আকাশ থেকে মুষলধারে বৃষ্টি ঝরছে। বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলে নদীতে বাড়ছে পানি। এতে সিলেটে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। সিলেটজুড়ে এমন দুর্যোগে বাড়ছে দুর্ভোগ। সিলেটে এর আগে এতো বড় দুর্যোগ কখনো নেমে আসেনি। একসঙ্গে পুরো জেলার মানুষকেও দুর্ভোগ পোহাতে হয়নি। প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়েও শেষ পর্যন্ত কুমারগাঁওয়ের বিদ্যুতের গ্রিড উপকেন্দ্রটি সচল রাখা সম্ভব হয়নি।
বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভেতরে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় বন্ধ করে দিতে হয়েছে গ্রিডলাইন। ফলে দুপুর সোয়া ১২টা থেকে পুরো সিলেট জেলা অন্ধকারে রয়েছে। শনিবার সকাল থেকে সেনাবাহিনীর সঙ্গে নৌবাহিনীর সদস্যরাও উদ্ধার কাজে নেমেছেন। নৌকা সংকটের কারণে বেসরকারি উদ্যোগে উদ্ধার ও ত্রাণ কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।
শুক্রবার সন্ধ্যা থেকে সিলেটের সবকটি নদনদীর পানি কিছুটা কমতে শুরু করে। ফলে গোয়াইনঘাট, কোম্পানিগঞ্জ, জৈন্তাপুর, কানাইঘাট ও সদর উপজেলায় বন্যার পানিও কমতে শুরু করে। তবে সিলেট নগরীতে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত ছিল। কিন্তু শুক্রবার শেষ রাত থেকে মুষলধারে বৃষ্টিপাত শুরু হলে হু হু করে বাড়তে থাকে পানি। পানি বৃদ্ধি পেয়ে বন্যা পরিস্থিতিরও চরম অবনতি ঘটে। বিশেষ করে সিলেট নগরীর প্রায় পুরোটাই পানিতে তলিয়ে যায়। পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়ে নগরের উঁচু এলাকার বাড়িঘর ও দোকানপাটে পানি ঢুকে পড়ে। দুপুর ১২টার দিকে পানি কিছুটা নামলেও সুরমা নদী তীরবর্তী নগরের এলাকাগুলোতে বন্যা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটেছে। নতুন করে নগরের বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। প্লাবিত এলাকার লোকজনও পড়েছেন বিপাকে।
রাস্তাঘাট কয়েক ফুট পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় পানিবন্দী মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ারও সুযোগ পাচ্ছেন না। অনেককে যোগাযোগের জন্য প্লাস্টিকের নৌকা কিনে নিয়ে যেতে দেখা গেছে। সুরমায় পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় যেসব বাসাবাড়ির নিচ পর্যন্ত পানি চলে গেছে তারাও রয়েছেন আতঙ্কের মধ্যে। রাতের মধ্যে বাসার ভেতর পানি উঠে যাওয়ার আতঙ্কে রয়েছেন তারা।
বন্যার কারণে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। আগের দিন সেনা সদস্যরা প্রাণান্তর চেষ্টা চালিয়ে কুমারগাঁও ১৩৩/৩২ কেভি গ্রিড উপকেন্দ্রটি সচল রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। বিদ্যুৎকেন্দ্রের চারদিকে বালু, পাথর ও মাটির বস্তা ফেলে ভেতর থেকে সেচ দিয়ে পানি কিছুটা কমিয়ে বিদ্যুতের গ্রিড উপকেন্দ্রটি সচল রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন।
কিন্তু শুক্রবার শেষ রাত থেকে ভারীবর্ষণ শুরু হওয়ায় আবারও পানি ঢুকে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা হুমকির মুখে পড়ে। ফলে বাধ্য হয়ে কুমারগাঁও গ্রিড উপকেন্দ্রটি বন্ধ করে দেয় কর্তৃপক্ষ। এতে পুরো সিলেট জেলায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। কেন্দ্রটি পুনরায় চালু করতে সেনাবাহিনী ও বিদ্যুৎবিভাগের লোকজন কাজ করে যাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিউবো) সিলেটের প্রধান প্রকৌশলী আবদুল কাদির।
এদিকে, বিদ্যুৎ না থাকায় গত বৃহস্পতিবার থেকে কোম্পানীগঞ্জ ও গোয়াইনঘাট উপজেলায় মোবাইল নেটওয়ার্কও বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে উদ্ধার কাজও বিঘ্নিত হচ্ছে।
সিলেটের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন জানিয়েছেন, কোম্পানীগঞ্জ থানার নিচতলা পানিতে তলিয়ে গেছে। দোতলায় ওয়ারলেস সরঞ্জামাদি স্থাপন করা হলেও বিদ্যুৎ না থাকায় তা কাজ করছে না। ফলে থানার সঙ্গেও সিলেট থেকে যোগাযোগ করা সম্ভব হচ্ছে না।
শনিবার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. লুৎফর রহমানের নেতৃত্বে জেলা পুলিশের একটি দল কোম্পানীগঞ্জে উদ্ধার কাজে গেছেন বলে জানিয়েছেন পুলিশ সুপার।
এদিকে, শনিবার সকাল থেকে সেনাবাহিনীর পাশাপাশি উদ্ধার কাজে নেমেছে নৌবাহিনীও। সকাল থেকে নৌবাহিনীর ৩৫ জন সদস্য দুটি টিমে ভাগ হয়ে কাজ শুরু করেছেন। সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমান এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন। উদ্ধার কাজে নৌবাহিনীর সদস্যরা নিজস্ব ক্রুজ ও বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টার ব্যবহার করছেন। ৬০ জনের আরেকটি দল এবং আরও ক্রুজ ও হেলিকপ্টার উদ্ধার কাজে যুক্ত হওয়ার কথা রয়েছে।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, নৌবাহিনীর ৩৫ সদস্যের একটি দল শুক্রবার রাতেই সিলেটে এসে পৌঁছায়। শনিবার সকাল থেকে ৩৫ সদস্যের দল কোস্টগার্ডের ১টি ক্রুজ ও বিমানবাহিনীর দুটি হেলিকপ্টার দিয়ে উদ্ধার কাজ শুরু করে। সিলেট সদর উপজেলার জালালাবাদ ইউনিয়নে একটি টিম সকাল থেকে কাজ শুরু করে। আরেকটি টিম কোম্পানীগঞ্জে কাজ শুরু করেছে।
জেলা প্রশাসন সূত্র আরও জানায়, নৌবাহিনীর আরও ৬০ সদস্যের একটি দল সিলেপে এসে পৌঁছানোর কথা রয়েছে। আরও দুটি ক্রুজও উদ্ধার কাজে যোগ দেবে। এর মধ্যে একটি সিলেটে ও অন্যটি সুনামগঞ্জে উদ্ধার কাজে যুক্ত হবে।
গত শুক্রবার থেকে উদ্ধার কাজে যোগ দেওয়া সেনাবাহিনীর ৯টি ইউনিটের ৩টি সিলেটে ও ৫টি সুনামগঞ্জে কাজ করছে। শনিবার দিনভর তারা পানিবন্দী লোকজনকে উদ্ধার করে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে এসেছেন।
এদিকে, পানিতে তলিয়ে গেছে সিলেট রেলওয়ে স্টেশন। এতে প্লাটফর্ম ও রেললাইন পানির নিচে চলে গেছে। ফলে সিলেট রেলওয়ে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
সিলেট রেলওয়ে স্টেশনের ম্যানেজার নুরুল ইসলাম জানান, পানি উঠে যাওয়ায় রেলওয়ে স্টেশন বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। তবে সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার মাইজগাঁও স্টেশন থেকে ঢাকা ও চট্টগ্রামগামী ট্রেন যাতায়াত করবে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে পুনারায় সিলেট স্টেশন চালু করা হবে।
এর আগে গত শুক্রবার বিকাল ৩টা থেকে সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
বিডি প্রতিদিন/জুনাইদ আহমেদ