বগুড়া-সিরাজগঞ্জ রেলপথের জমি শিগগিরই অধিগ্রহণ করতে যাচ্ছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। চলতি অর্থ বছরে জমি অধিগ্রহণের জন্য ১৯০ কোটি টাকা বরাদ্দ প্রদান করা হয়েছে। দুই জেলা মিলিয়ে ৯৪৪ একর জমি অধিগ্রহণ করা হচ্ছে। জমি অধিগ্রহণ শেষ হলে দুই জেলার মধ্যে সরাসরি ট্রেন চলাচলের পথ নির্মাণ শুরু করা হবে।
সোমবার সকাল ৯টায় বগুড়া জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সম্মেলন কক্ষে জমি অধিগ্রহণের প্রস্তাব দাখিলের প্রস্তুতিমূলক সভা থেকে এসব তথ্য জানানো হয়। সভায় বলা হয়, বগুড়া থেকে সিরাজগঞ্জের বঙ্গবন্ধু সেতুর শহীদ এম মনসুর আলী রেল স্টেশন পর্যন্ত ডুয়েল গেজ রেল লাইন নির্মাণ প্রকল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণের প্রস্তাব দাখিল করা হয়েছে। অধিগ্রহণ প্রক্রিয়ায় প্রত্যাশী সংস্থা কর্তৃক জেলা প্রশাসকের নিকট স্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণ ও হুকুম দখল আইন ২০১৭ অনুসরণ করে প্রস্তাব দাখিলের বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়।
সভায় বক্তব্য রাখেন জেলা প্রশাসক মো. জিয়াউল হক। সভায় অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) উজ্জ্বল কুমার ঘোষ, ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা আমির সালমান রনিসহ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের এলএ শাখার কানুণগো ও সার্ভেয়াররা। প্রত্যাশী সংস্থার পক্ষে সভায় উপস্থিত ছিলেন বগুড়া থেকে শহীদ এম মনসুর আলী রেল স্টেশন পর্যন্ত ডুয়েল গেজ রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পের প্রকল্প উপদেষ্টা মাকসুদুর রহমান পাটোয়ারী, প্রকল্প পরিচালক মো. মনিরুল ইসলাম ফিরোজিসহ বেসরকারি কন্সালটেন্সি প্রতিষ্ঠান কেএমসি’র প্রতিনিধিরা।
সভা থেকে বগুড়া অংশে প্রায় ৪৮০ একর এবং সিরাজগঞ্জ অংশে ৪৬৪ একর জমি অধিগ্রহণ করার কথা বলা হয়। সেক্ষেত্রে দুই জেলা মিলিয়ে মোট ৯৪৪ একর জমি অধিগ্রহণের জন্য আগামী অর্থ বছরে প্রয়োজনীয় সকল অর্থ বরাদ্দ করা হবে। আর চলতি অর্থ বছরে জমি অধিগ্রহণের জন্য ১৯০ কোটি টাকা বরাদ্দ প্রদান করা হয়েছে। এছাড়াও প্রকল্পটির সকল প্রক্রিয়া শেষে দরপত্র আহ্বান করা হবে।
জানা যায, ২০১১ সালের ৯ এপ্রিল সিরাজগঞ্জে এবং বগুড়ায় ২০১৫ সালের ১২ এপ্রিল আলতাফুন্নেছা খেলার মাঠে দলীয় এক জনসভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বগুড়া থেকে সিরাজগঞ্জ রেলপথ উপহার দেওয়ার ঘোষণা দেন। এরপর থেকে বিভিন্ন সময়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। বগুড়া থেকে সিরাজগঞ্জ পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণের দাবি দীর্ঘদিনের। এই দুই জেলার মধ্যে সরাসরি রেল পথ না থাকায় উত্তরাঞ্চলের ট্রেনগুলোকে যাত্রী ও কৃষিপণ্য নিয়ে ঢাকায় পৌঁছাতে নানা ভোগান্তির শিকার হতে হয়।
বর্তমানে বগুড়ার সান্তাহার জংশন হয়ে নাটোর, পাবনা, ঈশ্বরদী, সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া হয়ে যমুনা নদীর উপর নির্মিত বঙ্গবন্ধু সেতুতে পৌঁছাতে হয়। শুধুমাত্র বগুড়া রেলওয়ে স্টেশন থেকে তিনটি জেলার পথ ঘুরে বঙ্গবন্ধু সেতুতে পৌঁছাতে সময় লেগে যায় প্রায় ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা। আর প্রায় ৪০৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে ঢাকায় পৌঁছাতে সময় লাগে প্রায় ৮ থেকে ৯ ঘণ্টা। আর সড়ক পথে ২০০ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে বাসে করে ঢাকা যেতে সময় লাগে ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা। অথচ বগুড়া থেকে সিরাজগঞ্জের বঙ্গবন্ধু সেতুতে সরাসরি ট্রেনযোগে পৌঁছাতে সময়ে লাগবে প্রায় ১ ঘণ্টা থেকে সোয়া এক ঘণ্টা এবং ঢাকায় পৌঁছাতে সময় লাগবে সব মিলিয়ে প্রায় ৪ ঘণ্টা।
বগুড়া থেকে সরাসরি বঙ্গবন্ধু সেতুতে ট্রেন সার্ভিস চালু হলে বগুড়াসহ উত্তরের জেলার ট্রেন যাত্রীদের ১১২ কিলোমিটার পথ কমে আসবে। সেই সাথে খরচ কমে গিয়ে উত্তরের ট্রেন যাত্রীদের আর্থিকভাবে সাশ্রয় হবে। এছাড়া সড়ক পথ হয়ে বগুড়া, জয়পুরহাট, নওগাঁ, গাইবান্ধা, রংপুর, নীলফামারি, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, পঞ্চগড়, লালমনিরহাট কুড়িগ্রাম জেলার ঢাকাগামীরা যাতায়াত করে। এ কারণে সড়ক ও রেলপথে সব সময় যানজট লেগেই থাকে। যানজটের কারণে ঢাকা পৌঁছাতে হয় নানা দুর্ভোগ নিয়ে। এই দুর্ভোগ থেকে রেহাই পেতে বগুড়া ও সিরাজগঞ্জসহ উত্তরের বাসিন্দারা রেলপথ নির্মাণের দাবি তোলেন। এই পথটি নির্মাণ হলে উত্তরের ১০ জেলায় আর্থিক গতি আরো বৃদ্ধি পাবে।
বগুড়া-সিরাজগঞ্জ রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রকল্পের আওতায় দুটি রেলপথ নির্মাণের পরিকল্পনা হবে। একটি হলো-বগুড়া স্টেশন থেকে ২ হাজার ৬০০ ফুট পশ্চিমে অবস্থিত বগুড়া শহরের রেললাইন পর্যন্ত। এরপর বগুড়া রেললাইন থেকে সিরাজগঞ্জের বঙ্গবন্ধু সেতুর এম মনসুর আলী স্টেশন পর্যন্ত ৭২ কিলোমিটার এবং অপরটি হলো বগুড়ার কাহালু স্টেশন থেকে রাণীরহাট পর্যন্ত ১২ কিলোমিটার রেলপথ। এজন্য সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা।
তবে প্রকল্প কর্মকর্তারা বলছেন, প্রকল্পটি যেহেতু চালু রয়েছে সেহেতু ব্যয় এখনই বলা যাচ্ছে না। বগুড়া-সিরাজগঞ্জ রেলপথ নির্মাণের জন্য তিনটি জংশনের প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় বগুড়ার কাহালু উপজেলায় একটি, বগুড়া সদর রেলওয়ে স্টেশনে একটি ও অপর একটি জংশন নির্মাণ করা হবে জেলার শাজহানপুর উপজেলার রানীরহাট নামক স্থানে। তিনটি জংশন নির্মাণের মধ্যে দিয়ে পূর্ণতা পাবে বগুড়া-সিরাজগঞ্জ রেলওয়ে পথ। প্রকল্প মোতাবেক নতুন ওই রেলপথে জংশন ছাড়াও আরও ৭টি স্টেশন স্থাপন করা হবে। এগুলো হলো-রাণীরহাট, আড়িয়াবাজার, শেরপুর, চান্দাইকোনা, রায়গঞ্জ, কৃষাণদিয়া ও সদানন্দপুর। প্রস্তাবিত ৮৪ কিলোমিটার রেলপথের জন্য প্রয়োজনীয় জমি অধিগ্রহণের প্রস্তাব করা হয়েছে।
বগুড়া-সিরাজগঞ্জ রেলপথের প্রকল্প পরিচালক মো. মনিরুল ইসলাম ফিরোজি জানান, বগুড়া-সিরাজগঞ্জ রেলপথ নির্মাণ হলে উত্তরের জেলাগুলোর সঙ্গে ঢাকার ১১২ কিলোমিটার পথ কমে আসবে। রেলপথটি নির্মাণের জন্য বগুড়া এলাকায় তিনটি জংশন করা হচ্ছে। টেন্ডার প্রক্রিয়াসহ প্রকল্পের সকল কাজ চলমান রয়েছে। বগুড়া-সিরাজগঞ্জ রেলপথের জমি শিগগিরই অধিগ্রহণ শুরু করা হবে। সেক্ষেত্রে বগুড়া অংশে প্রায় ৪৮০ একর জমি এবং প্রকল্পের সিরাজগঞ্জ অংশে ৪৬৪ একর জমি অধিগ্রহণ করা হবে।
বগুড়া জেলা প্রশাসক মো. জিয়াউল হক জানান, বগুড়া-সিরাজগঞ্জ রেলপথ নির্মাণ করতে জমি অধিগ্রহণ করার জন্য জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে নির্মাণ কাজের সংশ্লিষ্ট সকলকে নিয়ে এক সভা করা হয়েছে। সভায় সিদ্ধান্তে বগুড়া ও সিরাজগঞ্জ অংশে যে পরিমাণ জমি অধিগ্রহণ করা হবে, তা প্রতিটি মৌজায় সরকারি মূল্য নির্ধারণ করা হবে। সরকারি মূল্য নির্ধারণ অনুযায়ী জমির মালিকদের অর্থ প্রদান করা হবে। এই রেলপথটি নির্মাণ হলে উত্তরের ১০ জেলায় আর্থিক গতি আরো বৃদ্ধি পাবে। এছাড়াও কম সময়ে ঢাকায় রেলযোগে যেতে পারবে।
বিডি প্রতিদিন/এমআই