সোমবার, ৬ মার্চ, ২০২৩ ০০:০০ টা
সীমা অক্সিজেন প্লান্ট

বিস্ফোরণের ২৪ ঘণ্টা পরও জানা যায়নি কারণ

নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম

সীতাকুন্ডের সোনাইছড়ির বিএম ডিপোতে বিস্ফোরণে অর্ধশতাধিক মানুষের প্রাণহানির ঘটনার পরও টনক নড়েনি এখানকার অপরাপর কারখানা মালিক-কর্তৃপক্ষের। নয় মাসের মাথায় আধা কিলোমিটার দূরের সীমা অক্সিজেন প্লান্টে আবারও বিস্ফোরণে কেঁপে উঠেছে সোনাইছড়ি। প্রাণ গেছে ছয়জনের। হাসপাতালের বিছানায় কাতরাচ্ছে ২৫ জনের বেশি। বিস্ফোরণ ঘটনার প্রায় ২৪ ঘণ্টা পরও সঠিক কারণ জানাতে পারেনি কেউ। সীমা অক্সিজেন প্লান্টে বিস্ফোরণের পর স্থানীয়রা বলছেন, সিটি গেট থেকে বাড়বকুন্ড পর্যন্ত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের দুই পাশে জনবহুল এলাকায় অসংখ্য শিল্প-কারখানা, ডিপো, গুদাম আছে। এসব কারখানা ও ডিপোতে নানা জাতের পণ্য রাখা হয়, যেগুলোর মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ পণ্যও আছে। সীমা অক্সিজেন প্লান্টে বিস্ফোরণ বিএম ডিপোর বিস্ফোরণের মতো ভয়ংকর। বিএম ডিপোর বিস্ফোরণের পর যদি নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ ও মালিকরা যথাযথ উদ্যোগ নিতেন, তাহলে দুর্ঘটনা হলেও ক্ষতি কম হতো।

কেমন ক্ষয়ক্ষতি : সীমা অক্সিজেন প্লান্টের অবস্থান খুবই ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায়। বিস্ফোরণে আশপাশের অন্তত ১ বর্গকিলোমিটার এলাকা কেঁপে উঠলেও সৌভাগ্যক্রমে দুর্ঘটনার তুলনায় হতাহতের সংখ্যা কম হয়েছে বলে মনে করেন স্থানীয়রা। ওই কারখানার আশপাশে অন্তত ১০টি ছোট আকারের স্টিল রি-রোলিং মিল, তেল শোধনাগারসহ বেশ কয়েকটি শিল্প-কারখানা আছে। বেশ কিছু বসতবাড়ি আছে। বিস্ফোরণে এসব স্থাপনার ক্ষয়ক্ষতি দৃশ্যমান। টিনশেড ভবনগুলোর টিন উড়ে গেছে। পুরনো ভবনগুলোর দরজা, জানালা, ভবনের কিছু কিছু অংশ খসে পড়েছে। পুরো এলাকার বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। তারগুলো ল-ভ- হয়ে গেছে। আশপাশের কারখানাগুলো উৎপাদন বন্ধ রেখেছে। বিস্ফোরণের পর এ পর্যন্ত ছয়জন মারা গেছেন, ২৫ জন মারাত্মক আহত হয়েছেন। আহতদের অনেকে ঠিকমতো কানে শুনতে পাচ্ছেন না। বেশ কয়েকজনের হাত-পা উড়ে গেছে। তারা মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন। এ ছাড়া কারখানা মালিকের দাবি, তার প্রতিষ্ঠানেরই ৫০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।

কী করছে সরকারি সংস্থাগুলো : গতকাল সকাল ৯টায় ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে বিস্ফোরক অধিদফতরের একটি দল। পরিদর্শন শেষে সংস্থাটির পরিদর্শক তোফাজ্জল হোসেন বলেন, ‘প্লান্ট থেকে একটি কলামের মাধ্যমে সিলিন্ডারে অক্সিজেন ভরা হতো। সেটা বিস্ফোরণের সম্ভাবনা আছে। পরিদর্শনে কার্বন ডাই-অক্সাইড ও নাইট্রোজেনের সিলিন্ডার দেখা গেছে। প্লান্টের চারটি পয়েন্টে সিলিন্ডারে গ্যাস ভরার ব্যবস্থা রয়েছে। সিলিন্ডার বিস্ফোরণের সম্ভাবনা আছে। আমরা বিভিন্ন নমুনা সংগ্রহ করেছি। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর নিশ্চিত হওয়া যাবে।’

প্লান্টে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল কি না তা নিয়ে এখনো পর্যন্ত কেউ নিশ্চিত হতে পারেনি। ফায়ার সার্ভিসের উপসহকারী পরিচালক আবদুল হামিদ মিয়া জানান, তারা দুর্ঘটনাস্থলে বেশ কিছু ফায়ার এস্টেঙ্গুইসার দেখেছেন। তবে পর্যাপ্ত এস্টেইঙ্গুইসার ছিল কি না তা তারা নিশ্চিত নন। তবে প্রতিষ্ঠানটির ফায়ার লাইসেন্স ছিল এবং তারা ফায়ার সেফটি প্লান্ট বাস্তবানের জন্য আবেদন করেছিল বলে জানান তিনি।

এদিকে বিস্ফোরণের কারণ অনুসন্ধান করতে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে গঠিত তদন্ত কমিটি এখনো তদন্তের অগ্রগতি কিছু জানাতে পারেনি। তবে তদন্ত কমিটির সদস্য সীতাকুন্ড থানার ওসি তোফায়েল আহমেদ জানিয়েছেন, ফায়ার সার্ভিস, বিস্ফোরক অধিদফতর, জেলা প্রশাসন ও উপজেলা প্রশাসন এ বিষয়ে কাজ করছে। কারণ উদঘাটন করে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হবে। তবে প্রাথমিক তদন্তে কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব অবহেলার বিষয়টি উঠে এসেছে। যাদের দায়িত্বে অবহেলা ছিল তাদের নাম উল্লেখ করে মামলা করবে পুলিশ।

শ্রমিকদের দাবি : বিস্ফোরণে আহত শ্রমিকদের দাবি, প্লান্টের কম্প্রেশার মেশিনের অতিরিক্ত চাপের কারণে বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন প্লান্টের কম্প্রেশার অপারেটর মো. ওসমান, ফিলিংম্যান আবদুল মোতালেবসহ বেশ কয়েকজন শ্রমিক একই দাবি করেছেন। তাদের দাবি, প্লান্টে তৈরি অক্সিজেন ৮০ কেজির সিলিন্ডারে ভরা হয়। দুর্ঘটনার আগে প্লান্টের কম্প্রেশার মেশিন থেকে অতিরিক্ত অক্সিজেন সিলিন্ডারে রিফিল হতে থাকে। ৮০ কেজি পার হয়ে যাওয়ার কারণে এই বিস্ফোরণ হয়েছে। তবে সংশ্লিষ্টরা শ্রমিকদের এই দাবি পুরোপুরি সমর্থন করেননি।

ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক আবদুল মালেক বলেন, ‘বিস্ফোরণের অনেক কারণ থাকতে পারে। সিলিন্ডার অথবা প্লান্ট বিস্ফোরণ হতে পারে, কম্প্রেশার মেশিনের অতিরিক্ত চাপ থেকেও বিস্ফোরণ হতে পারে। কাজ করছি। নিশ্চিত হয়ে সবাইকে জানাব।’

কারখানা মালিকের ভাষ্য : সীমা অক্সিজেন লিমিটেড সীমা গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান। ১৯৯১ সালে জাহাজ ভাঙা কারখানা দিয়ে এই গ্রুপের ব্যবসা শুরু হয়। এই কোম্পানির এস ট্রেডিং নামের একটি জাহাজ ভাঙা প্রতিষ্ঠান ও সীমা স্টিল রি-রোলিং মিল নামের আরও দুটি প্রতিষ্ঠান আছে। জাহাজ ভাঙার লোহা কাটা ও রি-রোলিং মিলে লোহা গলাতে অক্সিজেনের দরকার। এ কারণে ১৯৯৭ সালে অক্সিজেন কারখানা স্থাপন করেন কোম্পানি মালিক মোহাম্মদ শফি। সীমা অক্সিজেন প্লান্টে প্রতিদিন ৭০০ সিলিন্ডার অক্সিজেন উৎপাদনের সক্ষমতা আছে। তবে বর্তমানে ডলার সংকটে ইস্পাত ও জাহাজ ভাঙা শিল্প কিছুটা ধীরে চলায় অক্সিজেনের চাহিদাও কমে গেছে। সে হিসেবে বর্তমানে ৪০০-৫০০ সিলিন্ডার উৎপাদন করতেন।

কোম্পানি মালিক শফির মৃত্যুর পর তার তিন ছেলে মামুন উদ্দিন, পারভেজ উদ্দিন ও আশরাফ উদ্দিন কোম্পানির দেখাশোনা করতেন। এরমধ্যে মামুন ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বে আছেন। এদের কারও সঙ্গে যোগাযোগ সম্ভব হয়নি। তবে গতকাল বেলা সাড়ে ১১টায় কারখানায় আসেন প্লান্টের ব্যবস্থাপক আবদুল হালীম। এ সময় তিনি দাবি করেন, প্রতিষ্ঠানটির পক্ষে ফায়ার সার্ভিস, বিস্ফোরক পরিদফতরসহ সব সংস্থার ছাড়পত্র, সনদ আছে। অক্সিজেন তৈরির সব ধরনের লাইসেন্স ও দক্ষ জনবল রয়েছে। সিলিন্ডারের মেয়াদ আছে কি না তা নিয়মিত যাচাই করা হয়। সিলিন্ডার পরীক্ষার সব যন্ত্রপাতি রয়েছে। এরপরও কেন দুর্ঘটনা  ঘটেছে তা তিনি বুঝতে পারছেন না বলে জানান। তারা ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিক ও আশপাশের ভবন মালিকদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার আশ্বাস দেন।

 

 

 

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর