শনিবার, ৮ আগস্ট, ২০১৫ ০০:০০ টা
স্মরণ

শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক (রহ.)

মুহাম্মদ আরিফুর রহমান জসিম

সমকালীন বাংলাদেশে 'শায়খুল হাদিস' বললেই সর্বস্তরের মানুষের মানসপটে একটি নাম ভেসে ওঠে। আর তিনি আল্লামা আজিজুল হক (রহ.)। যিনি অর্ধশতাব্দীর অধিক সময় বিশুদ্ধতম হাদিসের অধ্যাপনা করেছেন। আজকের মুহাদ্দিসরা অনেকাংশে তার কাছে ঋণী। বাংলাদেশে সর্বজনশ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব, উপমহাদেশের অন্যতম হাদিসবিশারদ, ইসলামী আন্দোলনের পুরোধা, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের প্রতিষ্ঠাতা ও ইসলামী ঐক্যজোটের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, বোখারি শরিফের প্রথম বাংলা অনুবাদক শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক (রহ.) একটি নাম, একটি ইতিহাস, একটি প্রেরণা, একটি ইমানদীপ্ত চেতনার সমন্বিত রূপ। মানব জীবনের সব কটি স্তরেই রয়েছে তার সফল পদচারণ। ব্যক্তিজীবনে তিনি ছিলেন হাস্যোজ্জ্বল, সহজ-সরল, উদার, নিরহংকারী, মিতব্যয়ী, বিনয়ী। সময়ানুবর্তিতা ছিল তার জীবনের সৌন্দর্য। পরনিন্দা, পরচর্চা ছিল তার একেবারেই অপছন্দনীয়। শিক্ষা-দীক্ষার সমন্বয়ে গঠন করেছেন তার বাস্তব জীবনকে। ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবনে নয় শুধু, কর্মজীবনেও রেখেছেন সফলতার সোনালি স্বাক্ষর। এ মহান মনীষী ইসলামের বহুমুখী খেদমত করেছেন অসামান্য দক্ষতার সঙ্গে। প্রায় সুদীর্ঘ সাত দশক ধরে একাধারে কোরআন-হাদিসের অধ্যাপনায় নিযুক্ত ছিলেন। বিশেষ করে পবিত্র কোরআনের পরে যে গ্রন্থকে মূল্যায়ন করা হয়, সেই বোখারি শরিফের অধ্যাপনা করেছেন অর্ধশতাব্দীকালাধিক। বুখারি অধ্যাপনায় তার নিপুণতার ও শ্রেষ্ঠত্বের কারণেই হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)সহ সমকালীন শীর্ষ আলেমরা তাকে 'শায়খুল হাদিস' উপাধিতে ভূষিত করেন। বাংলার বোখারি খ্যাত আল্লামা আজিজুল হক (রহ.) ১৯১৯ সালের (বাংলা ১৩২৬) পৌষ মাসে মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলার ভিরিচ খাঁ গ্রামের এক সম্ভান্ত কাজী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম আলহাজ এরশাদ আলী। পাঁচ বছর বয়সে মাতৃহারা হন। তারপর তিনি নানাবাড়িতে নানী ও খালার দায়িত্বে বড় হতে থাকেন। গ্রামের মক্তবে প্রাথমিক শিক্ষা শেষে সাত বছর বয়সে বি. বাড়িয়া জামিয়া ইউনুসিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হন। সেখানে মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী (রহ.)-এর তত্ত্বাবধানে চার বছর সাফল্যের সঙ্গে শিক্ষা অর্জন করেন। ১৯৩১ সালে ঢাকার বড়কাটারা মাদ্রাসায় ১২ বছর অধ্যয়ন করে কৃতিত্বের সঙ্গে দাওরায়ে হাদিস পাস করেন। বড়কাটারা মাদ্রাসায় অধ্যয়নকালে তিনি আল্লামা জাফর আহমদ উসমানি, আল্লামা রফিক কাশ্মীরি, মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী (রহ.), হাফেজ্জী হুজুর (রহ.), পীরজি হুজুর (রহ.)সহ বিজ্ঞ হাদিসবিশারদের কাছে কোরআন-হাদিসের ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। ১৯৪৩ সালে উচ্চশিক্ষার জন্য ভারতের বোম্বের সুরত জেলার ডাভেল জামিয়া ইসলামিয়ায় ভর্তি হন। সেখানে তিনি মাওলানা শাব্বির আহমদ উসমানি (রহ.), মাওলানা বদরে আলম মিরাঠি (রহ.) প্রমুখের কাছে শিক্ষা লাভ করেন। সর্বশেষ ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে মাওলানা ইদরিস কান্দলভি (রহ.)-এর তত্ত্বাবধানে তাফসির বিষয়ে উচ্চশিক্ষা লাভ করেন এবং তার ওস্তাদ মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী (রহ.)-এর নির্দেশে ঢাকায় চলে আসেন। শিক্ষাজীবন শেষ করে ১৯৪৬ সালে ঢাকার বড়কাটারা মাদ্রাসায় শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করেন। ১৯৫২ সালে লালবাগ মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন। ১৯৫২-৮৫ সাল পর্যন্ত বোখারিসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কিতাবের অধ্যাপনায় রত থাকেন। দীর্ঘ কৃতিত্বের সঙ্গে বোখারির অধ্যাপনায় ব্যস্ত থাকায় তাকে 'শায়খুল হাদিস' খেতাব দেওয়া হয়। তখনই বোখারির বাংলা অনুবাদ প্রকাশিত হয়। লালবাগ মাদ্রাসায় শিক্ষকতার মাঝখানে ১৯৭১ সাল থেকে দুই বছর বরিশাল জামিয়া মাহমুদিয়ায় শিক্ষকতা করেন। ১৯৭৮ সালের এপ্রিলে কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড-বেফাকের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে বোখারি শরিফের অধ্যাপনা করেন। তিন বছর সেখানে দায়িত্ব পালন করেন। বিদগ্ধ এ ব্যক্তি যথাক্রমে লালবাগ কেল্লা জামে মসজিদ, মালিবাগ শাহী জামে মসজিদ ও আজিমপুর স্টেট জামে মসজিদে খতিব হিসেবেও দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেন। জাতীয় ঈদগাহের ইমাম ছিলেন বেশ কয়েক বছর। তিনি আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের শরিয়াহ বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবেও দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেন। তিনি আমৃত্যু হুফফাজুল কোরআন ফাউন্ডেশনের প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন। এ জ্ঞানী ব্যক্তির কর্মময় জীবন যেমন সার্থক, তেমনি রাজনৈতিক জীবনেও সোনালি স্বাক্ষর রেখেছেন। তিনি ছিলেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। তিনি ছাত্রজীবন থেকেই ইংরেজ হটাও আন্দোলন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, ধর্মীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে যে কোনো অন্যায়-অবিচার সংঘটিত হলে প্রতিবাদ করেছেন সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ইরান-ইরাক যুদ্ধ, আমেরিকা কর্তৃক ইরাক আক্রমণ, বাবরি মসজিদ, গঙ্গার পানি সংকট নিরসন আন্দোলন, ফতোয়াবিরোধী রায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন, কওমি মাদ্রাসার সরকারি সনদের স্বীকৃতি আদায়ের আন্দোলনে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। এ দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তিনি দুবার কারাবন্দী হন। একবার ১৯৯৩ এবং ২০০১ সালে। জ্ঞানপিপাসু এ পণ্ডিত লেখালেখিতেও পিছিয়ে ছিলেন না। শায়খুল হাদিসের অনন্য অবদান হলো বোখারি শরিফের বাংলা অনুবাদ। ১৯৫২ সালে পবিত্র হজের সফরে শুরু করে ১৬ বছরের সাধনায় অনুবাদের কাজ সমাপ্ত করেন। প্রথমে সাত খণ্ডে, বর্তমানে ১০ খণ্ডে বিদ্যমান। বোখারির অনুবাদের অনেকাংশই তিনি পবিত্র রওজার পাশে বসে করেন। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে- ফজলুল বারী শরহে বোখারি, 'মুসলিম ও অন্যান্য হাদিসের ছয়টি কিতাব' নামে অনবদ্য এক হাদিসগ্রন্থ সংকলন করেন, যা দুই খণ্ডে প্রকাশিত। মসনবিয়ে রুমির বাংলানুবাদ, কাদিয়ানি মতবাদের খণ্ডন, মাসনুন দোয়াসংবলিত মুনাজাতে মাকবুল, সত্যের পথে সংগ্রাম, সফল জীবনের পাথেয় ইত্যাদি। তিনি পাঁচ ছেলে ও আট মেয়ের জনক ছিলেন। তার সন্তানরা স্বমহিমায় ভাস্বর। সারা বিশ্বের মধ্যে সম্ভবত তার পরিবারের মতো অন্য আরেকটা পরিবারের খোঁজ পাওয়া যাবে না। কারণ তার থেকে শুরু করে অধস্তন সদস্য পর্যন্ত প্রায় ৭০ জন হাফেজে কোরআন রয়েছে তার পরিবারে। ইতিহাসের এ কিংবদন্তি অসংখ্য ছাত্র, ভক্ত, গুণগ্রাহী রেখে ২০১২ সালের ৮ আগস্ট আল্লাহর দরবারে চলে যান। তাকে কেরানীগঞ্জের বছিলায় তার পারিবারিক কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।

-লেখক : প্রবন্ধকার

 

সর্বশেষ খবর