মঙ্গলবার, ২৯ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

সুরের মূর্ছনায় মাতিয়ে পর্দা নামলো উচ্চাঙ্গ উৎসবের

মোস্তফা মতিহার

সুরের মূর্ছনায় মাতিয়ে পর্দা নামলো উচ্চাঙ্গ উৎসবের

‘বাঁশি শুনে আর কাজ নাই সে যে ডাকাতিয়া বাঁশি, সে যে দিনদুপুরে চুরি করে রাত্তিরেতে কথা নাই’ বাঁশি নিয়ে এমন বহু গান রয়েছে। বাঁশি মানব মনের লুকায়িত আবেগ আর অনুভূতির দরজায় করুণভাবে নাড়া দেয়। যার কারণে এই সুরকে ডাকাতিয়া সুরও বলা হয়ে থাকে। আর সেই বাঁশির সঙ্গে যদি ধ্রুপদী সুর থাকে এবং বংশীবাদক যদি কিংবদন্তি বাঁশি শিল্পী পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া হয় তাহলে তো কথাই নেই। সন্ধ্যা থেকেই চৌরাসিয়ার বাঁশির সুরে স্নাত হওয়ার জন্য শাস্ত্রীয় সংগীতের সমঝদাররা প্রতীক্ষার দীর্ঘ প্রহর গুনছিলেন। রাত ৩টার কিছু পরে যখন কাঙ্ক্ষিত চৌরাসিয়া মঞ্চে আসলেন তখন সমগ্র স্টেডিয়ামে সৃষ্টি হয় প্রাণের উচ্ছ্বাস। শিল্পীকে অভিবাদন জানানোর জন্য পরিবেশনার আগেই মুহুর্মুহু করতালিতে স্টেডিয়ামকে প্রকম্পিত করে তোলে    সুরপিয়াসীরা। আর উপমহাদেশের বিখ্যাত এই বাঁশির পণ্ডিতও সুরের কাঙ্গালদের নিরাশ করেননি। বাঁশিতে সুর তুলে আর্মি স্টেডিয়ামের কয়েক হাজার দর্শক-শ্রোতাকে সুরের সমুদ্রে ভাসিয়ে দিয়ে নিজের পরিবেশনা শেষ করলেন ভারত সরকারের পদ্মবিভূষণ, সংগীত নাটক আকাদেমি পুরস্কার ও ন্যাশনাল এমিনেন্স অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত এই বাঁশিওয়ালা। আর চৌরাসিয়ার বাঁশির ধ্রুপদী সুরেই বেঙ্গল উচ্চাঙ্গ সংগীত উৎসব ২০১৬ এর পর্দা নামল। শুদ্ধ সংগীতের অগণিত অনুরাগীদের মধ্যে সুরের রেশ রেখে দিয়েই আজ ভোরে শেষ হলো পাঁচ রাতের এই সুরের উৎসব। চৌরাসিয়ার বাঁশির সঙ্গে উৎসবের  সমাপনী রাতে বৈচিত্র্য বয়ে আনে পণ্ডিত শিব কুমার শর্মার সন্তুরের পরিবেশনা। সন্তুরে দ্যোতনা ছড়িয়ে সুরের সমুদ্রে ঢেউ তুলে দেন এই শিল্পী। এ ছাড়াও দলীয় কণ্ঠসংগীত পরিবেশন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীতবিভাগের শিল্পীরা। দলীয় সেতার বাজিয়ে শোনান বেঙ্গল পরম্পরা সংগীতালয়ের শিক্ষার্থীরা। কুমার মারদুর শোনান খেয়াল। সেতার পরিবেশন করেন পণ্ডিত কুশল দাস। খেয়াল পরিবেশন করেন আরতী অঙ্কালিকার।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীতবিভাগের শিল্পীদের সম্মেলক পরিবেশনার মধ্য দিয়েই শুরু হয় সমাপনী রাতের আয়োজন। তারা রাগ ভূপালি পরিবেশন করেন। তবলায় সঙ্গত করেন মো. জাকির হোসেন ও স্বরূপ হোসেন। পরিবেশনা শেষে তাদের হাতে উত্সবের সম্মাননা স্মারক তুলে দেন বাংলাদেশে নিযুক্ত সাবেক ভারতীয় রাষ্ট্রদূত দেব মুখার্জি। শিল্পীদের পক্ষে স্মারক গ্রহণ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগের চেয়ারম্যান ড. লিনা তাপসী।

সেতার, তবলা ও গিটারের সম্মিলিত সুরে তারা রাগ চারুকেশী পরিবেশন করেন তারা। এসময় তবলায় ছিলেন প্রশান্ত ভৌমিক ও সুপান্থ মজুমদার। বাদ্য শেষে তাদের হাতে সম্মাননা স্মারক তুলে দেন জাতীয় কারুশিল্প পরিষদের সহ-সভাপতির রুবি গজনবী।

অনুষ্ঠানে খেয়াল পরিবেশন করেন কুমার মারদুর। সেতার পরিবেশন করেন পণ্ডিত কুশল দাস। সেতারের তারে তারে তিনি সুরের ধারা বইয়ে দেন। এবারের উত্সবের প্রতি রাতেই খেয়াল বিশেষ প্রাধান্য পেয়েছিল। পণ্ডিত কুশল দাসের পর খেয়াল পরিবেশেন করেন আরতি অঙ্কালিকার। বিশিষ্ট এই কণ্ঠশিল্পী আগ্রা গোয়ালিয়র ঘরানার পণ্ডিত বসন্ত রাওকুলকার্নি এবং জয়পুর আত্রৌলি ঘরানার কিশোরী আমানকারের কাছে সংগীতে তালিম নেন। সুকণ্ঠী এই গায়িকার তাল ও সুরের চমত্কার খেলা এক মোহময় আবহের সৃষ্টি করে। তবলায় তাকে সঙ্গত করেন রোহিত মজুমদার।

এরপরই বেঙ্গল উচ্চাঙ্গ সংগীত উত্সব ২০১৬-এর আনুষ্ঠানিক সমাপনী ঘোষণা করা হয় এরপরই। অধিবেশনে প্রধান অতিথি ছিলেন ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারপারসন স্যার ফজলে হাসান আবেদ। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ইমেরিটাস প্রফেসর ড. আনিসুজ্জামান। এতে বিশেষ অতিথি ছিলেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আনিসুল হক এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন।

সমাপনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবুল খায়ের।

ড. আনিসুজ্জামান উত্সবে আগত শিল্পীদের প্রতি বিশেষ কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, ‘আমাদের দেশে উচ্চাঙ্গ সংগীতের চর্চা যখন স্তিমিত হতে যাচ্ছিল তখন এই উত্সব সে চর্চাকে আবার উজ্জীবিত করেছে। যা আমাদের জাতীয় চেতনায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে।

ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারপারসন স্যার ফজলে হাসান আবেদ তার বক্তব্যেও শুরুতেই প্রয়াত সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হককে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের রক্তে শুদ্ধ সংগীতের ধারা বইছে। এই ভূখণ্ড থেকে একসময় ওস্তাদ আলী আকবর, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, পণ্ডিত রবিশঙ্করের মতো শিল্পীর জন্ম হয়েছে। এই উত্সব চলমান থাকলে পুনরায় আমরা বিশ্বমানের শিল্পী পাব।

ঢাকা উত্তর সিটির মেয়র আনিসুল হক আয়োজকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা ব্যক্ত করেন। দেশের সংগীত শিল্পকে আরও এগিয়ে নিতে তিনি সংগীত প্রযোজকদের অনুরোধ করেন শিল্পীদের ন্যায্য পাওনা দেওয়ার জন্য।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবুল খায়েরের প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে পুরান ঢাকার ১২টি সংগীত বিদ্যালয় পরিচালনার ভার নিতে তাকে অনুরোধ করেন এবং সাংস্কৃতিক কেন্দ্র গড়ে তোলার জন্য পর্যাপ্ত সাহায্য করারও আশ্বাস দেন। মৌলবাদী অপশক্তি প্রতিরোধে এই উত্সবকে একটি শক্তিশালী উদ্যোগ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রধানমন্ত্রীর যোগ্য নেতৃত্বে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে। কোন অপশক্তি এই অগ্রযাত্রা রুখতে পারবে না।’

স্কয়ার গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অঞ্জন চৌধুরী বলেন, ‘ভবিষ্যতে অন্যান্য আরও বড় উত্সব আমরা আপনাদের উপহার দেব।’

বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবুল খায়ের বক্তব্যের শুরুতেই প্রয়াত লেখক সৈয়দ শামসুল হক, হলি আর্টিজানে নিহত দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ সম্প্রতি ঘটে যাওয়া মৌলবাদী আক্রমণে নিহতদের স্মরণ করে আগত সবাইকে এক মিনিট নীরবতা পালন করতে অনুরোধ করেন। আবুল খায়ের সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠান আয়োজনে সহায়তা করার জন্য প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী ও সংস্কৃতিমন্ত্রীসহ বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও বাংলাদেশ পুলিশের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করেন যেন দেশে কমপক্ষে তিন হাজার সিনেমা হল তৈরি করে দেওয়া হয়। তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে একটা বড় সাংস্কৃতিক কেন্দ্র গড়ে তুলতে চাই আমরা। যেখানে শুধু সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড হবে।’ বক্তব্যের শেষে তিনি আসছে জানুয়ারি মাসে তিন রাত ধরে সুফি গানের উত্সব করার ঘোষণা দেন। সমাপনী অনুষ্ঠান শেষে অতিথিদের হাতে উত্সবের সম্মাননা স্মারক তুলে দেন তিনি।

বেঙ্গল উচ্চাঙ্গ সংগীত উত্সবের এবারের আসর নিবেদন করেছে স্কয়ার এবং সহযোগিতায় আছে ব্র্যাক ব্যাংক।

প্রয়াত সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের স্মৃতির প্রতি এবারের উত্সব উত্সর্গ করা হয়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর