শিশু, কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতী, গৃহকর্তা-গৃহবধূ, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা সবাই মার্বেল খেলায় ব্যস্ত। কেউ খেলছেন, কেউ পাশে দাঁড়িয়ে খেলা উপভোগ করছেন। বাড়ির আঙিনা, মাটির রাস্তা, খোলা আকাশের নীচে যেখানেই খালি জায়গা সেখানেই দলে দলে মার্বেল খেলায় মত্ত সবাই। না কোন কল্প কাহিনী নয়, এই দৃশ্য বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার প্রত্যন্ত রামানন্দেরআঁক গ্রামের ২৩৯ বছরের ঐতিহ্যবাহী মার্বেল মেলার।
মার্বেল মেলা নামকরণ হলেও এখানে মার্বেল খেলা এবং খেলাকে কেন্দ্র করে মার্বেল বেঁচাকেনা জমজমাট হয় এদিন। মঙ্গলবার সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এই মার্বেল মেলাকে কেন্দ্র করে রামানন্দের আকসহ আশপাশের গ্রামেও ছড়িয়ে পড়ে উৎসবের আমেজ। দূরদূরান্তে থাকা স্থানীয় বাসিন্দারা ছাড়াও তাদের আত্মিয়-স্বজনরা আসেন মার্বেল মেলায় অংশ নিতে। এ কারণে মার্বেল মেলা পরিণত হয় মিলনমেলায়।
স্থানীয় প্রবীন আশুতোষ দাস জানান, শীত মৌসুমে মাঠ-ঘাট ও সড়ক শুকিয়ে যাওয়ায় তাদের পূর্ব পুরুষরা মার্বেল খেলা শুরু করেন। পরবর্তী প্রজন্মও সেই প্রাচীন ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। দিনে দিনে এই মার্বেল খেলাই মার্বেল মেলায় পরিণত হয়েছে।
বছরের এই দিনটি ঘিরে রামানন্দেরআঁক সহ আশপাশের গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে উৎসবের আমেজ। গ্রামের অধিবাসীরা তাদের মেয়ে জামাতাসহ অন্যান্য নিকট আত্মীয়-স্বজনদের এই মার্বেল মেলায় “মার্বেল খেলার” আমন্ত্রণ জানিয়ে থাকেন। প্রতিটি বাড়ির আত্মীয়-স্বজন ও দর্শনার্থীদের ভিড়ে ওই গ্রাম এখন লোকে লোকারণ্য। বাড়িতে বাড়িতে চিড়া-মুড়ি, খেঁজুর গুড়ের পিঠা খাওয়ার ধুম পরেছে। ঐতিহ্যবাহী এই মেলায় এ বছরও প্রধান আকর্ষণ বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষের মধ্যে মার্বেল খেলার প্রতিযোগীতা।
প্রায় ৫ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বসে মার্বেল খেলার আসর। মেলা জুড়ে ছিল পুুলিশের কঠোর নিরাপত্তা। বিভিন্ন বাড়ির আঙিনা, অনাবাদী জমি, বাগান ছাপিয়ে রাস্তার উপরও বসেছিল মার্বেল খেলার আসর। মার্বেল মেলাকে কেন্দ্র করে ওই এলাকায় বাঁশ ও বেতের শৌখিন শিল্প সামগ্রী, মনিহারী দ্রব্য, খেলনা, মিষ্টি, ফল, চটপটি, ফুঁচকাসহ হরেক রকমের খাদ্যদ্রব্য ও নিত্য প্রয়োজনীয় পন্যের পসরা সাঁজিয়ে বসে দোকানীরা।
গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া থেকে মার্বেল মেলায় এসেছিলেন সমীর বিশ্বাস। তিনি জানান, তারা মার্বেল খেলার দাওয়াত পেয়ে এসেছেন। ব্যতিক্রমধর্মী এই মেলা তাদের খুবই ভাল লাগে। তিনি ছাড়াও মার্বেল খেলায় অংশ নিতে রামানন্দেরআঁক গ্রামে এসেছিলেন কোটালীপাড়া, উজিরপুর, কালকীনি, গৌরনদী সহ বিভিন্ন আশপাশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলার হাজারো মানুষ।
রামানন্দেরআঁক গ্রামের ৮ম শ্রেণীর ছাত্র দিগন্ত বাগচী জানায়, মার্বেল মেলায় মার্বেল খেলার জন্য সারা বছর টাকা জমিয়েছে মার্বেল কেনার জন্য। তার মতো অনেক শিক্ষার্থীই সারা বছর এই দিনটির অপেক্ষায় থাকেন বলে সে জানায়।
মার্বেল মেলা পরিচালনা কমিটির সভাপতি বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক (নিওনেটোলজি) ডা. বিধান চন্দ্র বিশ্বাস ও উপদেষ্টা উপজেলা মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান মলিনা রানী রায় গোসাই বলেন, ওই গ্রামের সোনাই চাঁদ নামে এক শিশুর ৬ বছর বয়সে বিয়ে হয়। বিয়ের এক বছরের ব্যবধানে তার স্বামী মারা যায়। স্বামীর মৃত্যুর পর শ্বশুরবাড়ির নীম গাছের নীচে সোনাই চাঁদ আরাধনা ও পূঁজার্চনা শুরু করায় তার অলৌকিক কর্মকান্ড ছড়িয়ে পরে চারদিকে। সোনাই চাঁদের জীবদ্দশায় তার ভক্তরা ওই বাড়িতে আনুমানিক ১৭৮০খ্রিস্টাব্দে ‘মা সোনাই চাঁদ আউলিয়া মন্দির’ স্থাপন করেন। পঞ্জিকা অনুযায়ী প্রতি বছর পৌষ সংক্রান্তি উপলক্ষে ওই বাড়িতে বৈষ্ণব সেবা, সংকীর্তন ও কবিগানের সাথে চলতো মার্বেল খেলা। ওই থেকেই প্রতি বছর পৌষ সংক্রান্তিতে মার্বেল মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে রামানন্দেরআঁক গ্রামে।
আয়োজকরা জানান, মন্দির প্রতিষ্ঠার পর থেকে ২শ’ ৩৯ বছর ধরে পঞ্জিকানুযায়ি প্রতি বছর পৌষ সংক্রান্তির দিনে বাস্তু পূজা (মাটির পূঁজা) ও নবান্ন মহোৎসবের মাধ্যমে ধুমধামের সাথে এই মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। প্রতিবছর এই দিনে বৈষ্ণব সেবা, হরিনাম সংকীর্তন শেষে সোয়া মণ (৫০ কেজি) চালের গুড়ার সাথে সোয়া মণ গুড়, ৫০ জোড়া (১শ’ পিস) নারকেল ও প্রয়োজনীয় অন্যান্য উপকরণ মিশিয়ে তৈরী করা হয় নবান্ন। মেলায় আগত সকল ভক্ত ও দর্শণার্থীদের মাঝে এই নবান্ন প্রসাদ বিতরণ করা হয়। নবান্ন মহোৎসব আর মারবেল মেলায় উৎসবমুখর হয়ে ওঠে রামানন্দেরআঁক গ্রাম।
আগৈলঝাড়া থানার পরিদর্শক (তদন্ত) নকিব আকরাম জানান, মার্বেল মেলা ও খেলা রামানন্দেরআঁক গ্রামের ঐতিহ্য। প্রতি বছরের ন্যায় এবারও ব্যাপক-উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে মার্বেল মেলা। মেলার উৎসব নির্বিঘ্ন এবং শান্তিপূর্ণ করতে ওই এলাকায় পুলিশ কঠোর নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছে বলে তিনি জানান।
বিডি প্রতিদিন/হিমেল