিত হয়েছিল। ধারণা করা হয়- ওই আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরক সূচক ছিল ৬-৭ (ভিসুভিয়াসের চেয়ে বড়)। অগ্ন্যুৎপাতের রেটিং প্রমাণ হলেও এর সঠিক বছর জানা যায়নি। তবে মিসরীয় নিউ কিংডমের রেকর্ড বলছে, ১৫৬০, ১৫৪৬ এবং ১৫৪৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত একে সম্পূর্ণরূপে কবর দিয়ে থাকতে পারে। এরপর দ্বীপটির কেন্দ্রস্থলে তৈরি হয় উপসাগর। স্থানটির খননকালে গবেষকরা প্রাচীনতম ভবন, অসংখ্য শিল্প, মৃৎশিল্প এবং দেওয়াল চিত্র খুঁজে পান।

 

লারনাকা [সাইপ্রাস]

সময়কাল : ১২০০ খ্রিস্টপূর্ব

সাইপ্রাসের দক্ষিণ উপকূলের এক নগরী লারনাকা। যার পতন হয়েছিল ব্রোঞ্জ যুগের শেষ অংশে।  এটি সাইপ্রাসের অন্যতম প্রাচীন নগরী। ইতিহাসবিদদের মতে, প্রায় ১২৫০-১১৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ সময়কালে লারনাকা নগরীতে অসংখ্য মানুষের বসবাস ছিল। এখনো প্রাচীনতম নগরীটি একই নামে ব্যাপক পরিচিত। নিকোসিয়া এবং লিমাসলের পরে এটি দেশটির তৃতীয় বৃহত্তম নগরী। ইতিহাসবিদদের মতে, এ অঞ্চলে অনেক লারনাক্স (কফিন) পাওয়া যেত বলেই সম্ভবত এর নামও রাখা হয়েছিল লারনাকা। সে যাই হোক- এক সময়ের প্রাচীন জনপদটি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে হারাতে থাকে তার জৌলুস। সে সময় অসংখ্য ভূমধ্যসাগরীয় সভ্যতা নানা কারণে ধ্বংস হয়েছিল। সাইপ্রাসের ব্যস্ততম নগরীটি দীর্ঘ ৩০০ বছরের খরার কারণে ধীরে ধীরে পতনের দিকে যেতে শুরু করে। প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষকদের তথ্যানুসারে, ব্রোঞ্জ যুগের শেষ অংশে শহরে বসবাসকারী মানুষের মাঝে পানির জন্য হাহাকার শুরু হয়ে যায়। দেখা দেয় প্রাকৃতিক বিপর্যয়। দীর্ঘ সময় বৃষ্টিপাতের অভাবে দেশটিতে ফসল উৎপাদন কমে আসে। সম্ভবত এরপর দেখা দেয় ব্যাপক আকারে দুর্ভিক্ষ। তারপর প্রাচীন নগরীতে সামাজিক ও রাজনৈতিক উত্থানের ফলে ব্যাপক মৃত্যু হয়। শেষ পর্যন্ত প্রাচীন জনপদের অসংখ্য মানুষ দেশত্যাগে করে অন্যত্র সরে যেতে বাধ্য হয়।

 

হিট্টাইটস [তুরস্ক]

সময়কাল : ব্রোঞ্জ যুগ

ব্রোঞ্জ যুগে আরেক সাম্রাজ্য ও জনপদ পৃথিবী থেকে হারিয়ে যায়। যারা প্রাচীন হিট্টাইটস নামে পরিচিত। তারা ছিল প্রাচীন আনাতোলিয়ান (আধুনিক তুরস্কের মানুষ)। তারা প্রথমে ১৭৫০ খ্রিস্টপূর্বের আগে কুসারা এবং ১৭৫০-১৬৫০ খ্রিস্টপূর্বে কানেশ রাজ্য গঠন করে। এরপর তারা ১৬০০-১১৮০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে একটি সাম্রাজ্য গঠন করেছিল। অ্যাসিরীয়, ব্যাবিলনীয়, মিসর এবং মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন ইতিহাস গ্রন্থে হিট্টাইট সভ্যতার কথা উল্লেখ দেখা যায়। ইন্দো-ইউরোপীয় গবেষণার ইতিহাসেও হিট্টাইটস সাম্রাজ্য সম্পর্কে উল্লেখ রয়েছে। ইতিহাসবিদদের মতে, হিট্টাইটরা উন্নত লোহার সামগ্রী তৈরি করত, সরকারের বিভিন্ন শাখার ওপর স্বাধীন কর্তৃত্বসহ সরকারি কর্মকর্তাদের মাধ্যমে তাদের রাজ্য শাসন করত এবং ঝড় দেবতাদের পূজা করত। কালের বিবর্তনে এক সময় হারিয়ে যেতে থাকে বিশাল এই জনপদ। প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে, শত শত বছরের খরা এবং ভূমধ্যসাগরের ধীরে ধীরে শুকিয়ে যাওয়া জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হিট্টাইট সাম্রাজ্য বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। দীর্ঘ সময়ের খরা সৃষ্টি করে অর্থনৈতিক সংকট ও দুর্ভিক্ষ। পরে তা রূপ নেয় ভয়াবহ সামাজিক বিপর্যয়ে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মাইসেনিয়ান গ্রিস এবং নিউ মিসরীয় একই সময়কালে এমন পতনের শিকার হয়েছিল।

 

আজলান [মেক্সিকো]

সময়কাল : ১১০০-১৩০০ খ্রিস্টাব্দ

পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাওয়া আরেকটি শহর আজলান। অনেকে একে রূপকথার শহরও বলেন। এ শহরকে ঘিরেই গড়ে উঠেছিল আজটেক সভ্যতা। প্রাচীন আমেরিকার অন্যতম উন্নত সভ্যতা বলা হতো আজটেক সভ্যতাকে। মেক্সিকোর আজটেকরা গড়ে তুলেছিল এই সভ্যতা। নাহুয়াল কিংবদন্তির মতে, চিকোমোজটেক এলাকার সাতটি গুহায় বাস করত সাত উপজাতি। এই সাত জাতি এক হয়ে আজটেক জাতি গঠন করে আজতালান দ্বীপে বসবাস শুরু করেছিল। ১১০০ থেকে ১৩০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত আজটেক জাতি আজলানে বসবাস করে। রূপকথায় আজলানকে ‘স্বর্গীয় শহর’ বলা হয়েছে। কিন্তু আজটেকরা আজলান ছেড়ে এক সময় মেক্সিকোর মূল ভূমিতে চলে গিয়েছিল। এর কারণ ছিল আজটেকের চিকোমোজতকরা। তারা ছিল অভিজাত শ্রেণি। দেবতা হুইতিজিলোপোচলি নির্দেশ দিয়েছিলেন চিকোমোজতকরা ছাড়া আর কেউ নিজেদের আজটেক দাবি করতে পারবে না। আর তাই আজলান থেকে প্রথমে তেনোচিতালানে চলে যায় আজটেকরা। যদিও আজলান শহরের কোনো অস্তিত্ব কখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি। কিন্তু দাবি করা হয়, সমুদ্রের তীরে একটি হ্রদঘেরা দ্বীপে গড়ে উঠেছিল আজলান। প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষকরা ধারণা করেন, প্রাচীন আজলান শহরটি সমুদ্রে ডুবে গেছে অথবা কোনো দুর্যোগে অন্য কোথাও সরে গেছে।

 

পেত্রা [জর্ডান]

সময়কাল : ৪০০-২০০ খ্রিস্টপূর্ব

জর্ডানের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে পেত্রা শহরটির অবস্থান। ১৮১২ সালে প্রথম এক সুইস পরিব্রাজক শহরটি আবিষ্কার করেন। পাহাড়ের মধ্যে পাথর কেটে বানানো হয়েছিল পেত্রা শহর। ইতিহাসবিদের মতানুসারে খ্রিস্টপূর্ব ৪০০ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ২০০ অব্দ পর্যন্ত নাবাতাইন রাজ্যের রাজধানী ছিল এই পেত্রা শহরটি। পেত্রা শহরটি ছিল অত্যন্ত সুরক্ষিত এবং এখানকার মানুষ অর্থনৈতিকভাবে ছিলেন বেশ সমৃদ্ধিশালী। এই শহরটি মূলত একটি গুহার মধ্যে তৈরি। কোনো কোনো স্থানে এটি মাত্র ১২ ফুট চওড়া। শহরটির চারপাশে ছিল উঁচু সব পাহাড় এবং পাহাড়গুলোতে ছিল অফুরন্ত ঝরনাধারা। পশ্চিমের গাজা, উত্তরের বসরা ও দামাস্কাস, লোহিত সাগরের পাশের আকুয়াবা ও লিউস এবং মরুভূমির ওপর দিয়ে পারস্য উপসাগরে যাওয়ার প্রধান সব বাণিজ্যিক পথগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করত পেত্রা। রোমান শাসনের সময় সমুদ্রকেন্দ্রিক বাণিজ্য পুরোদমে শুরু হলে পেত্রা দ্রুত ধ্বংস হতে থাকে। ১০৬ এডিতে রোমানরা এটিকে দখল করে তাদের ‘আরব পেত্রাইয়া’ প্রদেশের অংশীভূত করে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় শতকে বাণিজ্যিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ শহরটির দখল নেয় পামিরা। তখন থেকেই এর গুরুত্ব কমতে থাকে। সপ্তম শতকে মুসলমানরা ও দ্বাদশ শতকে ক্রুসেডাররা পেত্রার দখল নেয়। মূলত এরপর থেকেই পেত্রা ধ্বংস হতে শুরু করে। এ ছাড়া ৩৬৩ সালে ভয়াবহ এক ভূমিকম্পে জর্ডানের এই প্রাচীন শহরের বিপুল পরিমাণ ক্ষতিসাধিত হয়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর