বৃহস্পতিবার, ১১ ডিসেম্বর, ২০১৪ ০০:০০ টা

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র

কামাল লোহানী

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র- উনিশশো একাত্তরে বাংলাদেশের তাবৎ মানুষের উজ্জীবন, সাহস ও সার্বিক প্রচারের গণমাধ্যম হিসেবে সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রতিষ্ঠান ছিল। যে কোনো দেশের মুক্তিসংগ্রামে প্রচারযন্ত্রের গুরুত্ব অপরিসীম। সে কারণে তো বটেই, সেই সঙ্গে দুনিয়াজোড়া উৎসুক মানুষেরও সর্বক্ষণ মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে অবগত করাও অপরিহার্য। সেই সূত্রে পূর্ব বাংলার নিপীড়িত-অবহেলিত জনগণের নিরন্তর দুর্ভোগ ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে সুদীর্ঘ লোক-আন্দোলনের বিপুল বিস্ময়কর বিস্ফোরণ হলো উনিশশো একাত্তরের মহান এই মুক্তিযুদ্ধ। আমরা ফিরে পেলাম আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি, যাকে দখল করেছিল পাকিস্তানি দুঃশাসক-দস্যুরা। হিংস্র হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছিল দখলদার সেনাবাহিনী মানুষ হত্যায়। নির্বিচারে মারণযজ্ঞে লাখো শহীদের প্রাণের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি স্বাধীন-সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। বিক্ষুব্ধ জনতার প্রতিরোধের ঐক্য গোটা জনগোষ্ঠীকে একদণ্ডে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল বলে আজ আমরা শত্রুমুক্ত। কিন্তু চক্রান্তের শেষ হয়নি, যা শুরু হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধকালেই।

এই মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছিল বাংলার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বজ্রকণ্ঠে উচ্চারিত ৭ মার্চ ১৯৭১ রেসকোর্স ময়দানের জনসমুদ্রের ঘোষণায় : 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।' তিনি তো নির্দেশ দিয়েছিলেন 'যার যা আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত হও'। আর সেই চূড়ান্ত নির্দেশেই চট্টগ্রামে প্রগতিশীল মুক্তিকামী মানুষ চট্টগ্রাম বেতারের কালুরঘাট ট্রান্সমিটারে সূচনা করেছিলেন 'স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র'। কিন্তু পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বোমা হামলা করে ধ্বংস করে দিল। ভবন ধ্বংস হলেও প্রচারযন্ত্রটি অক্ষুণ্ন ছিল বলে বিপ্লবী বেতার কর্মীদল এক কিলোওয়াট প্রচারযন্ত্রটি তুলে প্রতিবেশী ভারতীয় রাজ্য ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলায় বগাফার জঙ্গলে বসিয়েছিল মাতৃভূমিকে মুক্ত করার চরমযুদ্ধে আত্মনিবেদিত তরুণ সংস্কৃতি সংগঠকরা। কী করে এ তরুণরা এই অসম্ভবকে সাধন করল কোনো সহযোগিতা ছাড়া, তাতে ভারতীয় বেতারকর্তা ও মন্ত্রী বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন।

মুক্তিযুদ্ধের প্রয়োজনে প্রবাসী গণপ্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠিত হলো এবং ১৭ এপ্রিল ১৯৭১ কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে মুক্তিযুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণ করলেন এবং বাংলার মুক্তিযুদ্ধ যখন পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীকে পরাজিত করার চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছতে দৃঢ়সংকল্প তখন মুক্তিযুদ্ধের প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ প্রতিবেশী ভারত সরকারের সহযোগিতা ও আশ্রয় প্রার্থনা করলেন। সেই সঙ্গে তিনি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বেতার মাধ্যমও চাইলেন এবং ভারত সরকার বন্ধুত্বের সহযোগিতায় ৫০ কিলোওয়াট মিডিয়া ওয়েভ ট্রান্সমিটার পেয়ে প্রবাসী সরকারের সিদ্ধান্তে 'স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র' প্রতিষ্ঠিত হলো। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হিসেবে টাঙ্গাইলের এম এ মান্নান তথ্য ও বেতারের দায়িত্বে ছিলেন।

এখানে একটি প্রসঙ্গ উল্লেখ করতে চাই। তা হলো প্রথমে এই বেতার কেন্দ্রটি 'বিপ্লবী বেতার' নাম ধারণ করলেও মেজর জিয়া যখন বঙ্গবন্ধুর নামে 'স্বাধীনতার ঘোষণা' পাঠ করেন তখন 'বিপ্লবী' শব্দটি বাদ দিতে বাধ্য করেন। ফলে 'স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র' হয়ে যায় 'স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র'। এ নামেই প্রবাসী সরকারের পরিচালনাধীনে কলকাতার বালীগঞ্জ সার্কুলার রোডে বেতার কেন্দ্র স্থাপিত হলো। এটি ছিল মন্ত্রীদের বাসস্থান। এটি তারা খালি করে দিলেন বেতারের জন্য। তবে এখানে প্রথমে একটি স্টুডিও স্থাপিত হলো। সেও কেবল রেকর্ডিংয়ের জন্য। পরে আরেকটি হয়েছিল। অবশ্য একে রেকর্ডিং কক্ষ বলাই ভালো। কারণ এখানে প্রোগ্রাম প্রচারিত হতো না। কেবল রেকর্ড করে স্পুলটেপটি বিএসএফের মাধ্যমে পাঠিয়ে দেওয়া হতো ট্রান্সমিটারে, সেটি কলকাতা থেকে সীমান্তের কাছাকাছি ছিল। সেটি কোথায় ছিল সেটা আমরা জানতাম না। এমনকি আমি আজও বলতে পারব না। তা ছিল নিরাপত্তার জন্য কঠোর ব্যবস্থা।

১৯৭১ সালের ২৫ মে কলকাতার বালীগঞ্জ সার্কুলার রোডের একটি দোতলা বাড়িতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ঢাকা থেকে আসা বেতার প্রযোজক আশরাফুর রহমান খান, তাহের সুলতান, শহীদুল ইসলাম, টিএইচ শিকদার সূচনালগ্নে জড়িত ছিলেন। এরা কেউ ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছিলেন না, সবাই প্রোগ্রামের, ফলে রেকর্ডিংয়ের কাজ করতে কিছুটা অসুবিধা হলেও তাহের সুলতান প্রযোজনায় থাকলেও কিছুটা অভিজ্ঞ ছিলেন রেকর্ডিংয়ে। তিনি সংকট দূর করে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র চালু করার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। তিনি অবশ্য পরে বেতারে সক্রিয় ছিলেন না। এর কিছুদিন পরে চট্টগ্রামের সেই বিপ্লবী বন্ধুরা কলকাতা পৌঁছলে, সেখানকার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের টেকনিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট ও অপারেটর সহযোদ্ধারা এ বিভাগকে সামাল দিয়েছেন। সঙ্গে একজন ইঞ্জিনিয়ারও ছিলেন। চট্টগ্রামের এ দলটি নেতৃত্ব দিয়েছেন চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রের স্টাফ আর্টিস্ট বেলাল মোহাম্মদ। সহযোগী ছিলেন আবুল কাশেম সন্দ্বীপ। মোস্তফা আনোয়ার, আবদুল্লাহ আল ফারুক, হাবিবুর রহমান মনি, সৈয়দ আবদুস শাকের, আমিনুর রহমান, রাশেদুল হাসান, শরফুজ্জামান ও রেজাউল করিম চৌধুরী। এদের মধ্যে মনি ও সন্দ্বীপ ছিলেন বেতারবহির্ভূত সংস্কৃতি আন্দোলনের কর্মী। সন্দ্বীপ তখন একটি কলেজের উপাধ্যক্ষ। এদের সময়ে সর্বশেষ দর্শনের দলটি গঠিত হয়েছিল এবং এরাও কলকাতায় বেতার কেন্দ্র চালু হওয়ার আগ পর্যন্ত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রচারকার্য অব্যাহত রেখেছিলেন। তখন প্রক্ষেপণ সীমানা খুবই সীমিত থাকলেও দেশবাসী এটি চালু হয়েছে জানতে পেরে নানাভাবে এটি শোনার চেষ্টা করেছেন, তবে খুবই সন্তর্পণে। না হলে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও স্থানীয় আড়তদার ভয় সর্বক্ষণই ছিল। তারপরও মানুষ লুকিয়ে এই প্রচার ধরার চেষ্টা করতেন। আতঙ্কিত জীবনে উদ্বেগাকুল জনগণকে এই বেতার প্রচারই তখন বাঁচানোর তাগিদ এবং লড়াইয়ে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। অথচ এ উদ্যোগ ছিল কতিপয় সংস্কৃতির সঙ্গে প্রগতিমনা বেতার কর্মীদের যৌথ উদ্যোগ। তারা তাদের মেধা ও মনন দিয়ে বুঝতে পেরেছিলেন বলেই সেদিন এই অভিজ্ঞতা প্রয়োগ করেছিলেন এই বিপ্লবী অপরিহার্য প্রয়াসে।

মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় ফ্রন্ট হিসেবে চিহ্নিত এই বেতার যখন কলকাতা থেকে প্রবাসী সরকারের তত্ত্বাবধানে শুরু হলো, তখন ক্রমশ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, সিলেট ও রংপুর থেকে রেডিও পাকিস্তানের সচেতন ও দেশপ্রেমিক কর্মী-কলাকুশলী এবং শিল্পী-সাহিত্যিকরা জড়ো হতে থাকলেন। এলেন সাংবাদিক, শিক্ষক, গীতিকার, সুরকারসহ নানা ধরনের মানুষ। এদের মধ্যে অনেকেই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যোগ দিয়েছিলেন। এই কেন্দ্রটি প্রথমে প্রভাতি ও সান্ধ্য অধিবেশন চালু করে, পরে দুপুরেও একটি স্বল্পকালীন অধিবেশন সংযোজিত হয়েছিল। প্রাথমিক পর্যায়ে বাংলা এবং ইংরেজি ভাষায় সংবাদ ও অনুষ্ঠানমালা প্রচার করা হতো। পরে উর্দুতেও অনুষ্ঠান করা শুরু হয়েছিল জাহিদ সিদ্দিকীকে পাওয়ার পর। ইংরেজিতে আলমগীর কবীর, আলী যাকের, পারভীন হোসেন, নাসরিন আহমদ শীলু প্রধানত জড়িত ছিলেন। বাংলাতে সবচেয়ে জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ছিল 'চরমপত্র', এটি রচনা ও পাঠ করতেন এমআর আখতার। এরপর জল্লাদের দরবার নাটক। নাট্যকার কল্যাণ মিত্রের লেখা ও অভিনেতা রাজু আহমদের পরিচালনায় প্রচারিত হতো। হাসান ইমাম এ বিভাগের প্রযোজক ছিলেন। তা ছাড়া নানা শব্দসৈনিক নিজেদের লেখা গান, কবিতা, কথিকা, জীবন্তিকা লিখে প্রচারকার্যকে বেগবান, হৃদয়গ্রাহী ও প্রেরণাদায়ক করেছেন। ইসলামের আলোকে মুক্তিযুদ্ধ, নিয়মিত কোরআন পাঠ, অগি্নশিখা, পিণ্ডির প্রলাপ, বজ্র রণাঙ্গনের চিঠি, পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিতে, দর্পণ, যে যেভাবে পেরেছেন অংশগ্রহণ করেছেন। এ ছাড়া ছিল সংবাদ বিভাগ। বাংলা, ইংরেজি ও উর্দু সংবাদ পাঠ করতেন সংশ্লিষ্ট সহযোদ্ধারাই। একবার সারা পশ্চিম বঙ্গে বন্ধ হলো ৭২ ঘণ্টা। তিন দিন কি করে স্বাধীন বাংলা বেতারের অনুষ্ঠান চালানো যাবে, সেটাই ছিল দুশ্চিন্তা। অথচ বেতার সম্প্রচার বন্ধ করাও যাবে না তাহলে মুক্তিসেনা ছাড়াও অবরুদ্ধ বাংলার অগণিত মানুষের প্রাণপণ যুদ্ধের মারাত্মক ক্ষতি হবে এবং মানুষের মনোবল ভেঙে পড়বে। আবার নিরাপত্তার কারণে ট্রান্সমিটার ভবনে কাউকে যেতেও দেওয়া হবে না। গান কথিকা নাটক এসব তো রেকর্ডেড, এগুলো তিন দিন আগেই পাঠিয়ে দেওয়া যাবে কিন্তু সংবাদ তো প্রাত্যহিক ব্যাপার। যুদ্ধ জয়ের, মুক্তিযুদ্ধের সফলতার খবর থাকে তাতে। কি করা যায়? তখন বুদ্ধি বের করা হলো, মুক্তিসেনাদের কাছ থেকে পাওয়া সম্ভাব্য আক্রমণ, ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে পাওয়া একটি 'ছক' থেকে ধারণা নিয়ে তিন দিনের তিন ভাষায় প্রতিদিন তিন অধিবেশনের ২৭টি সংবাদ বুলেটিন আগাম তৈরি করে পাঠিয়েছিলাম আমরা। ভাবতে অবাক লাগে, কী করে সম্ভব হয়েছিল?... পশ্চিমবঙ্গে তখন বন্ধ মানে কাকপক্ষীও রাস্তায় বেরোয় না। আমরা যেমন হরতাল প্রত্যক্ষ করে তেমনটি নয়। ... যাই হোক, সংবাদ ছিল বেতারের প্রাণ এবং মুক্তিসেনাদের সাহসী রসদ। নেতাদের কেউ কেউ এক সময় আমাদের বললেন, আজ দুটো ট্রান্সজিসটার মনিটর করবেন। কিছু একটা হবে হয়তো। কিছু একটা অর্থ 'কনফেডারেশন চক্রান্ত'। আমরা তো মিত্র বাহিনীর প্রধান জেনারেল অরোরার পাকিস্তানি সেনাপতি নিয়াজির সঙ্গে কথোপকথন ধরতে চেষ্টা করেছিলামই। এক সময় পেয়েও গেলাম। জানতে পারলাম ১৬ ডিসেম্বর বেলা ৪টা ৩০ মিনিটে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণ করবে। দিনটি বিজয়ের, গর্বের, গৌরবের। তারপর আমার কাছেও গর্বের, অহংকারের কারণ এই দিনে যে বিশেষ বুলেটিনটি প্রচারিত হয়েছিল তা লেখা এবং পড়ার দায়িত্ব বর্তালো আমার ওপর। সুতরাং দিনটি আমার ব্যক্তিজীবনেও অবিস্মরণীয় হয়ে রইল।

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ভারত সরকারের সহায়তায় গঠিত হলেও লোকবল-সাহায্য আমরা না নিয়ে শরণার্থী বাংলার মানুষ- সবাই মিলেই প্রথাগত নয়, সংগ্রামের বেতার সেদিন পরিচালিত হয়েছিল।

লেখক : স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের বার্তা সম্পাদক

 

 

সর্বশেষ খবর