গ্রামবাংলার মেঠো পথ ধরে ভেসে আসা বেদে সম্প্রদায়ের লোকজনের চিরচেনা সেই ডাক এখন খুব কমই শোনা যায়। একসময় রমরমা থাকলেও দিন দিন কালের আবর্তে এসব তা খুব একটা শোনা যায় না। বিষধর সাপ নিয়ে খেলা, বিষাক্ত জীবন নিয়েই যে বেদে সম্প্রদায়ের বসবাস এখন তারাই অসহায় হয়ে পড়েছে।
বেদেরা এখন সড়কপথে গুরুত্বপূর্ণ দেশের বিভিন্ন হাট-বাজার সংলগ্ন ছোট-ছোট ঝুপড়ি ঘর তুলে বসবাস করে। সাপ খেলার পাশাপাশি বেদেনীরা তাবিজ-কবজ নিয়ে ঘুরে বেড়ায় গাঁয়ের মেঠোপথে। তবে দিন দিন এ বেদে সম্প্রদায় সাপ ধরার নেশা বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। নানান পণ্য এখন তাদের হাতে উঠেছে। বেঁচে থাকার সংগ্রামে আজ তাদের ভিন্ন পথে চলতে বাধ্য হচ্ছে। এদের অনেকে এই পেশা বদলে দিয়েছে। তারপরেও যারা এ পেশাকে এখনও আগলে রেখেছে তাদের জীবন চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে।
বেদে বহরের মেয়েরাই মূলত আয় রোজগার করে। মেয়েরাই সকালে জীবিকার জন্য দল বেঁধে বের হয়। গ্রাম থেকে গ্রামে ছুটে, সন্ধ্যার দিকে ফিরে আসে বহরে। পুরুষরা সারাদিন বাচ্চাদের দেখাশুনা করে। বেদে সম্প্রদায়ের সুখ-আনন্দ হচ্ছে দুবেলা ভরা পেটে খাওয়া। করোনার এই সময় ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যেও তাদের জীবন চলার গতি থেমে থাকে না। আজ এখানে কাল ওখানে। এটাই তাদের পূর্বসূরী বংশের গতানুগতিক পরিচয়।
ঠিকানাবিহীন চলা দুটি বেদে বহর এসেছে দিনাজপুর সদরের শেখপুরা ইউনিয়নের গাবুরা এলাকায় গর্ভেশ্বরী নদীর তীরের চরে। এ বেদে সম্প্রদায়ের কেউ দেন বিভিন্ন রোগের ঝাড়-ফুঁক ও তাবিজ-কবজ। আবার কেউ বিক্রি করছে শাড়ি, চুড়িসহ প্রসাধনী। কেউ কেউ ভানুমতির খেলা ও জাদুমন্ত্র নিয়ে হাজির হচ্ছে হাটবাজারে। তাঁবু খাটিয়ে ছোট ছোট পরিসরে তাঁবু ঘরের সঙ্গে পাশাপাশি আরেক ঘর। এক বহরে ২৫টি এবং নদীর অপর পারে আরেকটিতে ২০টি পরিবারের দল। রাতে আলোর জন্য তারা সোলার বাতি ব্যবহার করে।
কথা হয় এক বহরের সর্দার আইনুল হকের সাথে। বেদে সর্দার জানান, পেটের কষ্টে নিজ বাড়িতে না থেকে জীবিকার জন্য এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাই। ২৫টি পরিবারের দল নিয়ে যাত্রা করেছি। আমাদের বাড়ী সাভারের কাঞ্চনপুর, পোড়াবাড়ী ও অমরপুর এলাকায়। সাভার থেকে আসতে এর মধ্যে বেশ কয়েক জায়গায় আমরা থেকেছি। প্রথমে সাভার থেকে লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রামে। পরে কুড়িগ্রাম জেলার ভুরুঙ্গামারী হয়ে রংপুর জেলার পাগলাপীর এলাকার পর বর্তমানে দিনাজপুরে। কর্মক্ষেত্রের উপর নির্ভর করে কোন জায়গায় এক মাস থেকে দেড় মাস পর্যন্ত থাকি। বৎসরের ৯ মাস আমরা জীবিকা নির্বাহের জন্য বাড়ির বাইরে থাকি। এরপর বাড়িতে যাই তখন তিন মাস পর্যন্ত অবস্থান করি। এসময় পরিবারের ছেলে-মেয়েরা বিবাহের উপযুক্ত হলে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়।
সর্দার আরও জানান, চিরিরবন্দর উপজেলায় খেলা দেখাতে গিয়ে মাত্র দুই’শ টাকা আয় হয়। দিন দিন আয় কমে গেছে। তাই দিন দিন তাদের পেশার পরিবর্তন ঘটছে। আগের মত উপার্জন না থাকায় অনেকে পরিবার থেকে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছে। আবার কেউ কেউ লেখাপড়া শিখে বাড়িতে থাকে। বাংলাদেশের নাগরিক হয়েও কোন সুযোগ-সুবিধা না পেয়ে অনেক দুঃখ কষ্টে জীবন চালাতে হয়।
সর্দার বললেন, নানা সমস্যা-সংকট এদের আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে। সাপ খেলায় এখন আর পেট বাঁচে না।
বহরের ২২ বৎসর বয়সী এক যুবক জানায়, লেখাপড়া শেখার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু অভাবের সংসারে তা সম্ভব হয়ে উঠে নাই। তবে অন্য পেশা পেলে এই পেশা ছেড়ে দিবো।
বিডি প্রতিদিন/ফারজানা