সিলেট মহানগর ছাত্রদলের সাবেক সহ-প্রচার সম্পাদক ফয়জুল হক রাজুকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন ছাত্রদল নেতা আব্দুর রকিব চৌধুরী। পূর্ব পরিকল্পনা অনুসারে এ হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়। এতে জড়িত ছিলেন ২৬ জন। পুলিশ তাদের সবাইকে অভিযুক্ত করে আদালতে মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করেছে।
আদালতে অভিযোগপত্র দাখিলের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন নগরীর কোতোয়ালী থানার এসআই অনুপ কুমার চৌধুরী।
তিনি বলেন, ‘চলতি মাসের ১২ তারিখ রাজু হত্যা মামলায় অভিযোগপত্র দাখিল করেছি। সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তৈরি করা অভিযোগপত্রে ২৬ জনকে আসামি করা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘অভিযোগপত্রে আব্দুর রকিবকে হত্যার নির্দেশদাতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া দেলোয়ার হোসেন দিনারকেও আসামি করা হয়েছে।’
গত বছরের ১১ আগস্ট সিলেট নগরীর কুমারপাড়ায় ছাত্রদল নেতা ফয়জুল হক রাজুকে কুপিয়ে গুরুতর আহত করা হয়। এ ঘটনায় রাজুর চাচা জেলা যুবলীগের যুগ্ম সম্পাদক দবির আলী বাদী হয়ে ২৩ জনের নামোল্লেখ ও অজ্ঞাত আরও ১০-১৫ জনকে আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলায় সিলেট মহানগর ছাত্রদলের সাবেক সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুর রকিব চৌধুরীকে প্রধান আসামি করা হয়। এছাড়া জেলা ছাত্রদলের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন দিনারকেও আসামি করা হয় মামলায়। হত্যার ঘটনার ৯ মাস পর আদালতে অভিযোগপত্র দিল পুলিশ।
রাজু মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলার শাহারপুরের ফজর আলীর ছেলে। তবে দীর্ঘদিন ধরে সিলেট নগরীতে বসবাস করছিলেন তিনি।
অভিযোগপত্র উল্লেখ করা হয়েছে, ফয়জুল হক রাজু ছিলেন আব্দুর রকিব চৌধুরী ঘনিষ্ঠ কর্মী। নগরীর উপ-শহরে ছাত্রদলের কার্যক্রমে সক্রিয় ছিলেন তিনি। এর ফলে তার গ্রহণযোগ্যতা বাড়তে থাকে। সিলেট জেলা ও মহানগর ছাত্রদলের নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয় ২০১৮ সালের ১৩ জুন। রাজু কমিটিতে কাঙ্ক্ষিত পদ পাননি। ফলে রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় হতে থাকেন তিনি, সরে যান রকিবের গ্রুপ থেকেও। এতে রাজুর ওপর ক্ষিপ্ত হন রকিব।
এরপর জুলাইয়ে সিলেট সিটি করপোরেশ নির্বাচনে জুনিয়র সহকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে আরিফুল হক চৌধুরীর পক্ষে প্রচারণায় সক্রিয় ছিলেন ফয়জুল হক রাজু। কর্মতৎপরতায় আরিফের আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন তিনি। এতে রকিবসহ অন্যরা রাজুর ওপর আরও ক্ষিপ্ত ও ঈর্ষান্বিত হয়ে তাকে হত্যার পরিকল্পনা করেন।
অভিযোগপত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, হত্যাকাণ্ড ঘটনানোর আগেও রাজুকে হত্যার হুমকি দিয়ে আসছিল অভিযুক্তরা। এছাড়া ঘটনার দিন পূর্ব-পরিকল্পনা অনুসারে হত্যায় জড়িতরা একাধিকবার ঘটনাস্থলের আশপাশে আসা-যাওয়া করে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে অভিযোগপত্রে।
অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, রাজু হত্যার নির্দেশদাতা ছিলেন আব্দুর রকিব চৌধুরী। গত বছরের ১১ আগস্ট সিটি নির্বাচনে বিজয় নিশ্চিত হওয়ার পর আরিফুল হক চৌধুরী কুমারপাড়াস্থ নিজ বাসায় নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য দেন। এরপর নেতাকর্মীরা তার বাসা থেকে নিজেদের গন্তব্যে ফিরতে থাকেন। ফয়জুল হক রাজু তার মোটরসাইকেলে (সিলেট-হ-১২-২৩২০) সালাউদ্দিন লিটন ও জাকির হোসেন উজ্জ্বলকে সঙ্গে নিয়ে কুমারপাড়াস্থ প্রধান সড়কে পৌঁছার পরই রকিবের নির্দেশে দেলোয়ার হোসেন দিনার, মোস্তাফিজুর রহমান, এনামুল হক, ফরহাদ হোসেনসহ অন্যান্যরা রামদা, চাপাতি, দা, লোহার রড ইত্যাদি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে রাজুর গতিরোধ করে হামলা চালায়। দেলোয়ার হোসেন দিনার, মোস্তাফিজুর রহমান ও এনামুল হকরা আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে এলোপাতাড়ি গুলি চালায়।
গুলিতে জাকির হোসেন উজ্জ্বলের শরীরের বিভিন্ন স্থানে জখম হয়। রাজু মোটরসাইকেল থেকে পড়ে গেলে তার মাথার পেছনে কোপ দেন দিনার। মোফাজ্জাল চৌধুরী মুর্শেদ ধারালো চাপাতি দিয়ে রাজুর মাথা লক্ষ্য করে কোপ দিলে সেটি তার ডান কানের উপরে লাগে। মুহিবুর রহমান রাসেল, সৈয়দ আমিরুল হক সলিড, সাদ্দাম হোসেন, শেখ নয়ন, নজরুল ওরফে জুনিয়র নজরুল, জুমেল আহমদ চৌধুরী, ফাহিম আহমদ তোহা, জাবেদ ওরফে ছেচড়া জাবেদ, আরাফাত এলাহী, রুবেল, আলফু, সাহেদ আহমদ, আফজল, কানা রাসেল, মুর্শেদ আলম রাহেল, সুফিয়ান, একরামুল, মামুন আহমদ, জামাল মিয়া ওরফে জালাল ধারালো দা, রামদা ও ছোরা দিয়ে রাজুর শরীরের বিভিন্ন স্থানে কোপায়। এছাড়া রাজুর সঙ্গে থাকা জাকির হোসেন উজ্জ্বল ও সালাউদ্দিন লিটনের ওপরও হামলা চালায় আসামিরা।
আসামিরা রাজুর পকেট থেকে তার মানিব্যাগ ও মোবাইল সেট নিয়ে যায় এবং তার মোটরসাইকেল ভাঙচুর করে। গুরুতর আহত রাজু, উজ্জ্বল ও লিটনকে উপস্থিত লোকজন ওসমানী হাসপাতালে নিয়ে গেলে রাজু চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
অভিযোগপত্রে ২৬ জনকে আসামি করা হয়েছে। মামলার প্রধান আসামি ও প্রধান অভিযুক্ত ছাত্রদল নেতা আব্দুর রকিব চৌধুরী বর্তমানে যুক্তরাজ্যে পলাতক রয়েছেন বলে জানা গেছে।
এদিকে, মামলার এজাহারনামীয় আসামি দক্ষিণ সুরমার লালাবাজারের মরতুজ আলীর ছেলে শাহীন আহমদ (২৪) ও সন্দিগ্ধ আসামি শাহপরানের তেরতনের কয়েস আহমদকে অভিযোগপত্র থেকে অব্যাহতি প্রদান করা হয়েছে।
আদালতে দাখিলকৃত অভিযোগপত্রে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন মামলার বাদী দবির আলী। তিনি বলেন, ‘অভিযোগপত্রে আমরা মোটামুটি সন্তুষ্ট। এখন আমরা চাই, আদালতে মামলার বিচার কাজ যাতে দ্রুত শেষ হয়। অভিযুক্তদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়।’
দবির আলী আরও বলেন, ‘রাজু মেধাবী ছিল। তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। এটি একটি চাঞ্চল্যকর মামলা। এজন্য মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা হলে দ্রুততার সঙ্গে ন্যায়বিচার নিশ্চিত হতে পারে।’
এদিকে, আদালতে দাখিলকৃত অভিযোগপত্রে সিলেট সিটি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীসহ ৫০ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে। আরিফ ২৮নং সাক্ষী। ফৌজধারী কার্যবিধির ১৬১ ধারায় সাক্ষীদের বক্তব্য অভিযোগপত্রে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।
জানা গেছে, গত ১২ মে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিলের পর ১৪ মে সিলেটের অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম তা ‘দেখেছেন’ হিসেবে লিপিবদ্ধ করেন। বর্তমানে অভিযোগপত্রটি শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে।
বিডি প্রতিদিন/২৮ মে, ২০১৯/আরাফাত