বৃহস্পতিবার, ২০ অক্টোবর, ২০১৬ ০০:০০ টা

আরেক শহীদ দিবস

এমাদ উল্লাহ শহিদুল ইসলাম

১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহকে কার্ল মার্কস ভারতবর্ষের প্রথম স্বাধীনতাযুদ্ধ হিসেবে অভিহিত করেছেন। সিপাহি বিপ্লবের প্রেক্ষাপট ছিল গভীর এবং সুদূর অতীতব্যাপী প্রসারিত। একদিনে হঠাৎ সশস্ত্র বিস্ফোরণের ভিত রচিত হয়নি। ১৭৫৭ সালে বাংলা, উড়িষ্যা এবং বিহারের নবাব সিরাজউদ্দৌলা পলাশীর যুদ্ধে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নিকট পরাস্ত, আটক ও শহীদ হলে ইংরেজরা মুর্শিদাবাদের সিংহাসনে পুতুল শাসক হিসেবে মীর জাফর আলী খাঁ-কে অধিষ্ঠিত করে। এর পর থেকে ক্রমান্বয়ে পুরো ভারতে ইংরেজদের প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি পেতে থাকে; একপর্যায়ে তারা দেওয়ানি প্রাপ্ত হয়ে তাদের প্রতিপত্তির ‘বৈধতা’ অর্জন করে। এই প্রক্রিয়ায় ধীরে ধীরে ভারতবর্ষে কোম্পানির শাসন প্রতিষ্ঠা পায়। ব্রিটিশ বেনিয়াদের শাসন অতিদ্রুত দেশীয় কৃষক-প্রজাদের ওপর নির্মম, নিষ্ঠুর, অবর্ণনীয় বর্বরতার স্বরূপে আবির্ভূত হয়। ইউরোপিয়ানদের উপনিবেশিক নির্যাতনের ক্রমবৃদ্ধি সমান্তরালভাবে সাধারণ মানুষের মধ্যে ঘৃণা ও ক্ষোভের সঞ্চারণ ঘটাতে থাকে। ভারতবর্ষের নানা প্রান্তে সূচিত হয় বিচ্ছিন্ন, অসংগঠিত কৃষক বিদ্রোহ ও আন্দোলন; যার মধ্য দিয়ে রচিত হয় প্রথম স্বাধীনতাযুদ্ধের ভিত্তিভূমি। ইতিহাসের এমনি এক গৌরবদীপ্ত সশস্ত্র বিদ্রোহ এবং ভারতবর্ষের স্বাধীনতার ইতিহাসে প্রথম শহীদ হওয়ার ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল সিলেট শহরের শাহী ঈদগাহে। ১৯৮৭ সালে তৎকালীন সিলেট পৌরসভার আতিথ্যে সিলেট শহরে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ ইতিহাস সমিতির অষ্টম জাতীয় ইতিহাস সম্মেলনে ইতিহাসবেত্তা-গবেষকদের আলোচনা, উপস্থাপিত তথ্য ও বক্তব্য থেকে ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম শহীদ দিবস হিসেবে এটি স্বীকৃতি লাভ করেছে। পলাশীযুদ্ধের মাত্র ২৫ বছরের মাথায় ১৭৮২ সালে সংঘটিত হয়েছিল ঐতিহাসিক এ বিদ্রোহ। হিজরি বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী ইতিহাসের সোনালি অথচ বিষাদময় দিনটি ছিল ১০ মহররম। ওইসময় সিলেটের রেসিডেন্ট বা ডিস্ট্রিক্ট কালেক্টর ছিলেন রবার্ট লিন্ডসে। লিন্ডসের সুসজ্জিত বাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন শহরের কুমারপাড়া সংলগ্ন ঝরনারপারের ঐতিহ্যবাহী সৈয়দ পরিবারের সৈয়দ হাদী এবং সৈয়দ মাহদী ভ্রাতৃদ্বয়। লোক ইতিহাসে তারা হাদা মিয়া-মাদা মিয়া নামে খ্যাত। ঝরনারপার সৈয়দ পরিবারের অনেক মুরিদ বা অনুসারী ছিলেন। অনুসারীদের কেবল সিলেট নয়, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ এবং অপরাপর এলাকায় বিস্তৃতি ছিল। প্রতিবছর পবিত্র আশুরা উপলক্ষে বাংলা এবং আসামের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সৈয়দ পরিবারের মুরিদানরা কয়েকদিন পূর্ব থেকে ঝরনারপারে জড়ো হতেন এবং মহররম মাসের দশম দিবসে লাঠি, তাজিয়া, তরবারি ও দেশীয় অস্ত্র সজ্জিত অবস্থায় মোঘল স্থাপনা, পাহাড়ঘেরা শাহী ঈদগাহ ময়দানে সমবেত হয়ে নানা কসরত প্রদর্শন করতেন। এটি ছিল কারবালার শহীদদের আত্মত্যাগ স্মরণে শোকের মাতম ও একই সঙ্গে বঞ্চনা-পরাজয়ের বিরুদ্ধে শৌর্য-বীর্যের মহড়া। সৈয়দ বংশের গদিনশীন পীরজাদা ও তার সহোদর এ ধরনের একটি সশস্ত্র সমাবেশ থেকেই ইংরেজ বাহিনীকে পরাজিত করা সহজতর ভেবে ১০ মহররম বিদ্রোহের তারিখ নির্ধারণ করেছিলেন। কিন্তু পরিতাপের বিষয় বিদ্রোহের পূর্বঘোষণা কৌশলগত দিক থেকে সম্ভবত যথাযথ ছিল না। রবার্ট লিন্ডসে পীরজাদা ভ্রাতৃদ্বয়ের ব্রিটিশবিরোধী মনোভাব সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। তিনি বিদ্রোহের তথ্য গুপ্তচর মাধ্যমে জেনে যান এবং ১০ মহররম অপরাহ্নে ঘোড়ায় চড়ে সশস্ত্র বাহিনী নিয়ে শাহী ঈদগাহ ময়দানে হাজির হলে বিদ্রোহী সৈয়দ হাদী-সৈয়দ মাহদী ভ্রাতৃদ্বয় খোলা তরবারি হাতে এগিয়ে যান ও লিন্ডসে কে আশুরা অনুষ্ঠানের সীমানায় প্রবেশে বাধা প্রদান করেন। লিন্ডসে নিজ অবস্থানে থেকে পীরজাদা ভ্রাতৃদ্বয়ের বিরুদ্ধে ‘আনীত অভিযোগ’  উচ্চারণ করেন ও সমবেত জনতাকে অস্ত্র ত্যাগ করে মাঠ ছেড়ে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ জারি করেন। তত্ক্ষণাত গৌরবময় ইতিহাসের নেতা সৈয়দ ভ্রাতৃদ্বয় ঘৃণাভরে ইংরেজ রেসিডেন্টের নির্দেশ অমান্যক্রমে দৃঢ়চিত্তে ঘোষণা করেন ‘আমরা ফিরিঙ্গি হুকুম মানি না। ... আজই ইংরেজ শাসন খতম হবে।’ এই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে সমাবেশস্থল অগ্নিমূর্তি ধারণ করে। অপরদিকে লিন্ডসে তরবারি হাতে সৈয়দ হাদীকে আক্রমণ করেন।

শুরু হয় আধুনিক সমর বিদ্যায় প্রশিক্ষিত ইংরেজ বাহিনীর বিরুদ্ধে ভারতবর্ষের উত্তর-পূর্ব প্রান্তে দেশপ্রেমিক জনগোষ্ঠীর এক অসমযুদ্ধ। সৈয়দ হাদীর আঘাতের পর আঘাতে রবার্ট লিন্ডসের তরবারি খণ্ডিত হয়ে যায় এবং তিনি ধরাশায়ী হন। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে পেছন থেকে একজন ইংরেজ জমাদার লিন্ডসের হাতে একটি পিস্তল এগিয়ে দিলে লিন্ডসে সঙ্গে সঙ্গে সৈয়দ হাদীকে গুলি করে হত্যা করেন। একইভাবে প্রতিরোধে এগিয়ে আসা  অপর বীর সৈয়দ মাহদীও পিস্তলের গুলিতে শহীদ হন। পীরজাদা ভ্রাতৃদ্বয়ের অনুসারীরা পার্শ্ববর্তী পাহাড়-টিলায় অবস্থান নিয়ে বেনিয়া বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধ চালিয়ে গেলেও বিদ্রোহের দুই নেতা শহীদ হওয়ায় তারা মনোবল হারিয়ে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। পরবর্তী ইতিহাস বিয়োগান্তক এবং কণ্টকাকীর্ণ।

ভারতবর্ষের স্বাধীনতা-বিদ্রোহের সূচনাপর্ব প্রাচীন ও সমসাময়িক হলেও শাহাদাতবরণের দৃষ্টান্ত এটি হচ্ছে প্রথম। ব্রিটিশবিরোধী প্রথম শহীদ হাদী ও শহীদ মাহদীর সমাধি সিলেট নগরীর শাহী ঈদগাহ থেকে অনতিদূরে নয়াসড়ক মিশনারি টিলার পশ্চিম-উত্তরাংশে অনেকটা নিশ্চিহ্ন অবস্থায়  পৌঁছেছে। ত্যাগ ও গৌরবগাথা ঐতিহ্যের স্মারক এই সমাধি দুটি পুনরুদ্ধার, পূর্বউচ্চতায় ফিরিয়ে নেওয়া ও মর্যাদার সঙ্গে সংরক্ষণ করার জন্য সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর, ওয়াকফ্ প্রশাসন এবং সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রতি বিনম্র অনুরোধ।

লেখক : প্রাক্তন সভাপতি, সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতি

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর