৩ জুন, ২০১৭ ১৪:১৬

স্থবির বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির নানা কলাকৌশল অগ্রাধিকার পেয়েছে

ড. মো. সেলিম উদ্দিন

স্থবির বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির নানা কলাকৌশল অগ্রাধিকার পেয়েছে

২০১৭-১৮ এর মোট ব্যয় প্রাক্কলন হয়েছে ৪,০০২,৬৬ কোটি টাকা, যা সংশোধিত ২০১৬-১৭ থেকে ৮৩,০৯২ বা ২৬.২০ শতাংশ বেশি। একইভাবে মোট রাজস্ব আয় ধরা হয়েছে ২,৮৭,৯৯১ কোটি টাকা, যা সংশোধিত ২০১৬-১৭ অর্থবছর থেকে ৬৯,৪৯১ কোটি টাকা বা ৩১.৮০ শতাংশ বেশি। এছাড়া জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের অধীনে কর রাজস্ব বিগত সংশোধিত বাজেট ২০১৬-১৭ এর ১,৮৫,০০০ কোটি টাকা থেকে ৬৩,১৯০ কোটি টাকা বা ৩৪.১৬ শতাংশ বৃদ্ধি করে এ বছর প্রাক্কলন করা হয়েছে ২,৪৮,১৯০ কোটি টাকা। এডিপিও একইভাবে ৪২,৬৩১ কোটি টাকা বা ৩৮.৫১ শতাংশ বৃদ্ধি করে সংশোধিত বাজেট ২০১৬-১৭ এর ১,১০,৭০০ কোটি টাকা থেকে ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে ১,৫৩,৩৩১ কোটি টাকায় স্থির করা হয়েছে। সার্বিক বিবেচনায় বর্তমান বাজেট অবশ্যই উচ্চবিলাসী এবং বাস্তবায়নের জন্য বিভিন্ন কলাকৌশলসহ প্রসাশনিক ব্যবস্থা অতীতের যেকোন সময় থেকে বেশি নিতে হবে। তবে বাংলাদেশের অপার উন্নয়ন সম্ভাবনা জনগণের প্রত্যাশা, ভোগ ও চাহিদার ক্রমোন্নতি, বর্তমান অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও বিভিন্ন অর্থনৈতিক সূচকের অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ সাপেক্ষে বলা যায় যে, আকার রক্ষণশীল না হওয়াই ভাল। বড় আকারের বাজেটে অনেকে মনে করেন যে, অর্থের অপচয় ও অপব্যবহার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। অর্থ বরাদ্দে উদারতা থাকা ভাল এবং অনেক সময় সফলতাও আসে। তবে অর্থ ব্যবহারে যথেষ্ট সতর্ক থাকা এবং অর্থ অপব্যবহার বা অপচয় রোধকল্পে সচেতনতা-সহ কঠোরতা অবলম্বন করলে এই বাজেট বাস্তবায়ন সম্ভব। বর্তমান অর্থবছরে জিডিপি ৭.২৪ শতাংশ অর্জিত হবে এবং আগামী অর্থবৎসরে ৭.৪ শতাংশ জিডিপির হার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে এবং বাজেট বাস্তবায়নে বাজেট বক্তৃতায় সুনির্দিষ্ট অনেকগুলো প্রস্তাবনা এসেছে। প্রস্তাবনাগুলো সঠিক সময়ে বাস্তবায়িত হলে এই বিশাল আকারের বাজেট বাস্তবে প্রতিফলিত করা সম্ভব। প্রস্তাবনার মধ্যে দক্ষ জনবল সৃষ্টির লক্ষ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ, ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপের ব্যাপারে চলমান নীতি ও জোরদারকরণ, প্রকল্প বাস্তবায়নের দুর্বলতা স্বীকার এবং ব্যবস্থা গ্রহণের পদক্ষেপ, কাঠামো রূপান্তরে বৃহৎ প্রকল্প, অবকাঠামো নির্মাণে অনমনীয় এবং সোচ্চার ইত্যাদি বিষয়গুলো বাজেটের বলিষ্ঠ দিক। 

মোট ব্যয় ৪০০,২৬৬ কোটি টাকার মধ্যে সামাজিক অবকাঠামো খাতে ১,১৭,৩০২ কোটি টাকা (২৯.৩১ শতাংশ), ভৌত অবকাঠামোতে ১,২৭,০৫৯ কোটি টাকা (৩১.৭৪ শতাংশ), সাধারণ সেবা ৯৬,১৮৯ (২৪.০৩ শতাংশ) কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে। বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, স্থানীয় সরকার, বিদ্যুৎ-জ্বালানী ও যোগাযোগ ইত্যাদি খাতগুলোকে বিগত কয়েক বছরের ন্যায় অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। এছাড়াও স্থানীয় শিল্পের সংরক্ষণ এবং রফতানি খাতকে প্রণোদনা দেয়ার চেষ্টা ও রাজস্ব আদায়ে করের আওতা বাড়ানোর উদ্যোগসহ দেশের সার্বিক অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক দিকগুলোকে বাজেটে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। ব্যক্তিখাত ও সরকারী খাতে অব্যাহত বিনিয়োগ প্রসঙ্গ বাজেটে গুরুত্ব পেয়েছে, যা নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি, গ্রামীণ অর্থনৈতিক উন্নয়ন, খাদ্য নিরাপত্তা, পল্লী উন্নয়ন, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়ন ও আর্থিক খাতের উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে। 

বাজেটের দুর্বলতা বা চ্যালেঞ্জ: বিগত কয়েক বছর যাবৎ জাতীয় বাজেট বাস্তবায়নে সরকার অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছেন এবং বাজেট ২০১৭-১৮'ও প্রায়ই একই রকম চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনা আছে। যেমন: রাজস্ব আদায়, অবকাঠামো সমস্যা, স্থবির ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ, যা বর্তমান সংশোধিত অর্থবছর ২০১৬-১৭'তে ২০১৫-১৬- এর তুলনায় বেশি বৃদ্ধি পায়নি। সরকারী ব্যয়ের অগ্রাধিকার ঠিক করা, বাজেট ঘাটতির ব্যবস্থাপনা, বৈদেশিক অর্থসংস্থান, ব্যক্তি খাতে ঋণ, রফতানি বৈচিত্রকরণ, খেলাপী ঋণ এবং সঞ্চয় বিনিয়োগ তারতম্য ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। তবে বাজেটকে সঠিক বাস্তবায়নে সক্ষমতা, প্রস্তাবিত বাজেট বাস্তবায়নের স্বচ্ছ রোডম্যাপ, রাজস্ব আদায়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা, প্রকল্প বাস্তবায়নে গুণগত পরিবর্তন ইত্যাদি বিবেচনায় নিলে বাজেট বাস্তবায়ন অসম্ভব কিছু নয়।   

দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট, ব্যবসা ব্যয় হ্রাস, বৈশ্বিক প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান, অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি এবং দারিদ্র বিমোচনের লক্ষ্যে এই বাজেটে সামাজিক ও ভৌত অবকাঠামো খাতে উল্লেখযোগ্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তবে ব্যয়ের গুণগতমান, বাস্তবায়ন সময়, মোট প্রকল্প ব্যয় ইত্যাদির উপর অধিক গুরুত্বারোপ করে সঠিক ব্যয়ে, সঠিক সময়ে এবং সঠিক গুণে ও মানে প্রকল্প কার্য সমাপ্তের জন্য সঠিক মানদণ্ড নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া প্রকল্প বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান এক দেশ বা অঞ্চলে কেন্দ্রীভূত না করে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের প্রতিষ্ঠান সমূহকে সমসুযোগ প্রদান করলে প্রকল্প বাস্তবায়নে কিছু ঝুঁকি হ্রাস করা যায়। চলমান বৃহৎ প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়নের হার সময় সময় প্রেস ব্রিফিংয়ের মাধ্যমে জনসমক্ষে প্রচারের ব্যবস্থা থাকা উচিত। যেমন: বাংলাদেশ দৈনিক কতটুকু বা কত কিলোমিটার রাস্তা সম এককে (equivalent unit) তৈরি হচ্ছে, দৈনিক কত কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে (সম এককে) ইত্যাদি প্রকাশ করা যেতে পারে। পাশাপাশি সামাজিক ও ভৌত অবকাঠামোর কারণে সুফলগুলো সুস্পষ্ট করা উচিত। এই বাজেটে প্রবৃদ্ধি সঞ্চয়ী বৃহৎ ভৌত ও সামাজিক অবকাঠামোগত প্রকল্পসমূহ এবং স্থবির বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির নানা কলাকৌশল অগ্রাধিকার পেয়েছে।

১৫ শতাংশ মূসক হার: এখন ও রেয়াত, তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার, আইনের পরিপূর্ণ ধারণা এবং বর্তমানে নিবন্ধিত ব্যবসায়ীর উপর অধিক চাপ ইত্যাদি বিষয়গুলো অনেক ব্যবসায়ীকে আতঙ্কিত করে রেখেছে। এই প্রেক্ষিতে মূসকের হার ১০ থেকে ১২ শতাংশ যুক্তিযুক্ত, যা সরকার এখনও সক্রিয় বিবেচনা করতে পারেনি। 

২(৪৮) ধারার কর অব্যাহতি পরিমাণ ৩৬ লাখ থেকে বৃদ্ধি করে মাসিক ৪ লক্ষ করে বাৎসরিক ৪৮ লাখ টাকায় এবং ২(৫৭) ধারার টার্ণওভার করের সীমা ১.৫০ কোটি টাকা থেকে মাসিক ১৫ লক্ষ করে বাৎসরিক ১ কোটি ৮০ লক্ষ টাকা নির্ধারণ করলে ক্ষুদ্র ও মাঝারী ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসা সম্প্রসারণের সুযোগ হবে। তবে যে এসআরও মাধ্যমে ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের আওতায় ব্যবসায়ীদের জন্য টার্ণওভার ট্যাক্স রহিত আছে, সেটি বাতিল করতে হবে এবং টার্ণওভার কর ৪ শতাংশ থেকে কমে ২.২৫ শতাংশে হ্রাস করলে সহনীয় হতে পারে। উল্লেখিত সুপারিশগুলো ক্ষুদ্র ও উদীয়মান ব্যবসায়ীর জন্য ব্যবসা সম্প্রসারণ এবং বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। 

লেখক: অধ্যাপক, হিসাব বিজ্ঞান বিভাগ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং পরিচালক, রূপালী ব্যাংক লিমিটেড

বিডি-প্রতিদিন/০৩ জুন, ২০১৭/মাহবুব/ইয়াসিন পাভেল

সর্বশেষ খবর