করোনায় একদিকে বাংলাদেশের মানুষের আয় কমেছে, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে সোনার দাম দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। স্থানীয় সোনা ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেছেন, লাগামহীন দাম বৃদ্ধি এবং সোনার বাজারের অস্থিরতার কারণে স্মরণকালের মধ্যে এখন সোনার অলঙ্কারের ক্রেতা সবচেয়ে কম। তাদের মতে, দেশের বাজারে বর্তমানে সোনার অলঙ্কারের ক্রেতা ৫০ শতাংশ কমে গেছে। সোনার অলঙ্কারের মূল ক্রেতা উচ্চবিত্তরাও এখন পরিমাণে কম সোনা কিনছেন আর মধ্যবত্তি ক্রেতা পরিমাণে খুবই কম। সোনা ব্যবসায়ীরা জানান, করোনা সংক্রমণে বিশ্বের অন্যতম সোনার বাজার ভারতের অর্থনীতি ল-ভ- হয়ে পড়ায় এবং ইসরায়েল-ফিলিস্তিনের যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী সোনার দাম বৃদ্ধি পায়। এর প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশেও। তারা আরও জানান, ভারত বিশ্বের অন্যতম বড় সোনা ক্রেতা। কিন্তু করোনা সংক্রমণ ও লকডাউনের কারণে দেশটির অর্থনীতি ল-ভ- হয়ে গেছে। বিশ্বজুড়ে সোনা কেনাবেচায় ভারতের আছে বিশাল ভূমিকা। কিন্তু ভারতের এ দুরবস্থার প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের সোনার বাজারেও। ফলে সোনার বাজারদর এখন অস্থির। এর সঙ্গে দেশের বাজারে সোনার দাম বৃদ্ধির জন্য ইসরায়েল-ফিলিস্তিনের যুদ্ধও অনেকাংশে দায়ী। ধারণা করা হচ্ছে, ইসরায়েল-ফিলিস্তিনের মধ্যে যুদ্ধবিরতি স্থায়ী এবং ভারতের করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতি কিছুটা ভালো হলে দেশের বাজারে সোনার দাম কমে আসবে। সে ক্ষেত্রে ৫০ থেকে ১০০ ডলার পর্যন্ত দাম কমতে পারে। ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের তথ্যানুযায়ী সাধারণ ভোক্তা পর্যায়ে সোনার কেনাকাটা হয় গয়নাসামগ্রীতে। এ শ্রেণির ক্রেতার কাছে গয়নাসামগ্রীর চাহিদা গত বছরের তুলনায় চলতি বছর কমেছে ১০ শতাংশের বেশি। আবার বৈশ্বিকভাবে সোনার সরবরাহ কমেছে ৩ শতাংশের মতো। বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির সভাপতি এনামুল হক খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘গড়ে দেশের বাজারে এখন ৫০ শতাংশ সোনার অলঙ্কারের ক্রেতা কমে গেছে। মূলত বিগত কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশে ক্রেতারা সোনার অলঙ্কার কম কিনছেন। আর করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরুর পর সোনার অলঙ্কার ক্রেতার হার আশঙ্কাজনক হারে কমতে থাকে। সাধারণত ধনীরা সোনার অলঙ্কার বেশি কিনলেও এখন এই শ্রেণির ক্রেতাও কমে গেছে। আবার পরিমাণে খুব কমসংখ্যক মধ্যবিত্ত শ্রেণির ক্রেতাও স্বল্প পরিমাণে সোনার অলঙ্কার কিনছেন। ব্যবসায়ীরা জানান, মহামারীতে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা কিন্তু থেমে নেই। ঘরোয়াভাবে বিয়ে হচ্ছে। এজন্য মানুষ আগে যেখানে ১০ ভরি সোনার অলঙ্কার কিনত এখন এর বদলে মাত্র ২ ভরি দিয়েই প্রয়োজন মেটাচ্ছে। অর্থাৎ বড় অনুষ্ঠান না হওয়ায় আগের তুলনায় ক্রেতারা সোনার অলঙ্কার কেনাও কমিয়ে দিয়েছে। আবার বড় নকশার সোনার গয়নার বিক্রিও কমে গেছে। নবজাতক সন্তানকে উপহারসহ ছোট পারিবারিক অনুষ্ঠানগুলোয়ও এখন আগের মতো ক্রেতারা আর সোনার অলঙ্কার কিনছে না। ব্যবসায়ীরা বলেন, করোনার কারণে দেশের বাইরে চলাচলে বিধিনিষেধ থাকায় ক্রেতারা এখন সোনার অলঙ্কার দেশ থেকেই কিনছে। দেশের বাইরে থেকে সোনা কেনার সুযোগ থাকলে এখন সোনার বাজারে ৮০ শতাংশ ক্রেতা পাওয়া যেত না। এজন্য ক্রেতারা এখন বাধ্য হয়েই ৫ শতাংশ ভ্যাট দিয়ে হলেও কিছুটা বেশি দামে স্থানীয় বাজার থেকে সোনার অলঙ্কার কিনছে।
সোনা ব্যবসায়ীরা আরও জানান, বিশ্বে বিভিন্ন দেশের দায়িত্বশীল এজেন্ট ও বায়াররা সোনার বাজারের মূল নিয়ন্ত্রক। বিশ্ব যখন স্থিতিশীল থাকে তখন সোনা কেনার প্রতি তাদের চাহিদা কম থাকে। আবার যখনই বিশ্ব সংকটের মুখে পড়ে তখন নিজ দেশের অর্থনীতি স্থিতিশীল রাখতে সংশ্লিষ্ট দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও অনুমোদিত লোকাল এজেন্টরা ক্রেতা সেজে হাজার হাজার কেজি সোনা কিনে মজুদ রাখে। এভাবে সব দেশ যখন একসঙ্গে বিপুল পরিমাণ সোনা কেনে তখন এর দামও বৃদ্ধি পায়।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং অর্থ মন্ত্রনালয় সোনা ব্যবসায়ীদের উত্থাপিত দাবি মেনে নিলে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে দেশের বাজারের সোনার দামে যে পার্থক্য তা কমে আসবে। ব্যবসায়ীদের দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে- পাশের দেশের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ভ্যাটের হার পুনর্নির্ধারণ। ব্যবসায়ীরা ভারতের ৩ শতাংশ ভ্যাটের বিপরীতে বাংলাদেশে দেড় শতাংশ হারে ভ্যাট দিতে চান। এ ছাড়া আমদানি মূল্য ১ হাজার টাকা করতে বলেন। যা বর্তমানে ২ হাজার টাকা। ভারতের তুলনায় বাংলাদেশের উৎপাদন খরচ বেশি হওয়ায় ভারতের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পারা যাচ্ছে না। তারা বলেন, ভারতের সঙ্গে প্রতিযোগিতার জন্য দেশের সোনা ব্যবসায়ীদের সুযোগ দিতে হবে। একই সঙ্গে সোনা আমদানিতে ট্রানজিট জটিলতাও কমাতে হবে।