আধুনিকতার ছোঁয়ায় বগুড়ার ঐতিহ্যবাহী মৃৎ শিল্প প্রায় বিলুপ্তির পথে। দিনদিন হারিয়ে যাচ্ছে মাটির তৈরি বিভিন্ন ধরনের মৃৎ শিল্প। প্লাস্টিক, সিরামিক, মেলামাইন, অ্যালুমিনিয়াম পণ্যের ভিড়ে কমেছে মাটির তৈরি তৈজসপত্রের কদর। এর সঙ্গে মাটি, জ্বালানিসহ অন্যান্য উপকরণের মূল্যবৃদ্ধিতে দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থায় এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত পরিবারগুলো নানা সংকটে ভুগছে। সংকট উত্তরণে এখন শুধুমাত্র বগুড়ার দইয়ের হাড়ি তৈরি করে টিকে আছে। তবুও তাদের ভালো দিন যাচ্ছে না। মৃৎ শিল্পীরা বলছেন দইয়ের পাত্র তৈরি করে কোনোমতে টিকে রেখেছে বাপ-দাদার আমলের এই পেশা।
বগুড়ার শাজাহানপুরের আড়িয়া পালপাড়া, সদর উপজেলার শেখেরকোলা পালপাড়া গিয়ে জানা যায়, বাপ দাদার আমল থেকে শত বছরের পুরোনো এ পেশাকে আঁকড়ে আছে কয়েকশ পরিবার। তাদের বাড়ির বৃদ্ধ থেকে শিশু কিশোররাও এ কাজে দক্ষ। পড়াশোনার ফাঁকে অনেকেই মাটির কাজ করে থাকেন।
তারা জানান, মাটির যেকোনো পাত্র তৈরিতে কাদা প্রস্তুত করতে হয় প্রথমে। এরপর নির্দিষ্ট পণ্যের জন্য প্রস্তুতকৃত কাদা চাকার মাঝখানে রাখা হয়। চাকা ঘুরতে ঘুরতে মৃৎ শিল্পীদের নিপুণ হাতের ছোঁয়ায় মাটি হয়ে ওঠে আকর্ষণীয় শিল্প। এরপর তা শুকিয়ে স্তুপ আকারে সাজিয়ে চুল্লিতে নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় পোড়ানোর পর পণ্যের গায়ে রঙ তুলির ছোঁয়া লাগে।
এক সময় গৃহস্থালির কাজে মাটির তৈরি জিনিসপত্রের যেমন কদর ছিল তেমনি ঘর সাজাতেও মাটির শোপিস ব্যবহার হতো। শিশুরাও খেলতো মাটির পুতুলসহ খেলনা দিয়ে। কিন্তু আধুনিকতার ছোঁয়ায় এসবের ব্যবহার নেই বললেই চলে। প্রায় বিলুপ্তির পথে বগুড়ার মৃৎ শিল্প। এ পেশা ছেড়ে অনেকেই অন্য পেশায় জড়িয়ে পড়ছেন। তবে বাপ দাদার আমল থেকে শত বছরের পুরোনো এ পেশাকে আঁকড়ে ধরে দই এর বিভিন্ন আকারের পাত্র তৈরি করেই শিল্পকে টিকিয়ে রাখার সংগ্রাম চলছে। কাকডাকা ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কুমার পল্লিতে চলে নারী-পুরুষ মৃৎ শিল্পীদের কর্মযজ্ঞ। একটি ছোট দইয়ের পাত্র বিক্রি হয় ১ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ২ টাকা আর বড়গুলো আকারভেদে বিক্রি হয় ৫ থেকে ১০ টাকা। একসাথে বিক্রির পর যে টাকা পাওয়া যায় তা দিয়ে আবারো কাজ শুরু করেন তারা। তবে লাভের অংশ খুবই সীমিত।
আড়িয়া পালপাড়ার মৃৎশিল্পি নয়ন কুমার, শেখেরকোলার চিনাথসহ অনেকেই জানান, বর্তমানে মাটির জিনিসপত্রের কদর নেই, তাই দইয়ের পাত্র তৈরি করেই মৃৎ শিল্প টিকে আছে। মাটিসহ উপকরণের দাম বেড়ে যাওয়ায় খরচ তোলা কঠিন হয়ে পড়েছে। কোনোমতে সংসার চলে, এর মধ্যে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, সংসার খরচ চালিয়ে সন্তানদের পড়াশোনার খরচ চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। তবে সরকারি সহযোগিতা পেলে উপকৃত হবে মৃৎ শিল্পিরা বলে জানান তারা।
বগুড়া সদর উপজেলার শেখেরকোলা পালপাড়ার প্রবীন মৃৎ শিল্পী সুনীল চন্দ্র পাল বলেন, তিনি দীর্ঘদিন থেকেই এ ব্যবসার সাথে জড়িত। তার বাপ দাদার পর তিনি ও তার ছেলেরা এই ব্যবসা টিকে রেখেছে। সবকিছুর দাম বেড়ে গেলেও তাদের শ্রমের মূল্য বাড়েনি, তাই কোনোরকমে জীবিকা নির্বাহ চলছে। এদিকে দইয়ের জন্য বিখ্যাত বগুড়ার বিভিন্ন উপজেলায় বেশ কয়েকটি গ্রামে মৃৎ শিল্পীরা দইয়ের পাত্র তৈরি করছেন, জেলার চাহিদা মিটিয়ে বিভিন্ন জেলায় যাচ্ছে এসব দইয়ের পাত্র।
বগুড়া বিসিক উপ-মহাব্যবস্থাপক এ কে এম মাহফুজুর রহমান বলেন, কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম হওয়া মৃৎ শিল্প টিকে রাখতে বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। মৃৎ শিল্পীদের আর্থিক সহায়তা, স্বল্পসুদে ঋণ প্রদানসহ প্রশিক্ষণ প্রদান করা হবে বলে জানান তিনি।
বিডি প্রতিদিন/এমআই