ড. আহমদ কায়কাউস প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব থাকা অবস্থাতেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। যেহেতু তিনি মার্কিন নাগরিক, তার মার্কিন পাসপোর্ট রয়েছে এবং তিনি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ, সেই কারণেই ২০২৩ সালে তিনি ওয়াশিংটনে বিশ্বব্যাংকের বিকল্প নির্বাহী পরিচালক হিসেবে যোগদানের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। সেই সময় তিনি শেখ হাসিনাকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, এই সময় ওয়াশিংটনে থাকলে তিনি অনেক কাজ করতে পারবেন। আওয়ামী লীগের পক্ষে লবিং করতে পারবেন এবং সরকারের সুবিধা হবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো ভিন্ন। ২০২৩ সালে চতুর এই আমলা বুঝতে পেরেছিলেন যে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন আসন্ন। কারণ যেভাবে তিনি ব্যাংক লুট করেছেন, অর্থনৈতিক অবস্থা দেউলিয়া বানিয়ে ফেলেছেন, তাতে সরকারের টিকে থাকার কোনো সম্ভাবনা নেই। আর এই কারণেই তিনি নিজে বাঁচার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দেওয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। সেজন্য তিনি প্রথমে সরকারি চাকরি নিয়ে বিশ্বব্যাংকের বিকল্প নির্বাহী পরিচালক হিসেবে যোগদান করেন। সেখানে তিনি বেশি দিন থাকেননি। ২০২৪-এ ডামি নির্বাচনের পর তিনি আর ঝুঁকি নেননি। তিনি বিশ্বব্যাংকের বিকল্প নির্বাহী পরিচালকের পদ থেকে পদত্যাগ করেন। এ সময় ঢাকায় গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়েছিল যে আহমদ কায়কাউস সরকারের মন্ত্রী হচ্ছেন। কিন্তু বাস্তবতা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। চাকরি ছেড়ে দিয়ে আহমদ কায়কাউস মার্কিন লবিস্ট ফার্ম ‘মরান গ্লোবাল স্ট্র্যাটেজিক’-এ যোগদান করেন। মরান গ্লোবাল স্ট্র্যাটেজিক বা এমজিএস সাবেক কংগ্রেসম্যান জেমস জি. মরানের প্রতিষ্ঠিত একটি লবিস্ট ফার্ম। ড. আহমদ কায়কাউস সেখানে কনসালট্যান্ট বা পরামর্শ হিসেবে যোগদান করেন। এমজিএস লবিস্ট ফার্মের যে কাজগুলো রয়েছে, তার মধ্যে একটি বড় কাজ হলো বিভিন্ন দেশের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য লবিং করা। এই ফার্মটির মাধ্যমে বহু দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন এবং স্বার্থ রক্ষার কাজ করে থাকে।
প্রভাবশালী এই মার্কিন নীতিনির্ধারক লবিস্ট ফার্মে পরামর্শক হিসেবে যোগদানের পিছনে রয়েছে অর্থ বিনিয়োগ। নিউইয়র্কের শেয়ার মার্কেটের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায় মরান গ্লোবাল স্ট্র্যাটেজিক বা এমজিএস-তে বেশ কিছু শেয়ার কিনেছেন ড. আহমদ কায়কাউস। এখান থেকেই বেরিয়ে আসে ড. কায়কাউসের বিদেশে অর্থ পাচারের পদ্ধতি এবং সূত্র। অন্য অর্থ পাচারকারীরা যেভাবে বিদেশে অর্থ পাচার করেছে, আহমদ কায়কাউস সেভাবে অর্থ পাচার করেনি। তিনি অর্থ পাচার করেছেন অভিনব কায়দায়। এই অভিনব কায়দাটি নিরাপদে অর্থ পাচার এবং তা বিদেশে বিনিয়োগের একটি নতুন আবিষ্কার। প্রথমত, আহমদ কায়কাউস এই অর্থ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন কোম্পানিতে তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে বিনিয়োগ করেছেন। স্ত্রী এবং কন্যার নামে ছোট ছোট শেয়ার কিনেছেন। যে বিনিয়োগগুলো তিনি বিভিন্ন তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে করেছেন, সেই বিনিয়োগগুলোকে তার স্ত্রী এবং কন্যার নামে হস্তান্তর করিয়েছেন। পরবর্তীতে সবগুলো শেয়ারকে তিনি আবার বিক্রি করে নতুন নতুন কনসাল্টিং ফার্ম এবং কোম্পানি করেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ড. আহমদ কায়কাউসের পরিবারের লোকজনের অন্তত ১২টি কোম্পানির সন্ধান পাওয়া গেছে। এসব কোম্পানির মধ্যে অন্তত পাঁচটি কোম্পানির সঙ্গে সরাসরি আহমদ কায়কাউসের পরিবার অর্থাৎ তার স্ত্রী এবং কন্যা জড়িত। যার মধ্যে তিনটি কোম্পানি শেয়ার সংক্রান্ত কোম্পানি।
আহমদ কায়কাউস অর্থ পাচারের কৌশলটি এরকম। প্রথমে তিনি একটি বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে কমিশনের লেনদেন চূড়ান্ত করেছেন। ওই বিদেশি কোম্পানিটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বা কানাডায় তাদের শাখায় বা সহযোগী প্রতিষ্ঠানে কমিশনের অর্থ পাঠিয়েছেন। ওই অর্থ সরাসরি গ্রহণ না করে সেটি শেয়ার হিসেবে তৃতীয় কোনো পক্ষের কাছে দিয়েছেন। তৃতীয় পক্ষ এই শেয়ারটি পরবর্তীতে আহমদ কায়কাউসের স্ত্রী এবং কন্যাকে উপহার হিসেবে দিয়েছেন। এই শেয়ার হাত বদল হয়েছে খুব ধীর গতিতে, সময় নিয়ে। সবগুলো শেয়ার একসঙ্গে যখন করা হয়েছে, তখন তারা আবার একটি নতুন কনসালট্যান্ট কোম্পানি করেছেন কায়কাউসের নিজস্ব লোকজন। সেই কনসালট্যান্ট কোম্পানির মাধ্যমে শেয়ার বেচাকেনার ব্যবসা করেছেন। এই শেয়ারের লভ্যাংশের টাকা দেখিয়ে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন সম্পদ গড়েছেন। যার ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ড. আহমদ কায়কাউসের অর্থ পাচারের বিষয়টি খুঁজে বের করা অত্যন্ত দুঃসাধ্য এবং কঠিন ব্যাপার।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আইন অনুযায়ী যে কোনো ব্যক্তি অপর ব্যক্তিকে, যিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক, তাকে তিনি শেয়ার দান কিংবা উপহার দিতে পারেন। শেয়ার হস্তান্তরের ক্ষেত্রে বাজার মূল্য ওঠানামা করলেও একজন ব্যক্তি পর্যায়ে শেয়ার একজন আরেকজনের কাছে হস্তান্তর করলে বাজার মূল্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য না রাখলেও চলবে। ধরা যাক, একটি কোম্পানির শেয়ারের দাম হলো ১০ ডলার। সেই শেয়ারটি এক ডলারেও একজন ব্যক্তিগত ভাবে আরেকজনের কাছে বিক্রি করতে পারবে, অথবা চাইলে তিনি উপহার হিসেবেও দিতে পারেন, কিংবা বিনিয়োগের জন্য রাখতে পারেন। অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্তত চারটি তেল গ্যাস কোম্পানির শেয়ার কিনেছেন আহমদ কায়কাউসের স্ত্রী এবং কন্যা। এসব কোম্পানির মধ্যে এক্সনমোবিল এবং শেভরন করপোরেশন অন্যতম। এই দুটি কোম্পানির শেয়ার কেনার মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ারবাজারে আহমদ কায়কাউসের অনুপ্রবেশ ঘটেছিল। আদানির সঙ্গে যখন চুক্তি হয় তখন আদানিকে ৪ হাজার কোটি টাকার শুল্ক মওকুফ করিয়ে দেওয়া হয়। এই শুল্ক মওকুফ করিয়ে দেওয়ার প্রেক্ষাপটে আদানি কায়কাউসের জন্য বরাদ্দ কমিশনের টাকা দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শেয়ার ক্রয় করে। এই শেয়ারটি আহমদ কায়কাউসের একজন ঘনিষ্ঠ জুবায়ের আহমেদ নামে একজন ব্যক্তিকে হস্তান্তর করা হয়। জুবায়ের আহমেদ চট্টগ্রামের একজন বাসিন্দা, যিনি দীর্ঘদিন ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করেন। আহমদ কায়কাউস যখন শিক্ষা ছুটি নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করেছিলেন, তখন এই জুবায়ের আহমেদের বাড়িতে তিনি প্রথমে অবস্থান করেছিলেন। জুবায়ের পরবর্তীতে এই শেয়ার ড. আহমদ কায়কাউসের মেয়ের জন্মদিনে উপহার দেন।
লক্ষণীয় ব্যাপার যে আদানি গ্রুপের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ আছে। সেই বিনিয়োগ থেকে একটি অংশ দিয়ে বিভিন্ন শেয়ার মার্কেটের শেয়ার কেনা হয়। সেটি নাম মাত্র মূল্যে জুবায়ের আহমদের কাছে দেওয়া হয়। জুবায়ের আহমেদ পরবর্তীতে আহমদ কায়কাউসের কন্যার কাছে আবার এই শেয়ার হস্তান্তর করেন। আহমদ কায়কাউসের কন্যার জন্মদিনে ১০০ কোটি টাকা মূল্যের শেয়ার তিনি উপঢৌকন দিয়েছিলেন। যেহেতু শেয়ারের লেনদেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে খুবই বৈধ এবং যে কেউ, যে কাউকে শেয়ার দিতে পারে, কাজেই এটি আইনের দৃষ্টিতে কোনো অপরাধ নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যদি কেউ বড় স্থাপনা করে, কেউ যদি বাড়ি ঘর দালান কোঠা বানায় সেক্ষেত্রে আয়ের উৎস সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়া হয়। কিন্তু যখন কেউ শেয়ার মার্কেটে বিনিয়োগ করে এবং একজন আরেকজনের কাছে শেয়ার বিক্রি করে বা উপহার দেয় সেটি সন্দেহের চোখে দেখা হয় না। আর এভাবেই আহমদ কায়কাউস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তার সম্পদ বিনিয়োগ করেছেন। হিসাব করে দেখা গেছে, মার্কেট যুক্তরাষ্ট্রে শেয়ারবাজারে বিভিন্ন কোম্পানিতে তার ১ হাজার কোটি টাকার শেয়ার রয়েছে। যে শেয়ারগুলোর বাজার মূল্য এখন ১২ থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই শেয়ারের সূত্র ধরেই কানাডার স্টক এক্সচেঞ্জ, হংকং স্টক এক্সচেঞ্জসহ বিভিন্ন দেশের শেয়ার মার্কেটে বিনিয়োগ করেছেন আহমদ কায়কাউস।
শুধু শেয়ার মার্কেটে বিনিয়োগ করেই তিনি সন্তুষ্ট থাকবেন এমন লোক নন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তার অবৈধ অর্থকে বৈধ করার জন্য তিনি বারোটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এই কোম্পানিগুলো কনসাল্টিং ফার্ম। মজার ব্যাপার হলো যে কোম্পানিগুলো তিনি প্রতিষ্ঠিত করছেন, সেই প্রত্যেকটি কোম্পানি বাংলাদেশের বিভিন্ন রকম কোম্পানির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। যেমন ‘কে কে কনসাল্টিং’ আহমদ কায়কাউসের স্ত্রীর নামে প্রতিষ্ঠিত একটি মার্কিন কোম্পানি। যেটি বাংলাদেশের পাওয়ার টেকের পরামর্শক হিসেবে কাজ করে। আবার ‘কে কে’ সামিট গ্রুপেরও পরামর্শ হিসেবে দুটি প্রকল্পে কাজ করেছে বলে তথ্যাদি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়। এভাবেই আহমদ কায়কাউস অভিনব পদ্ধতিতে অর্থ পাচার করেছেন। আবিষ্কার করেছেন কালো টাকা সাদা করার নিত্য নতুন ফর্মুলা।
অর্থ পাচারের ব্যাপারে অনুসন্ধান করা একজন বিশেষজ্ঞ বলেছেন, অন্যদের অর্থ পাচারের সঙ্গে আহমদ কায়কাউসের অর্থ পাচারের মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। অন্যদের অর্থ পাচার যেমন দৃশ্যমান। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নাগরিকত্ব অর্জন করে একের পর এক বাড়ি ফিরেছেন। আহমদ কায়কাউসের ক্ষেত্রে ঠিক সেরকম ঘটেনি। বরং তিনি প্রথমে শেয়ার মার্কেটে বিনিয়োগ করেছেন। শেয়ার মার্কেট থেকে লভ্যাংশ তৈরি করেছেন। লভ্যাংশ তৈরি করে তিনি বাড়িঘর করেছেন। মার্কেট যুক্তরাষ্ট্রে তার ৮টি সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে। প্রত্যেকটি সম্পদের আর্থিক উৎস হলো শেয়ার মার্কেটের বিনিয়োগ থেকে উপার্জিত অর্থ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডালাসে আহমদ কায়কাউসের দুটি বাড়ির সন্ধান পাওয়া গেছে। এ ছাড়াও টেক্সাসের অস্টিনে আহমদ কায়কাউসের স্ত্রীর একটি ফ্ল্যাট রয়েছে। নিউইয়র্কে আহমদ কায়কাউস একটি বাড়ি কিনেছেন। বাড়ি কিনেছেন তিনি যুক্তরাষ্ট্রের লং আইল্যান্ডে। সর্বশেষ তিনি ওয়াশিংটনে একটি বিলাশ বহুল বাংলো কিনেছেন, যেখানে তিনি এখন অবস্থান করছেন। আহমদ কায়কাউসের বাকি বাড়িগুলো সব ভাড়া দেওয়া হয়েছে। প্রাথমিক হিসাব পর্যালোচনা করে দেখা যায় আহমদ কায়কাউস এসব বাড়ি ঘর কেনায় বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ১২০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন। সবকিছু মিলিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তার প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে বলে জানা গেছে। তবে দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বলছে, এই সম্পদের পরিমাণ আরও বেশি। বেশ কিছু সম্পদ রয়েছে বেনামে। যে সম্পদগুলোর সঙ্গে আহমদ কায়কাউসের সংশ্লিষ্টতা খুঁজে বের করা কঠিন।