পশ্চাৎপদ পাহাড়ি এক জনপদের নাম বান্দরবানের লামা উপজেলা। ৭টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভা নিয়ে গঠিত এই উপজেলায় রয়েছে ১টি ডিগ্রী কলেজ, ১টি ফাজিল মাদ্রাসা, মাধ্যমিক পর্যায়ের ২১টি ও প্রাথমিক পর্যায়ের ১০২টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৪৮ হাজার।
প্রায় ৮১ শতাংশ বাঙ্গালি অধ্যুষিত হলেও রয়েছে মারমা, ত্রিপুরা, চাকমা, তংচংগ্যা জনগোষ্ঠী। এইসব ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের শিশুদের সমাজের মূল স্রোতধারায় সম্পৃক্ত হতে সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন শিক্ষার। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর অনেকের সাথে কথা বলে জানা যায়, দুর্গম জনপদের বসবাসরত উপজাতি-বাঙ্গালী শিশুদের শিক্ষিত হওয়ার প্রবল আগ্রহ থাকলেও জ্ঞান অর্জনে সবচেয়ে বড় বাধা অর্থের। বাড়ির কাছের স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষার গন্ডি পেরিয়ে গেলেও শহরে এসে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ নেই প্রায় ৯৫ শতাংশ মানুষের। যাতে করে অভাবের কষাঘাতে প্রতিনিয়ত ঝরে যাচ্ছে অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী।
লামার বিভিন্ন ইউনিয়নের দুর্গম এলাকার এমনি অনেক মেধাবী শিক্ষার্থীরা যখন অর্থের অভাবে তাদের লেখাপড়া বন্ধ হওয়ার উপক্রম তখন পাশে এসে দাড়াঁলেন প্রচারবিমুখ সুদুর আমেরিকার নিউর্য়ক প্রবাসী বাঙ্গালী দম্পত্তি মিয়া আকবর ও কিটি খন্দকার। তারা দায়িত্ব নিলেন মাতামুহুরী ডিগ্রী কলেজের ৮ জন, লামা আদর্শ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ৩ জন, লামামুখ উচ্চ বিদ্যালয়ের ৭ জন ও গজালিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের ২ জনসহ মোট ২০জন মেধাবী পাহাড়ি বাঙ্গালী শিক্ষার্থীর আজীবন শিক্ষা খরচের।
২০১৭ সালের মার্চ মাস হতে এই শিক্ষার্থীদের নিয়মিত প্রদান করা হচ্ছে যাবতীয় শিক্ষা খরচ। নিশ্চিত ঝরে পড়া ২০ শিক্ষার্থী নতুন করে মানুষ হওয়ার স্বপ্ন দেখা শুরু করেছে। নেই কোন রক্তের বন্ধন শুধু শিক্ষার্থীদের ভালবাসার টানে গত ২১ জানুয়ারী রবিবার ওই দম্পতি আমেরিকা হতে ছুটে এলেন বাংলাদেশে। সরাসরি লামায় এসে এই ২০ শিক্ষার্থীর সাথে দেখা করলেন। এইসময় শিক্ষার্থীদের জন্য আমেরিকা থেকে নিয়ে আসা শিক্ষা উপকরণ (স্কুল ব্যাগ, খাতা, কলম, পেন্সিল, জ্যামিতি বক্স) তাদের হাতে তুলে দেন।
সহায়তা প্রাপ্ত শিক্ষার্থীরা বলেন, এই মহান দুই মানুষের সহায়তা না পেলে আমাদের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যেত। আমাদের অনেকের মা-বাবা নেই এবং দরিদ্র পরিবারের সদস্য আমরা। তাদের পক্ষে আমাদের কলেজে ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়ালেখা করানো সম্ভব ছিলনা। শিক্ষানুরাগী মিয়া আকবর ও কিটি খন্দকার এর মানবিকতার কারণে আমরা মানুষ হতে সুযোগ পেয়েছি।
মিয়া আকবর বলেন, আমি চট্টগ্রাম ফোজদারহাট ক্যাডেট কলেজের ছাত্র ছিলাম। আমি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে রাঙ্গামাটি ১২ বেঙ্গলের অধিনে কর্ণেল হিসেবে চাকরি করে ১৯৮১ সালে অবসরে যাই। পরে পরিবার নিয়ে সুদুর আমেরিকা বসবাস শুরু করি। আমার স্ত্রী কিটি খন্দকার নিউয়র্কের একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের হেড অব একাউন্ট হিসেবে কর্মরত। যত দূরে থাকিনা কেন দেশের প্রতি টান সবসময় থাকে। চাকরির সুবাধে যখন পাহাড়ে কাজ করেছি তখন দেখেছি পাহাড়ি মানুষের মানবেতন জীবন যাত্রা। যা আমাকে আজও ব্যথিত করে। সেই ভালবাসা থেকে সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত অর্থায়নে আমি ও আমার স্ত্রী তাদের জন্য কিছু করার প্রচেষ্টা করছি।
মাতামুহুরী ডিগ্রী কলেজের অধ্যক্ষ মোহাম্মদ রফিুকুল ইসলাম বলেন, আমি এমন মানবতাবাদী মানুষ জীবনে কম দেখেছি। যাদের স্বীকৃতি পাওয়ার কোন চাহিদা নেই। নিবৃত্তে সমাজের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। যতবার আমি ঊনাদের দেখি, ততবার বিবেকের কাছে হেরে যাই। হয়ত আমিও এমনটি করতে পারতাম না।
উপজেলা চেয়ারম্যান থোয়াইনু অং চৌধুরী বলেন, হাজার হাজার মাইল দূরে থেকেও যারা দেশের মানুষকে ভুলে যায়নি তাদের সাথে পরিচিত হতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করছি।
বিডি প্রতিদিন/৩১ জানুয়ারি ২০১৮/হিমেল