সুপার সাইক্লোন আম্ফানের ছোবলের ক্ষত নিয়ে কি ঘুরে দাঁড়াতে পারবে সুন্দরবন? বিশ্বে জীববৈচিত্র্যের বৃহত্তম আধার এই ম্যানগ্রোভ বনটি অক্সিজেনের ভান্ডার। এই সংরক্ষিত বনে ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানার পরে তার প্রাণপ্রকৃতি কি অবস্থায় রয়েছে? নিজের বুক পেতে আম্ফানের গতিকে কমিয়ে দিয়ে লোকালয়ের কোটি মানুষের জীবন আবারো বাঁচিয়ে দেয়ার পর সুন্দরবনের বর্তমান অবস্থা জানতে উদগ্রীব দেশ-বিদেশের অনেক মানুষ।
সুন্দরবন নিয়ে কাজ কারা গবেষক ও বন বিভাগ বলছে, সুন্দরবনকে তার মতো করে থাকতে দিলে আগামী ৫ থেকে ৬ মাসের মধ্যে এই বনটি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে। প্রাণ ফিরে পাবে সুন্দরবন।
শুক্রবার বিকালে বন সন্নিহিত এলাকার লোকজনের সাথে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমানে সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশের আয়তন হচ্ছে ৬ হাজার ১৭ বর্গ কিলোমিটার। যা দেশের সংরক্ষিত বনভূমির ৫১ ভাগ। একশ্রেণীর ক্ষমতাবান অসৎ মানুষের কারণে অস্তিত্ব সংকটে থাকা সুন্দরবনের প্রাণপ্রকৃতির কাছে প্রাণঘাতি করোনাভাইরাস ‘আশির্বাদ’ হিসেবে দেখা দেয়।
গত ২৬ মার্চ গোটা সুন্দরবনে সব ধরনের পর্যটকসহ জেলে-বনজীবীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করে সর্বোচ্চ সতর্কতা জারি করে বন অধিদপ্তর। ২৪ ঘন্টায় ২ বার সমুদ্র্রের জোয়ারের পানিতে প্লাবিত এই লবণাক্ত বনভূমিতে সব ধরনের পর্যাটকসহ জেলে-বনজীবীরা না থাকায় ছিলোনা কোন কোলাহল। নির্ভয়ে বনে ঘুরে বেড়াচ্ছে সুন্দরবনে প্রকৃতির পাহারাদার রয়েল বেঙ্গল টাইগার, চিত্রল ও মায়া হরিণসহ সব বন্যপ্রাণী।
বনের কর্মকর্তাসহ বনরক্ষীরা এখন প্রায় প্রতিনিয়তই শুনতে পান বাঘসহ এসব বন্যপ্রাণীর ডাক। সহজেই চোখে পড়ছে বাদরের বাঁদরামী। বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির ইরাবতী ডলফিনসহ ৬ প্রজাতির ডলফিন দল বেঁধে পানির উপরিভাগে খেলা করছে। সহজেই দেখা মিলছে কুমির ও বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির বাটাগুল বাচকা কচ্ছপের। নির্ভয়ে ঘুরে ফিরছে অজগর, কিংকোবরাসহ বিভিন্ন প্রজাতির সাপ। বন মোরগের ডাকে ঘুম ভাঙছে বনের কর্মকর্তাসহ বনরক্ষীদের। বিভিন্ন প্রজাতির পাখিরদের কিচির-মিচির শব্দ করে গাছের এডাল থেকে ওডালে উড়ে ফিরছে। সৃষ্টির পর এই প্রথম যেন সুন্দরবন স্বাভাবিক রূপ ফিরে শুরু করেছিলো। দিনরাত ২৪ ঘন্টায় ৬ বার তার রূপ পাল্টানো সুন্দরবন কোন উপদ্রব ছাড়াই পেয়েছে নতুন প্রাণ। বুধবার রাতে সুপার সাইক্লোন আম্ফানের প্রলংকরী ছোবলের ক্ষতবিক্ষত করলো সুন্দরবনকে।
বাগেরহাটের পূর্ব ও খুলনার পশ্চিম সুন্দরবন বিভাগের ৪টি রেঞ্জের বিভিন্ন ফরেস্ট অফিস, টহল ফাঁড়ির কর্মকর্তারা জানান, সুন্দরবন ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ সাইডের পাশাপাশি বিশে^র বৃহৎ জলাভূমিও। সুন্দরবনের জলভাগের পরিমাণ ১ হাজার ৮৭৪ দশমিক ১ বর্গ কিলোমিটার। যা সমগ্র সুন্দরবনের ৩১ দশমিক ১৫ ভাগ। ১৯৯২ সালে সমগ্র সুন্দরবনের এই জলভাগকে রামসার এলাকা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে জাতিসংঘ।
এছাড়া সুন্দরবনের সমুদ্র এলাকার পরিমাণ ১ হাজার ৬০৩ দশমিক ২ বর্গ কিলোমিটার। এই জলভাগে ছোট বড় ৪৫০টি ছোট-বড় নদী ও খালে রয়েছে বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির ইরাবতীসহ ৬ প্রজাতির ডলফিন, ২১০ প্রজাতির সাদা মাছ, ২৪ প্রজাতির চিংড়ি, ১৪ প্রজাতির কাঁকড়া, ৪৩ প্রজাতির মলাস্কা ও ১ প্রজাতির লবস্টার। সুন্দরবনের মোট আয়তনের ৬৮ দশমিক ৮৫ ভাগ অর্থাৎ ৪ হাজার ২৪২ দশমিক ৬ বর্গ কিলোমিটার হচ্ছে স্থল ভাগ। সুন্দরী, গেওয়া, গরান, পশুরসহ ৩৩৪ প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে।
এছাড়া ৩৭৫ প্রজাতির বন্য প্রাণীর মধ্যে রয়েল বেঙ্গল টাইগার ও হরিণসহ ৪২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, লোনা পানির কুমির, গুইসাপ, কচ্ছপ, ডলফিন, অজগর, কিংকোবরাসহ ৩৫ প্রজাতির সরীসৃপ ও ৩১৫ প্রজাতির পাখি রয়েছে। ইতিধ্যেই সুন্দরবন থেকে হারিয়ে গেছে ১ প্রজাতির বন্য মহিষ, ২ প্রজাতির হরিণ, ২ প্রজাতির গন্ডার, ১ প্রজাতির মিঠা পানির কুমির।
সুন্দরবন নিয়ে গবেষণা করা প্রতিষ্ঠান সেভ দ্যা সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম জানান, সুন্দরবনকে তার মতো করে থাকতে দিলে আগামী ৫ থেকে ৬ মাসের মধ্যে এই বনটি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে। গত দেড়শ বছরে ৭৫টি প্রলংকরী ঘূর্ণিঝড়ে লন্ডভন্ড হয়ে যায় সুন্দরবন। তার পরও সুন্দরবন ঘুরে দাঁড়িয়েছে। উদ্বিগ্ন হবার কিছু নেই, নিকট অতীতে সুন্দরবন সুপার সাইক্লোন সিডর, আইলা, বুলবুলের ক্ষত কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছে।
এখন বন বিভাগকে প্রাথমিক অবস্থায় দ্রুত দুটি কাজ করতে হবে। গাছগুলো ভেঙ্গে যে অবস্থায় আছে সেভাবেই রেখে দিতে হবে। জলোচ্ছাসে বন অভ্যন্তরে বণ্যপ্রাণীর খাবারের উৎস্য মিঠাপানির পুকুরগুলোতে যে লবণপানি ঢুকেছে তা দ্রুত পাম্প করে বের করে দিতে হবে। বৃষ্টির পানিতে দ্রুত পুকুরগুলোতে আবার পানি জমবে। প্রতিবারই ঝড়-জলোচ্ছাসের হাত থেকে সুন্দরবন উপকূলের কোটি মানুষের জীবন রক্ষা করে চলেছে। এখন সময় এসেছে সুন্দরবনকে রক্ষায় সরকারকে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা। সুন্দরবনের সব বন অফিসের ভবন ও জেটি ঘূর্ণিঝড় সহনীয় করে নির্মাণ, আগুনের হাত থেকে
বাংলাদেশের এই ফুসফুসকে রক্ষায় এই বনের জন্য নিজস্ব ভাসমান অগ্নি নির্বাপক নৌযান ক্রয়, বনের লোকালয় সন্নিহিত এলাকায় কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ, জেলে-বনজীবীদের জন্য আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ, বন্যপ্রাণীর খাবারের মিঠা পানির জন্য পর্যাপ্ত পুকুর খননসহ সুন্দরবন সুরক্ষায় অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রনণালয়ে যেসব প্রকল্প আটকে রয়েছে, সেসব প্রকল্পে দ্রুত অনুমোদন দিয়ে অর্থ ছাড় করার দাবি জানান এই পরিবেশবিদ।
বাগেরহাট পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন জানান, উদ্বিগ্ন হবার কোন কার নেই। সুন্দরবনকে তার মতো করে থাকতে দিলে আগামী ৬ মাসের মধ্যে এই বনটি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে। এখন বন বিভাগ ঝড়ে বিধ্বস্ত গাছপালা সুন্দরবনে যে অবস্থায় আছে সেই অবস্থায়ই থাকবে বলে সিদ্ধান্ত হয়েছে। মিঠা পানির পুকুরগুলোতে জলোচ্ছাসে ভরে যাওয়া লবণ পানি দ্রুত পাম্প করে অপসারণের কাজ শুরু হবে।
সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যসহ অবকাঠামোসহ ক্ষয়ক্ষতির প্রকৃত অবস্থা জানতে ৪টি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ৪টি রেঞ্জের এসিএফদের প্রধান করে ৭ সদস্য বিশিষ্ট এসব কমিটিকে ৩ কর্মদিবসের মধ্যে সরেজমিনে সুন্দরবনের প্রকৃত ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করে তারা রিপোর্ট দেবে। তখন সুন্দরবনের প্রকৃত ক্ষয়ক্ষতির তথ্য জানা যাবে। প্রাথমিকভাবে আমরা জানতে পেরেছি, রাতভর ঘূর্ণিঝড় আম্ফান সুন্দরবনে তান্ডব চালালেও শরণখোলা, চাঁদপাই ও খুলনা রেঞ্জের চেয়ে সাতক্ষীরা রেঞ্জে প্রাণপ্রকৃতির ক্ষতির পরিমাণ বেশি।
বিডি প্রতিদিন/আল আমীন