রবিবার, ৯ অক্টোবর, ২০১৬ ০০:০০ টা

পূজা আসে প্রতিবার

তপন কুমার ঘোষ

পূজা আসে প্রতিবার

শুরু হয়েছে বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গোৎসব। পূজার প্রস্তুতি চলছে কয়েক মাস ধরেই। শরতের নীল আকাশ, ঘাসের আগায় শিশির বিন্দু, ভোরের মাটিতে ঝরেপড়া শিউলি, কাশবনের ঢেউ— এসব কিছুই জানিয়ে দিচ্ছে পূজা এসে গেছে।

গত ৩০ সেপ্টেম্বর মহালয়ার মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে দুর্গাপূজার আনুষ্ঠানিকতা। চণ্ডী পাঠ করে দেবী দুর্গাকে মর্ত্যে আবাহন জানানোর অনুষ্ঠান হচ্ছে মহালয়া। দুর্গোৎসবের মূল পর্বের অনুষ্ঠানমালা শুরু ষষ্ঠীপূজা থেকে। ৭ অক্টোবর ষষ্ঠী তিথিতে দেবী বোধনের মধ্য দিয়ে দেবীকে বরণ করে নেওয়া হয়। পাঁচ দিন ধরে চলবে দুর্গাপূজার আচার-অনুষ্ঠান। দিনে পূজা-অর্চনা, অঞ্জলি প্রদান, প্রসাদ বিতরণ ও রাতে আরতি নৃত্য ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে ভক্তরা পার করবেন ব্যস্ত সময়। ১১ অক্টোবর বিজয়া দশমীতে দেবীকে বিসর্জনের মধ্য দিয়ে শেষ হবে এই আনন্দযজ্ঞ।

এ বছর বাংলাদেশে ২৯ হাজারেরও বেশি পূজামণ্ডপে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। মণ্ডপ নির্মাণে আনা হয়েছে বৈচিত্র্য। প্রতিমা নির্মাণ ও সাজসজ্জায় এসেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। ব্যতিক্রমী মণ্ডপ নির্মাণ করা হয়েছে বিভিন্ন স্থানে। নোয়াখালীর চৌমুহনীতে এবার নির্মাণ করা হয়েছে দেশের সবচে বড় দুর্গা প্রতিমা। উচ্চতা ৭১ ফুট। দিনাজপুরের কান্তজীর মন্দিরের আদলে তৈরি করা হয়েছে গুলশান-বনানী সার্বজনীন পূজা ফাউন্ডেশনের পূজামণ্ডপ। এখন বড় শহরে বড় বাজেটের পূজা হয়। স্পন্সরও জুটে যায়। সরকারি অনুদানের টাকা যথাসময়ে পৌঁছে গেছে পূজা কমিটিগুলোর হাতে।

দুর্গোৎসব উপলক্ষে বিভিন্ন মণ্ডপে গরিবদের মধ্যে বস্ত্র বিতরণ করা হবে। স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচিতে অনেকে অংশগ্রহণ করবেন। আত্মীয়স্বজনের মধ্যে চিরাচরিত প্রথায় উপহার বিনিময়ের পর্বটি শেষ হয়েছে আগেই।

পূজার কদিন দর্শনার্থীদের ভিড়ে মুখরিত থাকবে পূজা প্রাঙ্গণ। নতুন পোশাক পরে অভিভাবকদের হাত ধরে শিশু-কিশোররা ঘুরে বেড়াবে এক মণ্ডপ থেকে অন্য মণ্ডপে। বিভিন্ন স্থানে বসবে পূজাকেন্দ্রিক মেলা। মেলায় গিয়ে এটা-ওটা কিনে দেওয়ার বায়না ধরবে শিশুরা। পছন্দের জিনিসটা হাতে পেলে মনে হবে তার চেয়ে খুশি এ পৃথিবীতে আর কেউ নেই!

নানা আচার-অনুষ্ঠানের কারণে দুর্গাপূজা এতটাই ব্যয়বহুল যে, সম্পন্ন পরিবার ছাড়া এককভাবে এ পূজা করা সম্ভব নয়। সেকালেও রাজা এবং জমিদাররা ছিলেন দুর্গাপূজার প্রধান পৃষ্ঠপোষক। যশোরের প্রাচীন পূজাগুলোর মধ্যে রায়চৌধুরী পরিবারের পূজা অন্যতম। শহরের অদূরে বিরামপুরের রায়চৌধুরী পরিবারের পূজার বয়স প্রায় ২০০ বছর। ২০০ বছরের পুরনো পারিবারিক পূজা কালক্রমে সার্বজনীন পূজায় রূপান্তরিত হয়েছে। এভাবেই পারিবারিক পূজার সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছুই বদলে যায়। এখন আর ভিড়ের মধ্যে মণ্ডপে মণ্ডপে ঘুরতে মন চায় না। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার বদৌলতে ঘরে বসেই উপভোগ করি পূজার আনন্দ। স্মৃতি রোমন্থন করে হারিয়ে যাওয়া শৈশবকে খুঁজে ফিরি। নড়াইলের কালিয়া উপজেলার একটি অজ গ্রাম ‘সুমেরু খোলা’। চিত্রা নদীর পারের ওই ছোট্ট গ্রামে কেটেছে আমার শৈশব-কৈশোর।

মহালয়ার দিন ভোরে আকাশ বাণী থেকে প্রচার করা হতো চণ্ডীপাঠের অনুষ্ঠান ‘মহিষাসুর মর্দিনী’। বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠে ভুবন মাতানো নিবেদন একসঙ্গে বসে শোনা, নতুন জামা-কাপড় পরে দলবেঁধে ঠাকুর দেখতে যাওয়া, পূজার বাজনা, পুরোহিতের উচ্চকণ্ঠে মন্ত্র উচ্চারণ— সব মিলিয়ে পূজার আনন্দটাই ছিল অন্য রকম। মণ্ডপের এক পাশে দাঁড় করিয়ে রাখা হতো ‘কলাবউ’। নদীর অপর পারে সিকদার বাড়ির পূজায় পাঁঠাবলি দেওয়া হতো। লোকে বলাবলি করত, এক কোপে পাঁঠাকে বলি দিতে হবে। নইলে মা দুর্গা অসন্তুষ্ট হবেন। সবার অমঙ্গল হবে। পাড়ার একজন শক্ত সামর্থ্য লোককে এ দায়িত্ব দেওয়া হতো। নবমীতে বলি দেওয়া হতো চালকুমড়া ও আখ।

বিজয়া দশমীতে বড়দের প্রণাম করলে আড়ং খরচ বাবদ হাতে কাঁচা পয়সা গুঁজে দিতেন। একটা চকচকে সিকি অথবা আধুলি পেলে সে কি আনন্দ! সূর্যাস্তের পর আশপাশের সব প্রতিমা নিয়ে জড়ো করা হতো সিঙ্গাশোলপুর বাজারের খেয়াঘাটে। সেখানে ঢাকের লড়াই হতো। সন্ধ্যায় বড় নৌকায় প্রতিমা নিয়ে নদীবক্ষে ভেসে বেড়াতেন ভক্তরা। রাত কিছুটা গভীর হলে শুরু হতো প্রতিমা নিরঞ্জন। মাঝ নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হতো প্রতিমা। এটাকে স্থানীয়ভাবে ‘ভাসান’ বলে। ‘চিত্রা নদীর পারে’ চলচ্চিত্রে এ দৃশ্যটি চিত্রায়ণ করা হয়েছে। ছেলেবেলার পূজায় চাকচিক্য না থাকলেও আনন্দের কমতি ছিল না।

বিশ্বের বড় বড় শহরে প্রবাসী বাঙালি হিন্দুরা মিলে পূজার আয়োজন করেন। কলকাতা থেকে বাক্সবন্দী করে প্রতিমা নিয়ে যাওয়া হয়। প্রবাসে পঞ্জিকা মেনে নির্ঘণ্ট অনুযায়ী পূজা হয় না। পূজায় ছুটি নেই। তাই পূজা আয়োজন করা হয় কাছাকাছি উইক এন্ডে। শনি ও রবিবারে। পাঁচ দিনের পূজা এক বা দু’ দিনেই সেরে ফেলা হয়। ‘প্রবাসে নিয়ম নাস্তি’। অনেক দেশেই উন্মুক্ত স্থানে পূজা করার অনুমতি নেই। হল ভাড়া করে পূজা করতে হয়। আবার পূজা শেষে প্রতিমা বিসর্জনও দেওয়া হয় না। ফি বছর একই প্রতিমা পূজা করা হয়।

দুর্গোৎসব শুধু ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা নয়; এর সঙ্গে বিনোদনও জড়িত। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও মেলা দুর্গোৎসবের বড় আকর্ষণ। পূজার আচার-অনুষ্ঠান হিন্দু সম্প্র্রদায়ের হলেও পূজাকেন্দ্রিক বিনোদন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন সব সম্প্রদায়ের লোক। ঢাকা শহরের পূজামণ্ডপগুলোর দর্শনার্থীদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ অন্য সম্প্রদায়ের।

পূজা প্রাঙ্গণগুলো প্রকৃত অর্থেই মানুষের মিলনমেলা। ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সব শ্রেণির মানুষের ঢল নামবে পূজামণ্ডপগুলো ঘিরে। চেনা-অচেনা কত মানুষের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ হবে। কুশল বিনিময় হবে। পারস্পরিক মেলামেশা ও আলাপচারিতা ভ্রাতৃত্ববোধ জাগিয়ে তোলে। সামাজিক অনুষ্ঠানে সবার অংশগ্রহণের ফলে মানুষে মানুষে সম্প্রীতির মেলবন্ধন রচিত হয়। ঘুচে যায় দূরত্ব। হানাহানির এ বিশ্বে বিভিন্ন পালাপার্বণ ও উৎসব-আনন্দ থেকে এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কী-ই বা হতে পারে। সবাইকে শারদীয় শুভেচ্ছা।

লেখক : সাবেক উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি), জনতা ব্যাংক লিমিটেড।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর