সভ্যতার ইতিহাস হাজার বছরের পুরনো। আর সে ইতিহাসের পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে জানা-অজানা নানা বিস্ময়। কালের আবর্তে অনেক বিস্ময়কর সমৃদ্ধ নগরী হারিয়ে গেছে। লুপ্ত হয়েছে অনেক জনপদ। এর কোনোটির হদিস আমাদের একেবারেই অজানা। আবার কোনো কোনোটি সম্পর্কে ইতিহাসবিদরা খুঁজে বের করেছেন নানা তথ্য-উপাত্ত। বিখ্যাত কতগুলো হারিয়ে যাওয়া শহর নিয়েই এ আয়োজন।
 পাথর কেটে তৈরি হয়েছিল শহরটি
পাথর কেটে তৈরি হয়েছিল শহরটি
১৮১২ সালে অনিন্দ্যসুন্দর এই নগরীর অস্তিত্ব তুলে ধরেন সুইস পরিব্রাজক জোহান লুডিগ বুর্খার্দত। পেত্রা শহরটির অবস্থান বর্তমান জর্ডানের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে হুর পাহাড়ের পাদদেশে। পেত্রা শব্দটির অর্থ পাথর। পাহাড়ের মধ্যে পাথর কেটে তৈরি হয়েছিল শহরটি। এ শহরটি মূলত একটি গুহার মধ্যে তৈরি। যা কোনো কোনো স্থানে মাত্র ১২ ফুট চওড়া। পেত্রা শহরে পাথরের দেয়ালের গায়ে গ্রথিত প্রাচীন দালানগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হলো ‘খাজনেত ফিরাউন’ নামক একটি মন্দির। এ মন্দিরটি ফারাওদের ধনভান্ডার হিসেবে বেশ পরিচিত। এ ছাড়া সেখানে রয়েছে অর্ধাগোলাকৃতির একটি নাট্যশালা। আর এ নাট্যশালায় এক সঙ্গে প্রায় ৩ হাজার লোকের বসার ব্যবস্থা ছিল। এক সময়ের সংস্কৃতি, সম্পদ আর ক্ষমতায় সমৃদ্ধশালী এ শহরটিকে ১৯৮৫ সালে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে ঘোষণা করে ইউনেস্কো। ইতিহাসবিদদের গবেষণা অনুসারে, এ শহরটি ৪০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত নাবাতাইন রাজ্যের রাজধানী ছিল। পশ্চিমের গাজা, উত্তরের বসরা ও দামাস্কাস, লোহিত সাগরের পাশের আকুয়াবা ও লিউস এবং মরুভূমির ওপর দিয়ে পারস্য উপসাগরে যাওয়ার প্রধান সব বাণিজ্যিক পথগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করত পেত্রা। রোমান শাসনের সময় সমুদ্রকেন্দ্রিক বাণিজ্য পুরোদমে শুরু হলে পেত্রা দ্রুত ধ্বংস হতে থাকে। ১০৬ এডিতে রোমানরা এটিকে দখল করে তাদের ‘আরব পেত্রাইয়া’ প্রদেশের অংশীভূত করে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় শতকে বাণিজ্যিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ শহরটির দখল নেয় পামিরা। তখন থেকেই এর গুরুত্ব কমতে থাকে। সপ্তম শতকে মুসলমানরা ও দ্বাদশ শতকে ক্রুসেডাররা পেত্রার দখল নেয়। মূলত এরপর থেকেই পেত্রা ধ্বংস হতে শুরু করে।
অগ্ন্যুৎপাতে পুড়ে যাওয়া এক শহর
পম্পেই ছিল ইতালির কাম্পানিয়া অঞ্চলের আধুনিক নেপলসের (নাপোলি) কাছে পম্পেই ইউনিয়নে অবস্থিত একটি ছোট শহর। এ শহরটি ৭৯ খ্রিস্টাব্দে ভিসুভিয়াস আগ্নেয়গিরির দুই দিন স্থায়ী অগ্ন্যুৎপাতে সম্পূর্ণ পুড়ে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। ৬০ ফুট উঁচু ছাই এবং ঝামাপাথরের নিচে শহরটি চাপা পড়ে যায়। রোমান শহরটির সঙ্গে হারকিউলিনিয়াম শহরটিও এ ভিসুভিয়াসের অগুœ্যৎপাতে ধ্বংস হয়ে যায়। এর ঠিক কয়েক বছর আগে ৬২ খ্রিস্টাব্দে একটি ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়েছিল যা কাম্পানিয়া অঞ্চলের পম্পেই নগরী, হারকিউলিনিয়াম এবং অন্যান্য শহরেও আঘাত করেছিল। এটি একটি সতর্কীকরণ ছাড়া আর কিছুই ছিল না যে, কয়েক বছরের মধ্যে এর থেকে আরও বড় ধরনের বিপর্যয় শহরটিতে আঘাত করবে। ভূমিকম্পের ফলে পম্পেই নগরী ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও প্রায় সঙ্গে সঙ্গে এর পুনর্নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ১৭ বছর পরও যখন পুনর্নির্মাণ কাজ একই গতিতে এগিয়ে যাচ্ছিল তখনই অগ্ন্যুৎপাতের ফলে প্রাচুর্যে ভরা পম্পেই নগরী লাভার নিচে পড়ে ধ্বংস হয়ে যায়। হারিয়ে যাওয়ার পর আস্তে আস্তে শহরটি মানুষের মন থেকেও হারিয়ে যায়। ১৫৯৯ সালের দিকে পম্পেইয়ের একটি অংশ মাটি থেকে বেরিয়ে আসে। তারপর পুনঃখননের ফলে বেরিয়ে আসে হারিয়ে যাওয়া ইতিহাস। তবে এটি সম্পূর্ণরূপে আবিষ্কৃত হয় ১৭৪৮ সালে।
 রহস্যঘেরা আটলান্টিস
রহস্যঘেরা আটলান্টিস
পৃথিবীর সেরা রহস্যময় জায়গাগুলোর একটি ধরা হয় আটলান্টিসকে। দূর কোনো অতীতে আটলান্টিস পৌঁছে গিয়েছিল উন্নতি আর আধুনিকতার চরম শিখরে। আটলান্টিস ছিল এক ঐশ্বর্যময় এলাকা। সুজলা-সুফলা পরিবেশের পাশাপাশি এখানকার খনিগুলো ভরা ছিল সোনা, রুপা আর তামার আকরিকে। মহাদেশের দক্ষিণে আটলান্টিসের নৃপতিরা গড়ে তুলেছিলেন অনুপম এক নগরী। নগরীটির নামও ছিল আটলান্টিস। একের পর এক সাজানো জলপথ আর স্থলপথ আইটির মতো বেষ্টন করে রেখেছিল এ নগরীকে। নগরের প্রধান আকর্ষণ ছিল এর কেন্দ্রে অবস্থিত রাজপ্রাসাদটি। ছোট্ট একটি টিলার ওপর গড়ে তোলা হয়েছিল এ সুরম্য প্রাসাদ। একে ঘিরে রেখেছিল তিনটি খাল। প্রাসাদ চত্বরের একেবারে কেন্দ্রস্থলে ছিল একটি মন্দির। আটলান্টিসের মহাক্ষমতাধর রাজা অ্যাটলাস আর তার ৯ ভাই নিয়মিত মিলিত হতেন এ মন্দিরে। উল্লেখ্য, রাজাদের সুশাসনে বড় শান্তিতে, সমৃদ্ধিতে, সুখে দিন কাটছিল দ্বীপটির বাসিন্দাদের। কিন্তু হঠাৎই যেন দ্বীপটিতে ঘনিয়ে এলো মহাপ্রলয়! ভয়ংকর ভূমিকম্পের সঙ্গে সঙ্গে মনে হলো, বিস্ফোরিত হতে চলেছে ভয়ংকর কোনো আগ্নেয়গিরি। তাই হলো। মহাপ্রলয় শুরু হলো সমুদ্রে। দানবীয় থাবা নিয়ে দ্বীপের ওপর লাফিয়ে পড়ল শত ফুট উঁচু সমুদ্রের হিংস্র ঢেউ। হারিয়ে গেল সেই দ্বীপটি। হারিয়ে গেল অভাবনীয় এক সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিশাল এক ভান্ডার। আকস্মিক দুর্বিপাক নিমিষে গায়েব করে দিয়েছিল আটলান্টিসের ৫ কোটি মানুষকে। মাত্র এক দিন এক রাতের ভিতরে গোটা মহাদেশটি বিলীন হয়ে যায় সাগরের গভীরে। বাস্তবে আটলান্টিস বলে উন্নত কোনো শহর ছিল? আসলেই কি এমন এক মহাপ্রলয়ে হারিয়ে গিয়েছিল অস্বাভাবিকভাবে গড়ে ওঠা এক সভ্যতা? সত্যি যাই হোক না কেন হাজার বছর ধরে আটলান্টিসের গল্প করে আসছে মানুষ। আর এ শহরের কথা প্রথমবারের মতো তুলে ধরেন গ্রিক দার্শনিক প্লেটো। প্লেটোর বর্ণনা মতে, বর্তমান জিব্রাল্টা প্রণালির কাছেই অসম্ভব উন্নত, আধুনিক ও সুশৃঙ্খল এক দ্বীপ ছিল আটলান্টিস। অদ্ভুত সব আবিষ্কার, সুন্দর সমাজব্যবস্থা ও আধুনিক জীবনধারা সবই ছিল আটলান্টিসবাসীর কাছে। প্লেটোই বর্ণনা দিয়েছেন, প্রায় ১২ হাজার বছর আগে, শেষ বরফ যুগের আগে ভয়াবহ এক প্রাকৃতিক দুর্যোগে হারিয়ে যায় আটলান্টিস।
দুর্গম অঞ্চলে সমৃদ্ধ অ্যাংকর নগরী
কম্বোডিয়ার দুর্গম অঞ্চলে অবস্থিত এ শহরটির সামগ্রিক পরিচিতি জানা না গেলেও অনেক কিছুই খুঁজে বের করেছেন গবেষকরা। ধারণা করা হয়, খ্রিস্টপূর্ব ৮০২ সালের দিকে কম্বুজা [এখনকার কম্বোডিয়া ও তার আশপাশের দেশ] ছিল জাভা দ্বীপের সম্রাটের অধীনে। ‘জয়বর্মণ’ জাভার রাজার কাছ থেকে কম্বুজাকে স্বাধীন করেন। তারপর সেখানে এক নতুন সাম্রাজ্য স্থাপন করেন, গোড়াপত্তন করেন এক নতুন নগরের। আর সেটিই হচ্ছে ‘অ্যাংকর’। সেই সময়ের সবচেয়ে অভিজাত ও সমৃদ্ধ নগরীগুলোর একটি ছিল এই অ্যাংকর। আংকরিয়ানরা ছিল পাথর খোদাইয়ে শ্রেষ্ঠ। তার প্রমাণ হলো কম্বোডিয়ায় অবস্থিত বিশাল বিশাল মন্দির ও কবর। মজার ব্যাপার হলো একটি খোদাইকৃত পাথরে ওই সময়ের গবাদিপশুর বর্ণনা পাওয়া যায়। আয়তনে নগরটি ছিল বিশাল, আর তাতে তখনই বাস করত প্রায় সাড়ে ৭ লাখ মানুষ। এ সমৃদ্ধ নগরীর প্রভাব-প্রতিপত্তি ঠাটবাট বজায় ছিল বহু বছর। সবশেষে ১৪৩১ সালে অযোধ্যার রাজার কাছে পরাজিত হয়ে ধ্বংস হয়ে যায় অ্যাংকর নগর। ২০০৭ সালে একদল গবেষক উপগ্রহ থেকে তোলা ছবি ও আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে প্রমাণ করেন, অ্যাংকর হলো শিল্পযুগের আগে স্থাপিত সবচেয়ে বড় শহর। তারা এও দাবি করেন, এ শহরটির আয়তন ছিল ১১৫০ বর্গকিলোমিটার।
 সুন্দরী হেলেন ও ট্রয়ের ইতিহাস
সুন্দরী হেলেন ও ট্রয়ের ইতিহাস
বিশ্বের ইতিহাসে ধ্বংসপ্রাপ্ত নগরীগুলোর মধ্যে অন্যতম বিখ্যাত একটি নগরী হলো ট্রয়। এটি একটি কিংবদন্তি শহর যেটিকে কেন্দ্র করে বিখ্যাত ট্রয়ের যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। এ শহর এবং সংশ্লিষ্ট যুদ্ধের বর্ণনা প্রাচীন গ্রিসের অনেক মহাকাব্যেই পাওয়া যায়। ট্রয়ের নাগরিক এবং সংস্কৃতি বোঝাতে ট্রোজান শব্দটি ব্যবহৃত হয়। ট্রয় নগরীর সত্যিকার অবস্থান সম্পর্কে পরিষ্কার কোনো তথ্য-উপাত্ত না থাকলেও ইতিহাসখ্যাত সুন্দরী হেলেনকে নিয়ে সংঘটিত ট্রয়ের যুদ্ধের কারণে এটি ইতিহাসে আলাদা স্থান দখল করে আছে। বলা হয়ে থাকে, এ যুদ্ধের কারণেই নগরীটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল। রোমান সম্রাট অগাস্টাসের রাজত্বকালে প্রাচীন ট্রয় নগরীর ধ্বংসস্তূপের ওপর ইলিয়াম নামে নতুন একটি শহর নির্মিত হয়। কনস্টান্টিনোপল প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগ পর্যন্ত ইলিয়াম বিকশিত হয়েছে, কিন্তু বাইজান্টাইন রাজত্বের সময় ধীরে ধীরে এর পতন হতে থাকে। ১৮৭০ সালে জার্মান প্রত্নতত্ত্ববিদ হাইনরিশ শ্লিমান এ এলাকায় খননকাজ শুরু করেন। এ খনন চলতে থাকায় একসময় প্রমাণিত হয় যে, এখানে একের পর এক বেশ কয়েকটি শহর নির্মিত হয়েছিল। সম্ভবত এই শহরগুলোরই একটি হোমারের ট্রয়। অবশ্য এ নিয়ে সন্দেহ আছে। কিন্তু এটা প্রায় নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হয়েছে, হিত্তীয় রচনায় উল্লিখিত উইলুসা শহরটি এখানেই অবস্থিত ছিল। অনেকে মনে করেন, ইলিয়ন এই উইলুসা নামেরই গ্রিক সংস্করণ। খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে ধ্বংস হয়ে যায়, যার মূল কারণ ছিল ভূমিকম্প।
 
                         
                                     
                                                             
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                        