শনিবার, ১৫ অক্টোবর, ২০১৬ ০০:০০ টা

রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র ও বিকল্প ভাবনা

ড. শেখ আবদুস সালাম

রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র ও বিকল্প ভাবনা

আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞানের একজন শিক্ষক। আমার জন্ম, বেড়ে ওঠা সবকিছু বাগেরহাটের রামপালে। আজ পর্যন্ত আমার নিয়মিত বাড়িতে যাতায়াতের কারণে এলাকায় গেলে এলাকার মানুষ বা পরিচিতজনেরা দেখা-সাক্ষাৎ করতে এলে কিংবা অপরিচিতজনেরাও যখন বিভিন্ন সময় সাক্ষাতে জানতে পারেন যে আমার বাড়ি রামপাল তখন তারা প্রথম জানতে চান রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে যে হৈচৈ আসলে এ ব্যাপারটা কি? আমি উত্তর দেই, বিষয়টি সম্পর্কে আপনারা যা জানেন আমিও ততটুকুই জানি। গণযোগাযোগ এবং সাংবাদিকতার ছাত্র এবং একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে মানুষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা, পত্রপত্রিকা ও বিভিন্ন গণমাধ্যম থেকে প্রাপ্ত তথ্যের বাইরে এই প্রকল্পের সায়েন্টিফিক প্রভাব বা কৃেকৗশলগত যথার্থতা নিয়ে আমার তেমন কোনো জ্ঞান বা জানাশোনা নেই। বাড়িতে গেলে বহু মানুষের সঙ্গে আমার মিথস্ক্রিয়ার সুযোগ ঘটে। তখন তাদের মধ্যেও রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের ব্যাপারে ঐকমত্য দেখি না। আমি লক্ষ করেছি তারাও যেন রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে এবং বিপক্ষে বিভক্ত। তবে সম্প্রতি মনে হচ্ছে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে কয়েকদিন পূর্বে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যে প্রেস কনফারেন্সটি করেছেন তারপর থেকে সারা দেশের মানুষের ন্যায় রামপাল এলাকার মানুষেরও এমন মনোভাব তৈরি হয়েছে যে, ‘আমরা সুন্দরবনও চাই, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রও চাই’।

আমি এখন থেকে প্রায় ২/৩ বছর আগে একটি জাতীয় পত্রিকায় (সমকাল : ১৩/১০/২০১৩) ‘রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে চাই চুলচেরা বিশ্লেষণ’ শিরোনামে একটি লেখা লিখেছিলাম। আজ ২০১৬ সালে এসেও সেসবের বিশ্লেষণ সম্পন্ন করে সরকার এবং সুন্দরবনের কাছে রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের বিরোধিতাকারীদের মধ্যে কোনো ঐকমত্যে পৌঁছানো সম্ভব হয়েছে বলে মনে হয় না। দুপক্ষই বরং এখন যেন আরও মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছে। খোদ প্রধানমন্ত্রী বলছেন বিরুদ্ধবাদীদের সঙ্গে বসে আর কি হবে? অন্যদিকে বিরোধিতাকারীরা বলছেন সরকারের সঙ্গে বসে আর লাভ হবে না, আন্দোলনের মধ্য দিয়েই যা কারার তা করতে হবে। সরকার এবং বিরোধিতাকারীদের এ অবস্থান কোনোটাই কাম্য নয়। কোনো ঘটনা বা ইস্যু নিয়ে বিরোধ থাকলেও কোনোক্রমেই ‘ডায়ালগ’ বন্ধ করা সমীচীন হবে বলে মনে করি না। শুরুতে দেখা যাক রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রটি রামপালের কোথায় অবস্থিত এবং এই জায়গাটি কেন নেওয়া হলো? পাঠকের উদ্দেশ্যে জানাই বিদ্যুৎকেন্দ্রটির অবস্থান হচ্ছে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বাগেরহাট জেলার রামপাল উপজেলাধীন গৌরম্ভা ইউনিয়নের কৈকরদাসকাঠি ও সাতমারি মৌজায়। এটি হচ্ছে সুন্দরবন থেকে ১৪ কি.মি উত্তরে একেবারে খুলনার সীমানা কাছাকাছি এলাকায়। বিদ্যুৎকেন্দ্রটির জন্য সাড়ে নয়শ’ থেকে প্রায় এক হাজার একর জমি অধিগ্রহণ করে নেওয়া হয়েছে যার সবটাই প্রায় বিলান জমি। ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি এখানে কম; বাড়িঘরও ছিল খুবই কম। এ জমি মূলত যারা যখন রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকত তাদের আনুকূল্যে কিছু মাস্তান প্রকৃতির লোক জোরপূর্বক দখল করে ঘের বা চিংড়ি চাষের জন্য ব্যবহার করত। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উন্নয়নের লক্ষ্যে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করতে গিয়ে সরকারের পক্ষে জমি অধিগ্রহণের প্রয়োজন। এসব বিবেচনায় জমির মালিক কিংবা এলাকার জনগণের তেমন কোনো প্রতিরোধ ছাড়াই এ জায়গাটি খুব সহজেই সরকার অধিগ্রহণ করতে পেরেছে। বিশাল এ পরিমাণ জমি অধিগ্রহণ করতে গিয়ে সরকারকে তেমন কোনো ঝক্কি-ঝামেলা পোহাতে হয়নি। যা কিছু সমস্যার উদ্ভব ঘটেছে সেটি হচ্ছে এ জায়গাটি সুন্দরবন থেকে মাত্র ১৪ কি.মি. দূরে অবস্থিত এ বিষয়টি নিয়ে।  অন্যদের মতো আমিও একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে বুঝি যে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের মূল উদ্বেগটি সুন্দরবনকে ঘিরে। সুন্দরবন, এ বদ্বীপ-ভূমি বনাঞ্চলটির একটি স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এটি শুধু একটি জলমিশ্রিত মাটি খণ্ড নয়। আবুল মোমেন গত ২১ সেপ্টেম্বর একটি শীর্ষস্থানীয় দৈনিকে তার একটি লেখায় সুন্দরবনকে ‘জটিল এক জৈব রসায়নাগার’ বলে উল্লেখ করেছেন। তার মতে সুন্দরবন হচ্ছে উদ্ভিদ-প্রাণী-পানি-মাটির মিশেলে এক ‘জৈবমণ্ডল’। এখানের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রাণ সম্পদের ভরপুরতা আজও অজানা, অনাবিষ্কৃত। সুন্দরবন পানি ও নবীন ভূমির এমন এক ভূখণ্ড যেখানে বড় প্রাণীর তুলনায় পোকা, পতঙ্গ ও অণুজীবের সংখ্যা বিপুলভাবে বেশি। এসব ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রাণী কীভাবে আমাদের উপকার করছে, কীভাবে প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করে চলেছে তা হয়তো আমরা জানিও না। বিদ্যুৎকেন্দ্র কিংবা যেকোনো শিল্প স্থাপনা যেখানেই বসানো হোক না কেন সেখানে প্রাকৃতিক পরিবেশ কম-বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেই। এ ক্ষয়ক্ষতি সহনশীল এবং সর্বনিম্ন পর্যায়ে রেখে (সবচেয়ে ভালো হয় ‘শূন্য’ পর্যায়ে রেখে) আমাদের উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। প্রাকৃতিক কিংবা পরিবেশগত ক্ষয়ক্ষতি এবং উন্নয়ন এ দুইয়ের মধ্যে ভারসাম্য তৈরি করে এগিয়ে না গেলে দেশের ভবিষ্যৎইবা কি দাঁড়াবে সে বিষয়টিও আমাদের মাথায় রাখতে হবে।

যা হোক, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের ব্যাপারে উদ্বেগের কারণ হয়তো অনেকগুলো তবে মুখ্যত দুটি। এক. সুন্দরবন, দুই. পরিবেশ (পানি, মাটি, অসংখ্য ক্ষুদ্র ও বড় প্রাণীকুল, উদ্ভিদ, জৈবমণ্ডল। আরও কিছু বিষয়ের সংশ্লেষও এখানে রয়েছে। যেমন : রাজনীতি ও ব্যবসার সমন্বিত হিসাব-নিকাশ; নির্মাণ (সড়ক, জেটি ইত্যাদি) ও অবকাঠামো তৈরি; বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত দিক প্রভৃতি। এ ছাড়াও মানুষের মনস্তাত্ত্বিক প্যারামিটারসমূহ যেমন; ভালো লাগা-মন্দ লাগা, শঙ্কা-শঙ্কাহীনতা, শান্তি-অস্থিরতা এসব কিছুও যথেষ্ট বিবেচনার দাবি রাখে। সুন্দরবন সংশ্লেষ উদ্বেগের কারণ মূলত বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য প্রতিদিন ১০ থেকে ১৩ হাজার টন (বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য প্রতি মাসে প্রায় ৪ লাখ টন কয়লার প্রয়োজন হবে) কয়লা জাহাজ থেকে নামিয়ে সুন্দরবনের ভিতর দিয়ে পশুর নদীর বুক চিরে বার্জ বা ছোট ছোট ভেসেলে করে বিদ্যুৎকেন্দ্রে পৌঁছাতে হবে এটিকে ঘিরে। জাহাজগুলো থাকবে গভীর সাগরে। বলা হচ্ছে বড় বড় জাহাজে করে এই কয়লা আসবে  অস্ট্রেলিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে। উল্লেখ্য, বিদ্যুৎকেন্দ্রটির জন্য কয়লার উৎস হবে ১০০% আমদানিভিত্তিক। এ তিনটি দেশ ছাড়াও বিশ্বে রাশিয়া, আমেরিকা, কলম্বিয়া, নেদারল্যান্ড, কানাডা, উত্তর কোরিয়া, পোল্যান্ড, চীন, মঙ্গোলিয়া, ভিয়েতনাম, ভারত প্রভৃতি দেশ কয়লা উৎপাদন এবং রপ্তানি করে থাকে। বিশ্বে প্রায় ২০ থেকে ২২ ধরনের কয়লা উৎপাদিত হয়। একেক কয়লার এক এক রকম বৈশিষ্ট্য, এক এক রকম মান এবং এক এক রকম দাম। এর সঙ্গে রয়েছে পরিবহন খরচ। যেমন : কয়লায় যদি জলীয়বাষ্পের পরিমাণ বেশি থাকে তাহলে সেই কয়লা থেকে তাপ উৎপাদন কম হবে, পরিমাণমতো তাপ উৎপাদন করতে অনেক সময় লাগবে। ফলে কাম্য পরিমাণ বিদ্যুৎ পেতে বেশি কয়লা পোড়াতে হবে। আবার কোনো কোনো কয়লায় সালফারের পরিমাণ বেশি থাকলে পোড়ানোর সময় তা থেকে ক্ষতিকারক সালফার-ডাই-অক্সাইডের নিঃসরণ ঘটবে বেশি। এতে পরিবেশ-প্রতিবেশের ক্ষতি হবে। আবার এক ধরনের কয়লায় অ্যাশ বা ছাঁই-এর মাত্রা বেশি। পত্র-পত্রিকায় দেখেছি এই বিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রতিদিন যে কয়লা পুড়বে তাতে পায় ১৬০০ টন ছাই জমবে। এটিও পরিবেশের ক্ষতি করবে (তবে এই ছাই আবার সিমেন্ট তৈরির কাজেও ব্যবহার করা যাবে এবং সেখান থেকে একটা বড় আয় সৃষ্টিরও সম্ভাবনা থাকবে)। সুন্দরবনের কাছেই (মাত্র ১৪ কি.মি.) হোক কিংবা দূরেই হোক যেকোনো জায়গায় এ বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করতে গেলে প্রথম বিবেচ্য হওয়া দরকার যে, দীর্ঘ ২৫/৩০ বছর বা তারও বেশি সময় ধরে বিদ্যুৎ প্ল্যান্টের জন্য কয়লার সরবরাহ নিশ্চিত করা। পরিবেশের কম ক্ষতি করে কোন ধরনের কয়লা আমদানি করা যাবে এবং কয়লার ক্রয়মূল্য ও তার পরিবহন ব্যয় হিসাব করে সাশ্রয়ী মূল্যে তা কীভাবে, কোথা থেকে নিয়ে আসা হবে সে বিষয়টি প্রথম থেকেই ভেবে রাখা দরকার। 

যাই হোক এখনো পর্যন্ত আমরা জানি যে, যে দেশ থেকেই যে গুণ-মানের কয়লা আনা হোক না কেন তা জাহাজে করে বঙ্গোপসাগরের নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছানোর পর সেখান থেকে পরিবহনের মাধ্যমে বিদ্যুৎ কেন্দ্রস্থলে নিয়ে আসা হবে। ধারণা করা যায় এ কয়লা সম্পূর্ণটা সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে পশুর নদীর বুক চিরে মংলা বা রামপাল বিদ্যুৎ প্ল্যান্টস্থলে নিয়ে আসা হবে। সুন্দরবন সংশ্লেষ প্রথম উদ্বেগের কারণ এখানে। এ ব্যাপারে অন্য একটি নৌপথের কথাও ভাবা যেতে পারে। সেটি হচ্ছে প্রায় ৮০/৯০ কি.মি. ঘুরে সুন্দরবনকে এড়িয়ে মোংলা-রামপাল-ঘোষিয়াখালী চ্যানেল ব্যবহার করে কয়লা পরিবহন করার সুযোগ রয়েছে। এ চ্যানেলটির নাব্য বাড়িয়ে এবং চ্যানেলটিকে ভালোভাবে প্রবহমান রাখার জন্য রামপাল-ফয়লা-ডেমা-দড়াটানা এ নৌ-রুটটিকে সচল করে দিলে মোংলা-ঘোষিয়াখালী চ্যানেলের নাব্যের কোনো অভাব হবে না। এতে কয়লা পরিবহন ব্যয় সামান্য একটু বেশি হলেও সুন্দরবন নিয়ে শঙ্কা অনেকটা কেটে যাবে। অথবা মোট কয়লা পরিবহন পরিকল্পনা আংশিক পশুর নদী দিয়ে এবং আংশিক মোংলা-রামপাল-ঘোষিয়াখালী চ্যানেল দিয়ে পরিবহনের বিষয়টিও ভাবা যেতে পারে। তেমনটি হলে কয়লা পরিবহনের ব্যাপারে সুন্দরবনের ওপর চাপ কম হবে। তবে সুন্দরবন রুটটি বাদ রাখতে পারলে সবচেয়ে ভালো হয়। কয়লা পরিবহনের ব্যাপারে এখনো যেহেতু রপ্তানিকারক দেশ ঠিক করা হয়নি সে ক্ষেত্রে ভেবে দেখা দরকার কয়লার গুণ বৈশিষ্ট্য, মান, মূল্য, পরিবহন ব্যয়, প্রাপ্যতা বা সরবরাহ নিশ্চিতকরণ সবকিছু মিলিয়ে ভারত থেকে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য কয়লা আমদানি করার কোনো সুযোগ থাকবে কিনা? তেমনটি থেকে থাকলে জল পরিবহন ব্যতিরেকে রেল পরিবহনের মাধ্যমেও কয়লা পরিবাহিত হতে পারে। ভারতের যেকোনো পয়েন্ট থেকে বিশেষ করে বেনাপোল হয়ে খুলনায় তথা রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রস্থলে কয়লা নিয়ে আসা সহজ এবং সম্ভবত ব্যয় সাশ্রয়ীও। তেমনটি করতে পারলে কয়লা পরিবহনের দিক থেকে সুন্দরবন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার প্রশ্নও উঠবে না।

কয়লা পরিবহনের সময় কয়লার গুঁড়ি ছড়িয়ে পড়াও সুন্দরবন এবং পরিবেশ বিনষ্ট হওয়ার একটি কারণ হতে পারে। যে পথেই কয়লা পরিবাহিত হোক না কেন জাহাজ থেকে বার্জ কিংবা ছোট ভেসেলে কয়লা উঠানো-নামানো এবং পরিবহনের সময় যাতে কয়লা গুঁড়া ছড়িয়ে না পড়ে এটি অবশ্যই নিশ্চিত করা প্রয়োজন। বলা হচ্ছে এসব কয়লা পরিবাহিত হবে কাভার্ড বার্জে। মনে রাখা দরকার আমরা বাংলাদেশের মানুষ পানির কল কিংবা গ্যাসের চুলাটি পর্যন্ত বন্ধ করি না। আমাদের সংস্কৃতিতে বিজ্ঞান-প্রযুক্তির মন-মানসিকতা মজ্জাগতভাবে আজও তৈরি হয়নি। তাই প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে নিরাপত্তা কতটুকু নিশ্চিত করা যাবে সে ভাবনা রয়েই গেছে। কাজেই কয়লার গুঁড়া নদীতে বা সুন্দরবনে বা বায়ুমণ্ডলে যাতে কোনোভাবে ছড়িয়ে পড়তে না পারে সেটি সার্বক্ষণিকভাবে খেয়াল রাখতে হবে।

কয়লা পরিবহনের সময় আরও একটি ঝুঁকি থেকে যাবে। সেটি হচ্ছে কয়লাবাহী ভেসেল নদীতে ডুবে যাওয়া। আমরা সুন্দরবনে শিবসা নদীতে অনেক সময় তেলবাহী ট্যাঙ্কার ডুবে যেতে দেখেছি। সুন্দরবন এলাকায় নদীতে ১২০ প্রজাতির জলজপ্রাণীসহ অসংখ্য অতি ক্ষুদ্র প্রাণীকুল ও নানাবিধ উদ্ভিদের জন্য ভেসেল বা ট্যাঙ্কার ডুবির ফল খুবই ক্ষতিকর। কয়লার বার্জ ডুবে যাওয়ার ব্যাপারে একদল বিজ্ঞানমনস্ক মানুষের অবশ্য একটি ব্যাখ্যা রয়েছে। তাদের মতে কয়লা কাভার্ড ভেসেল বা পরে ইলেক্ট্রো-মেকানিক্যাল কনভেয়ারের সাহায্যে পরিবাহিত হলে পরিবেশগত ঝুঁকি খুবই কম থাকবে বা আদৌ থাকবে না। আমাদের নদীগুলোর বিশেষ করে পশুর নদীর বেড হচ্ছে নরম কাদাযুক্ত। তাই কখনও কয়লাবাহী বার্জ ডুবে গেলেও এ কয়লা মাটির সঙ্গে সহজে মিলিয়ে যাবে। তবে জাহাজ থেকে কয়লা ভেসেলে উঠানো, ভেসেল থেকে বিদ্যুৎ কেন্দ্রস্থলে নামানো এবং প্ল্যান্ট থেকে কয়লা ভেঙে তা কনভেয়ার বেল্টে করে ফার্নেসে প্রেরণের সময় বেশ পরিমাণ কয়লা গুঁড়া আশপাশে ছড়িয়ে পড়বে। এ বিষয়টি সংশ্লিষ্টদের ভেবে দেখতে হবে এবং এই জায়গাগুলোতে কীভাবে পরিবেশ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে তা মানুষকে জানাতে হবে।

কয়লা পরিবাহিত হয়ে বিদ্যুৎ প্ল্যান্টে পৌঁছানোর পর পরবর্তী স্তরটি হবে ফার্নেসে কয়লা পুড়িয়ে তাপ তৈরি করে বাষ্প আকারে তা টারবাইনে রান করিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা। স্টকইয়ার্ড থেকে কয়লা ফার্নেসে দেওয়ার জন্য যখন তা ভাঙা হবে সেসময় প্রচুর কয়লার গুঁড়া তৈরি হবে। এই গুঁড়া যাতে বায়ুমণ্ডলে ছড়িয়ে না পড়ে সে জন্য একটি সায়েন্টিফিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকা জরুরি।

উল্লেখ্য, ফার্নেসে যখন কয়লা পোড়ানো হবে তখন সেখানে সালফিউরিক এবং নাইট্রিক গ্যাস (যাকে বলা হয় ঝড়ীবং এবং ঘড়ীবং) তৈরি হবে। এটি স্থানীয় বাতাস এবং আর্দ্রতা মিশ্রিত এটমোসফিয়ারের সঙ্গে মিশে যাবে। এতে ধঃসড়ংঢ়যবত্ব-এ সালফিউরিক এসিড এবং নাইট্রিক এসিড তৈরি করবে এবং এখান থেকে এসিড বৃষ্টি হতে পারে। খনিজ কয়লায় কার্বন ছাড়াও কিছু পরিমাণ সালফার, নাইট্রেট, আর্সেনিক, মার্কারি, বক্সাইট, লোহা, নিকেল কপার, ক্যালসিয়াম প্রভৃতি উপাদান থাকে। ফার্নেসে কয়লা পোড়ানোর সময় ছোট ছোট পাট্রিকেল তৈরি হয়ে তা বাতাসে ছড়িয়ে পড়লে গাছপালার ক্ষতি হবে এবং মানুষ ও প্রাণীকুলের শ্বাসকষ্ট বেড়ে যাওয়ার কারণ ঘটবে। তবে এসব উপাদান বায়ু অপেক্ষা ভারী বিধায় ছড়িয়ে পড়ার এক-দুই কি. মি. এর মধ্যে মাটি কিংবা পানিতে মিলিয়ে যাবে কিনা কিংবা এতে যতখানি অক্সাইড তৈরি হবে তা কতটুকু ক্ষতিকর কিংবা ক্ষতিকর নয়, ক্ষতিকর হলে কীভাবে মোকাবিলা করা যাবে সে বিষয়টির বৈজ্ঞানিক তথ্য থাকা দরকার। শুনেছি এ ধরনের পলুশনের কারণে ক্ষতির মাত্রা খুব বেশি হওয়ার কথা নয়। আন্তর্জাতিকভাবে এর নিশ্চয়ই একটি স্বীকৃত মাত্রা রয়েছে। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষেত্রে এটি কেমন হবে? মাত্রা বেশি হলে তা কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে এবং একই সঙ্গে কী ধরনের সায়েন্টিফিক সিকিউরিটি নেওয়া হবে এসব প্রশ্নের উত্তর পরিষ্কার হওয়া দরকার। সরকার এবং রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের বিরোধিতাকারীরা সায়েন্টিফিক তথ্য দিয়ে বিষয়গুলো আমাদের জানালে আমরা পরিস্থিতি বুঝতে পারব। বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রক্রিয়ায় পানি ব্যবহার ও গরম পানি শীতল করে তা আবার নদীতে নিঃসরণ করার বিষয়টিও জড়িত। এ লেখাটি তৈরি করার সময় আমি রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের একজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছিলাম। তিনি আমাকে জানিয়েছেন রূপসা নদীতে সবচেয়ে যখন কম পানি প্রবাহ থাকে তার পরিমাণ হচ্ছে প্রতি সেকেন্ডে ৬০০০ কিউবিক ঘনমিটার। বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য এখান থেকে পানি ব্যবহূত হবে মাত্র ০.০৫ শতাংশ। এমন হলে পানির ব্যবহারের দিকটি খুবই কম। গরম পানি শীতলকরণ এবং রিসাইকেলিংয়ের মাধ্যমে আবার নদীতে ফেলে দেওয়ার বিষয়টি সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো তথ্য-উপাত্ত দিয়ে মানুষকে অবহিত করলে ভালো হয়।

প্রত্যেক শিল্পের একটি ক্ষতির দিক থাকে। এখান থেকে পলুশন তৈরি হয়, কিছু মিথেন গ্যাসও ছড়িয়ে পড়ে। এতে মানুষ, প্রাণীকুল এবং পরিবেশের ওপর খানিকটা হলেও ক্ষতিকর প্রভাব সৃষ্টি হয়। আমি কোনো সায়েন্টিস্ট নই। আমার পক্ষে এ প্রকল্পের বৈজ্ঞানিক ও পরিবেশগত বিচার-বিশ্লেষণ দেওয়া সম্ভবও নয়। যদি ধরেও নেই যে, বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণে প্রকল্পস্থল থেকে সুন্দরবন ১৪ কি.মি. দূরে এবং নর্থ লোকেশনে হওয়ায় সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি হবে না এরপরও বিজ্ঞানের বাইরে মানুষের কিন্তু একটি মনোজগৎ আছে। সেখানে মানুষের ভাবনা-দুর্ভাবনা, সুখানুভূতি-দুশ্চিন্তা, স্বস্তি-অস্থিরতা ইত্যাদি সবকিছুই তৈরি হয়। যৌক্তিক কারণেই হোক কিংবা যুক্তি ছাড়াই হোক এদিক থেকে সাধারণ মানুষের মনে সুন্দরবনকে নিয়ে কিন্তু এক ধরনের শঙ্কা রয়ে গেছে। মানুষ মনে করছে বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রয়োজন কিন্তু সুন্দরবনের এত কাছাকাছি প্ল্যান্টটি করা ঠিক হচ্ছে কী হচ্ছে না এই দুর্ভাবনাটিও তাদের রয়েছে। এই মানসিক শঙ্কাটি দূর করার জন্য একটি বিষয় ভাবা যায় কিনা? সেটি হচ্ছে বর্তমান বিদ্যুৎ কেন্দ্রস্থল থেকে প্ল্যান্টের ফার্নেসটি শুধু ৫ থেকে ৬ কি.মি. উত্তরে সরিয়ে নিয়ে বসানো। সে ক্ষেত্রে বর্তমান প্ল্যান্টস্থল থেকে মাটির নিচ দিয়ে একটি টার্নেল তৈরি করা যেতে পারে। সেটি দিয়ে কনভেয়ার বেল্টের সাহায্যে কয়লা এবং অন্যান্য সামগ্রীও ফার্নেস স্থলে প্রেরণ করা সম্ভব হবে। প্ল্যান্টের সবকিছুই থাকবে বর্তমান প্রকল্প স্থলে। শুধু ফার্নেসটি থাকবে প্ল্যান্টস্থল থেকে ৫-৬ কি.মি. দূরে এবং প্ল্যান্টস্থল থেকে ফার্নেসের সব সংযুক্তি থাকবে মাটির নিচের টার্নেল দিয়ে। এতে সুন্দরবন থেকে প্ল্যান্টের দূরত্বের বিষয়টি হয়তো সুরহাও হবে।

প্রকৃতি এবং পরিবেশের ওপর প্রত্যেক শিল্পেরই কিছু না কিছু ক্ষতিকর প্রভাব থাকবেই। আবার এটাও ঠিক যে, মানুষ প্রকৃতিকে ব্যবহার করেই উন্নয়ন এবং সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে, এ ছাড়া অন্য কোনো উপায়ও নেই। আমাদের সবাইকে মিলে রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্পের ফলে সৃষ্ট সম্ভাব্য ক্ষতি এবং উপযোগিতার ভারসাম্য বিন্দু কোথায় পাওয়া যাবে তা খুঁজে বের করতে হবে। এ জন্য কোনো অবস্থায়ই পক্ষগুলোর মধ্যে ‘ডায়ালগ’ বন্ধ করা ঠিক হবে না।

লেখক : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক।

ই- মেইল : [email protected]

সর্বশেষ খবর