কয়েকটি ব্যাংকে টাকা নেই, গ্রাহকরা ক্ষুব্ধ হয়ে ফিরে আসছেন। অনেক ব্যাংকের এলসি গ্যারান্টি দিচ্ছে না বিদেশি ব্যাংকগুলো। অনেক ব্যবসায়ীর নামে দেওয়া হয়েছে হত্যা মামলা। স্থগিত করা হয়েছে অনেক ব্যবসায়ীর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট। ভয়ে অনেক ব্যবসায়ী বিদেশে চলে গেছেন। আত্মগোপনে রয়েছেন আরও অনেক উদ্যোক্তা। বিমানবন্দরে হয়রানির আশঙ্কায় ব্যবসার কাজে বিদেশে যেতে পারছেন না অনেকেই। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে ব্যবসায়ীদের সহযোগিতা না নিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। সবকিছু মিলে চাপে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। ব্যবসাবাণিজ্য ও বিনিয়োগ পরিস্থিতির উন্নতি করতে ব্যবসায়ীদের সহযোগিতার পরামর্শ দিয়েছেন বিশ্লেষকরা। তাঁরা বলেছেন, সরকারের সহযোগী করতে হবে ব্যবসায়ীদের। না হলে নতুন উদ্যোগ কমে যাওয়াসহ ব্যবসায় মন্দা দেখা দিতে পারে। প্রবৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়াসহ মানুষের কর্মসংস্থানের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। এ অবস্থায় ব্যবসায়ীদের ওপর থেকে বহুমুখী চাপ কমাতে হবে। কাটাতে হবে আস্থার সংকট। এ ছাড়া ডলার প্রবাহ সামান্য বাড়লেও সংকট আছে। মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে অব্যাহতভাবে বাড়ছে সুদের হার। ফলে উচ্চ সুদের হারে বিনিয়োগ স্থবিরতা প্রকট হচ্ছে। নিরপরাধ ব্যবসায়ীদের হয়রানিমূলক মামলাসহ বিভিন্ন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তা মহলে আস্থাহীনতা, শঙ্কা, ভয় আর উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ছে। থমকে আছে ব্যবসার প্রসার ও নতুন বিনিয়োগ।
বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘মামলা এবং গ্রেপ্তারে ব্যবসায়ীদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। মামলাগুলো কেউ না কেউ করাচ্ছে। তারা করা, যারা বিগত সময়ে চাঁদা দাবি করে পায়নি অথবা ওই ব্যবসায়ীর সঙ্গে ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব ছিল। সরকারের সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছিল। তদন্ত করে দোষী প্রমাণিত না হলে গ্রেপ্তার হবে না। কিন্তু কয়েকজন ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, আমরা মনে করি এটা অন্যায়।’ তিনি আরও বলেন, ‘এতে ব্যবসায়ীদের কাছে একটা ভুল বার্তা যাচ্ছে। বিদেশি ক্রেতাদের কাছেও যাচ্ছে। ফলে দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। একটা আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। অনেকেই ব্যবসাবাণিজ্য বন্ধ করে বিদেশে চলে যেতে বাধ্য হবেন। এ দেশের ব্যবসাবাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আমরা মনে করি এটা দেশের অর্থনীতিকে ক্ষতি করা হচ্ছে। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া ব্যবসায়ীদের অ্যাকাউন্ট জব্দ করায় সংকট তৈরি হবে।’ বিগত সরকারের আমলে বেশ কয়েকটি ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে কয়েক হাজার কোটি টাকা বেরিয়ে গেছে। এসব ব্যাংকের গ্রাহকরা টাকা তুলতে পারছেন না, ক্ষুব্ধ হয়ে ফিরে আসছেন। এসব ব্যাংকে থাকা শিল্পকারখানার অ্যাকাউন্টে আটকা পড়েছে শত শত কোটি টাকা। বেসরকারি খাতের সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের নেত্রকোনা শাখায় টাকা না পেয়ে গতকাল ফিরে গেছেন অনেক গ্রাহক। তিন দিন আগে গ্রাহকের টাকা দিতে না পেরে তাদের তোপের মুখে কান্নাকাটি করেন সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের আগারগাঁও শাখার ম্যানেজার। দেশে ডলার সরবরাহ বাড়লেও এলসি খুলতে পারছে না বেশ কিছু ব্যাংক। তাদের গ্যারান্টি দিচ্ছে না বিদেশি ব্যাংকগুলো। ‘কান্ট্রি রেটিং’ খারাপ হওয়ায় এবং আন্তর্জাতিক মানদে উন্নীত না হওয়ায় দেশের ব্যাংকগুলোকে ঋণপত্র (এলসি) খুলতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ব্যাংকগুলোর গ্যারান্টির প্রয়োজন হয়। ‘থার্ড পার্টি গ্যারান্টি’ হিসেবে আমদানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর সবচেয়ে বেশি ব্যবসা রয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাতভিত্তিক মাশরেক ব্যাংকের সঙ্গে। মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাবশালী এ ব্যাংক বাংলাদেশের বেশির ভাগ ব্যাংকেরই এলসির গ্যারান্টার হয়। রাজনীতির পাশাপাশি ব্যাংক খাতের অস্থিরতার কারণে ব্যাংকটি দেশের অনেক ব্যাংকেরই ঋণসীমা বন্ধ করে দিয়েছে। ভারত, সিঙ্গাপুর, সৌদি আরব, আমিরাতসহ মধ্যপ্রাচ্যের আরও কিছু ব্যাংক ঋণসীমা কমিয়ে দিয়েছে বলে ব্যাংক নির্বাহীরা জানিয়েছেন। ইউরোপের ব্যাংকগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি ব্যবসা রয়েছে জার্মানির কমার্স ব্যাংকের। এ ব্যাংকও দেশের কিছু ব্যাংকের এলসি নিচ্ছে না। দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা ব্যবসায়ীদের নামে বিভিন্ন স্থানে হয়রানি ও নির্যাতনমূলক হত্যা মামলা হয়েছে। একটি মহল সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে বড় বড় শিল্পগোষ্ঠীর মালিকদের হত্যা মামলায় আসামি করা হয়েছে। অতি উৎসাহী একটি চক্র ব্যবসাবাণিজ্য ও শিল্পে অস্থিরতা তৈরির অপচেষ্টা করে যাচ্ছে। নির্বিচারে মামলায় আসামি করা হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। দেশের বৃহৎ শিল্পকারখানার মালিকদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট স্থগিত ও তলব করা হচ্ছে। স্ত্রী, সন্তানসহ পরিবারের সব সদস্যের ব্যাংক অ্যাকাউন্টের লেনদেন বন্ধ করার পাশাপাশি তলব করে লেনদেনের সব ধরনের তথ্য ও অ্যাকাউন্ট খোলার সব নথি চাওয়া হচ্ছে। এসব কারণে ব্যবসায়ীদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। হয়রানির ভয়ে অনেকেই বিদেশে চলে গেছেন। আত্মগোপনে রয়েছেন অনেকে। এ বিষয়ে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি শামস মাহমুদ গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা লক্ষ্য করছি অনেক ব্যবসায়ীর নামে ভিত্তিহীন মামলা করা হচ্ছে। রাজনীতির সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্কই নেই। ভিত্তিহীন মামলা করা যাবে না সরকারের এমন নির্দেশনার পরও মামলা হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে ব্যবসায়ীরা আস্থা পাবেন না।’ শাশা গার্মেন্টস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামস মাহমুদ আরও বলেন, ‘সব ধরনের ব্যবসায়ীর সঙ্গে সরকারের বসা উচিত। দাওয়াত পাচ্ছেন শীর্ষ চেম্বারের সদস্যরা। রপ্তানিকারক, স্থানীয় ব্যবসায়ী, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা, ছোট ছোট ব্যবসায়ী আছেন। এদের সবার একই সমস্যা না। আলাদাভাবে সবার সমস্যাগুলো জেনে কীভাবে সহায়তা দেওয়া যায় তার জন্য একটি নীতিমালা করা উচিত। অনেক ব্যাংক থেকে তহবিল পাওয়া যাচ্ছে না। বিকল্প কী হতে পারে এগুলো নিয়ে আলোচনা হতে পারে। এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলার স্বাভাবিক পরিস্থিতি, পর্যাপ্ত জ্বালানি ও অর্থায়নের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করতে হবে।