বিশ্বব্যাপী নীরব ঘাতকের মতো ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে করোনাভাইরাস। প্রাণঘাতী এই ভাইরাস ইতোমধ্যে ২০৯টি দেশে হানা দিয়েছে। এর থাবায় প্রাণ গেছে লক্ষাধিক মানুষের। আক্রান্ত হয়েছে প্রায় ১৭ লাখ। এর প্রকোপে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে গোটা বিশ্ব।
চীনের উহান থেকে ছড়িয়ে পড়া এই ভাইরাস এখন তাণ্ডব চালাচ্ছে ইরোপের ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স ও বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাষ্ট্র আমেরিকার।
মূলত করোনাভাইরাসের থাবায় পুরোপুরি অসহায় হয়ে পড়েছে এসব দেশ।
এমন অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রে কাজ ও ভিসা হারিয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন চাইনিজরা।
ট্যাঙ চেন- ৩৩ বছর বয়সী এক চীনা তরুণি। কাজ করেন পেনসিলভানিয়ায় একটি সফটওয়্যার কোম্পানিতে। ২০১৪ সালে চীনের জেঝিয়াং প্রদেশ থেক এইচওয়ান-বি ভিসায় যুক্তরাষ্ট্রে আসার পর তার স্বপ্ন এখানে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য গ্রিন-কার্ড পাওয়া। সে হিসেবে কাজও করে যাচ্ছিলেন। যে কোম্পানিতে কাজ করতেন, সেই কোম্পানিও তাকে স্পন্সরসহ প্রয়োজনীয় সব শর্ত পূরণ করে গ্রিন-কার্ড পাইয়ে দিতে সহযোগিতা করবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।
কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে দুর্ভাগ্য এসে ভর করে ট্যাঙ চেন-এর জীবনে। গত মাসের (মার্চ) ১৩ তারিখ বন্ধ করে দেওয়া হয় তার কোম্পানি। চাকরি হারিয়ে ফেলেন চেন। এরপর থেকেই তার প্রতিটি রজনী কাটছে বিনিদ্র। দুঃশ্চিন্তায় গলা দিয়ে খাবারও নিচে নামতে চাচ্ছে না। তার একটাই চিন্তা, কি হবে এখন? যুক্তরাষ্ট্রে থাকতে পারবো তো? থাকতে না পারলে দেশে ফিরবো কিভাবে?
ট্যাঙ চেন-এর চলতি এইচওয়ান-বি ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা এ বছরেরই শেষের দিকে। তার আগেই পেনসিলভানিয়ার ফোর্ট ওয়াশিংটনে যে ট্রাভেল ফার্মে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে তিনি কাজ করতেন, গ্রিন-কার্ড পাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় প্রসেসিংগুলোও শুরু করে দিয়েছিল সেই কোম্পানি।
ট্যাঙ চেন খুবই আত্মবিশ্বাসী ছিলেন, তিনি যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য গ্রিন-কার্ড পেয়ে যাবেন। এমনকি এ লক্ষ্য সামনে রেখে স্বপ্নের দেশ যুক্তরাষ্ট্রে একটি এ্যাপার্টমেন্টও কিনে ফেলেছিলেন তিনি।
কিন্তু ১৩ মার্চ শেষ অফিস করার পর চেন শুধু চাকরিই হারাননি, একই সঙ্গে হারিয়েছেন ভিসা স্ট্যাটাসও। এখন তার সদ্য সাবেক হওয়া কোম্পানির মালিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তার জন্য গ্রিন-কার্ড পাওয়ার যে প্রসেস, সেটা আর এগিয়ে নেবেন না। মালিকের এই সিদ্ধান্তে এখন চোখে অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই দেখছেন না ট্যাঙ। কারণ, তার গ্রিন-কার্ড পাওয়ার সমস্ত সম্ভাবনাই যে এর সঙ্গে শেষ হয়ে গেল!
শুধু ট্যাঙ চেন নয়, এ রকম আরও অনেক চাইনিজ রয়েছেন যারা বর্তমানে চরম অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে জীবন পার করছেন আমেরিকায়।
ট্যাঙ চেন-এর মত যুক্তরাষ্ট্রে যারা চাকরি খুইয়ে এইচওয়ান-বি ভিসার স্ট্যাটাসও হারিয়ে ফেলেছেন, তারা ভিসা স্ট্যাটাস পরিবর্তনের জন্য ৬০ দিন সময় পাবেন। এর মধ্যে তিনি হয়তো ট্যুরিস্ট স্টুডেন্ট ভিসা কিংবা নতুন কোনও মালিক খুঁজে নিয়ে আবারও এইচওয়ান-বি’র জন্য স্পন্সর হিসেবে দেখিয়ে নতুন ভিসা নিতে পারবেন।
যদি কেউ ভিসা স্ট্যাটাস পরিবর্তন করতে না পারেন কিংবা নতুন কোনও চাকরিদাতা খুঁজে বের করতে না পারেন, তাহলে অবশ্যই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তাকে যুক্তরাষ্ট্র ত্যাগ করতে হবে। কিংবা অবৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে অতিরিক্ত থাকতে হবে। এই অতিরিক্ত থাকার সুযোগ পাওয়া যাবে ১৮০ দিন, তথা ৬ মাস। তবে, ভবিষ্যতে তিনি আর হয়তো যুক্তরাষ্ট্রে আসতে পারবে না। কারণ আমেরিকান আইন অনুযায়ী তাদেরকে নিষিদ্ধ করা হবে।
কিন্তু করোনাভাইরাসে যখন পুরো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিপর্যস্ত, তখন নতুন কোনও চাকরিদাতা খুঁজে পাওয়া আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মতই ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ, কোনও চাকরিদাতাই এমন এই পরিস্থিতিতে অতিরিক্ত খরচ কিংবা অতিরিক্ত কাজের ঝুঁকি মাথায় নিতে নারাজ। চাকরি হারানোর পর থেকে অনেক চেষ্টা করেও ট্যাঙ চেন একবারের জন্যও কোথাও ইন্টারভিউ দেওয়ার জন্য ডাক পাননি। করোনাভাইরাসের মহামারী চলাকালীন কোনও চাকরি পাওয়া যাবে কি না, সেটাই অনেক বড় একটি অনিশ্চয়তার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কোনও কিছুই যদি না হয়, তাহলে নিজের দেশ চীনে ফিরে যেতে হবে। কিন্তু এখানেও অনেক বড় এক সমস্যা। আগামী এক-দুই মাসে চীনে ফেরার সরাসরি কোনও ফ্লাইটেই কোনও সিট ফাঁকা নেই। যাওয়া যাবে, অনেকটা লোকাল সার্ভিসের মত, মাল্টি স্টপ বিমানগুলোতে। তাতে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হবে সবচেয়ে বেশি।
সিএনএনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ট্যাঙ চেন বলেন, ‘যদি এখন আমি আমার দেশেও ফিরতে চাই, তাহলেও কোনও টিকিট পাচ্ছি না।’ পরিবর্তে একটাই কাজ করতে পারেন ট্যাঙ, কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করে রাখতে পারেন, যেন অন্তত একটি স্টুডেন্ট ভিসা হলেও ম্যানেজ করে বৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে থাকার ব্যবস্থা করতে পারেন।
বিডি প্রতিদিন/কালাম