রবিবার, ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ ০০:০০ টা

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের শ্রেণি-চরিত্র

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের শ্রেণি-চরিত্র

ড. ক্লিনটন শিলি আমেরিকার একজন বহু ভাষাবিদ শিক্ষক। তিনি বাংলা ভাষা শিখে তার সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্য অধ্যয়নের জন্য রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনেরও ছাত্র হয়েছিলেন। জীবনানন্দ দাশের কবিতা নিয়ে তিনি গবেষণা করেছেন এবং শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট লাভ করেছেন। তিনি প্রাক-যৌবনে প্রেসিডেন্ট কেনেডির মার্কিন পিস কোরের সদস্য হয়েছিলেন এবং অল্প দিনের মধ্যেই বুঝতে পেরেছিলেন, আমেরিকার এই শান্তিবাহিনী মোটেই বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার কাজে নিয়োজিত নয়, বরং তাদের প্রধান কাজ আমেরিকার আধিপত্যবাদী স্বার্থে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অশান্তি সৃষ্টি করা।

এই উপলব্ধি থেকেই সম্ভবত তিনি মার্কিন পিস কোর ছেড়ে দেন এবং শিক্ষকতার কাজে যোগ দেন।  তার সঙ্গে নব্বই দশকের কোনো এক সময় যখন আমার পরিচয় হয়, তখন তিনি আমেরিকার শিকাগো ইউনিভার্সিটির একজন শিক্ষক। ১৩ জন ছাত্র নিয়ে তখন শিকাগো ইউনিভার্সিটিতে বাংলা বিভাগ চলছে এবং ক্লিনটন শিলি ছিলেন বিভাগীয় প্রধান। শিকাগোতে তখন তিন দিনব্যাপী বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলন চলছিল। আমি আমন্ত্রিত হয়ে লন্ডন থেকে সেখানে গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি, আমার বন্ধু ড. বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর ও কবি মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানও (এখন প্রয়াত) বাংলাদেশ থেকে সম্মেলনে এসেছেন এবং পশ্চিমবঙ্গ থেকে এসেছেন প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী সলিল চৌধুরী, তার স্ত্রী ও মেয়ে অন্তরা। সলিল চৌধুরীও এখন প্রয়াত।

আমরা সবাই শিকাগোর একটি হোটেলের বিভিন্ন কনফারেন্স রুমে সম্মেলনের বিভিন্ন অধিবেশনে যোগ দিতাম। রাতে ডাইনিং রুমে বসত আমাদের আড্ডা। সেই আড্ডায় সলিল চৌধুরী ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ গানটির কয়েক কলি গেয়ে আমাদের শুনিয়েছেন। এই আড্ডাতেই একদিন কথা উঠল বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন নিয়ে। ড. ক্লিনটন শিলি হঠাত্ এক দিন প্রশ্ন করে বসলেন, বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের কোনো শ্রেণি-চরিত্র ছিল কি? একজন মার্কিন অধ্যাপক, কমিউনিজম বা কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যার কোনো সুযোগ-সম্পর্ক ছিল না এবং এখনো নেই, তার মুখে ভাষা আন্দোলনের শ্রেণি-চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন শুনে বিস্মিত হয়েছিলাম। আমি নিজেও বিষয়টি নিয়ে তখন পর্যন্ত ভাবিনি।

ক্লিনটনকে বললাম, আমি একদিন ভেবে বিষয়টি নিয়ে তার সঙ্গে আলোচনা করব। এরপর বিষয়টি নিয়ে এক-আধটু চিন্তাভাবনা করেছি, বন্ধু বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের সঙ্গে হঠাত্ ছিটেফোঁটা কথা বলেছি। সেগুলো বিশাল সমুদ্রের মতো লেকের পাড়ে বালুকাবেলায় বিকালে হাঁটতে গিয়ে খুচরো আলাপ। বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে দুজনেই তেমন কোনো আলোচনা করিনি। ক্লিনটন শিলিও বিষয়টি নিয়ে আর কখনো কথা তোলেননি।

হঠাত্ একদিন ডাইনিং রুমে পাশাপাশি খেতে বসতেই সলিল চৌধুরী কথাটা তুললেন। তিনি আমাদের আড্ডাতেই বসে ক্লিনটনের প্রশ্নটি শুনতে পেয়েছিলেন। তখন নিজে কিছু বলেননি। বলার সুযোগও ছিল না। আমি থাকতাম শিকাগোতে আমার এক আত্মীয়ের বাসায়। যেদিন সম্মেলন থাকত, সেদিন হোটেলে সারা দিন অবস্থান ও ডিনার খাওয়ার ব্যবস্থা ছিল। ফলে রোজ পরস্পরের মধ্যে দেখা-সাক্ষাত্ হতো না। যখন হতো, এক রাতের আড্ডার টপিক, অন্য রাতে পাল্টে যেত।

কিন্তু বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের শ্রেণি-চরিত্র সম্পর্কিত প্রশ্নটি যে সলিল চৌধুরী মনে রেখেছেন এবং এখন আবার নিজের অনুসন্ধিত্সা থেকে কথাটি তুলছেন তা বুঝতে পারলাম। সেদিন বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর আড্ডায় ছিলেন না। সলিল চৌধুরীকে বললাম, সলিলদা, আমার বন্ধু বোরহান একজন বাম চিন্তাধারার ভাবুক ও বিশ্লেষক। তিনি আজ এখানে থাকলে ভাষা আন্দোলনের শ্রেণি-চরিত্র ছিল কি না সে সম্পর্কে ভালো আলোচনা করতে পারতেন।

সলিল চৌধুরী বললেন, বোরহান সাহেব থাকলে অবশ্যই ভালো হতো। কিন্তু তুমিও তো একজন বাম চিন্তাধারার মানুষ বলে শুনেছি। ভাষা আন্দোলনের গানও তুমি লিখেছ। ভাষা আন্দোলনের চরিত্র সম্পর্কে তোমার অভিমত কী?

জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি ড. শিলির প্রশ্নটাকে এত সিরিয়াসলি নিয়েছেন কেন? সলিল চৌধুরী বললেন, তোমরা বলে থাক, ভাষা আন্দোলন থেকেই বাঙালি মুসলমানের মধ্যে সেক্যুলার বাঙালি জাতীয় চেতনা তথা বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ। তা থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরু ও যুদ্ধে সাফল্য লাভ। এই থিওরি সঠিক হলে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের আরও বেশি গণসম্পৃক্তি এবং একটি সার্বিক জাতীয় চরিত্র থাকা উচিত। সেটি ছিল কি না সেটাই আমার জানার ইচ্ছে।

জিজ্ঞাসা করলাম, আপনার কি মনে হয়, এই সার্বিক জাতীয় চরিত্রটি বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের মধ্যে ছিল না?

‘আমি তা বলিনি’, সলিল চৌধুরী বললেন। একটু স্মিত হেসে বললেন, ‘আমি নিজেকে গণসংগীত শিল্পী বলে ভাবি। রাজনীতির বামধারার সঙ্গে জড়িত। তবু মাঝেমধ্যে ভাবি, আমি অবশ্যই প্রগতির গান গাই, বিপ্লবের গান গাই। কিন্তু গানগুলো প্রকৃতই গণসংগীত হয়ে উঠতে পেরেছে কি না, কিংবা জনগণের বোধ্য ভাষায় রচিত হয়েছে কি না? নাকি শিক্ষিত মধ্যবিত্তের বাম ফ্যান্টাসি পূরণের লক্ষ্যে তাদের বৈঠকী ভাষায় রচিত? নিজের মনের ভাবনাচিন্তা থেকে তোমাদের ভাষা আন্দোলনের চরিত্রটাও আমি বোঝার চেষ্টা করেছি। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন সত্যই কি ছিল সার্বিক জাতীয় জাগরণ অথবা গণজাগরণের আন্দোলন, না ছিল নব উত্থিত বাঙালি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত মুসলমানের নব রেনেসাঁ ও অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন? আমি এই চরিত্রটি বুঝে উঠতে পারিনি। এখনো কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারিনি। ড. ক্লিনটন শিলির প্রশ্নটি তাই আমাকে কৌতূহলী করে তুলেছিল।’

আমি এ প্রসঙ্গে সলিলদা অথবা ড. ক্লিনটন শিলির সঙ্গে আর কোনো আলোচনায় যাইনি। কারণ এ সম্পর্কে আমার নিজেরই কোনো পরিচ্ছন্ন ধারণা ছিল না। ভাষা আন্দোলন নিয়ে আমাদের মনে যে প্রবল আবেগ ও উচ্ছ্বাস, তাতে কোনো ধরনের আঘাত লাগে, সে রকম চিন্তাভাবনায় জড়াতে চাইনি। কিন্তু দীর্ঘদিন বিদেশে থাকা, স্বাধীন বাংলায় বাংলা ভাষার বর্তমান অবস্থান, বিশ্বের সর্বত্র বাঙালি কমিউনিটির ব্যাপক সম্প্রসারণের সঙ্গে বাংলা ভাষারও বিস্তার লাভ এবং নবপ্রযুক্তির যুগে বাংলা ভাষার উন্নয়ন ইত্যাদি দেখে এই প্রশ্ন বহুকাল পরে আমার মনে জেগেছে যে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের ব্যাপক ‘মাস অ্যাপিল’ থাকা ও বর্তমানে একটি শ্রেষ্ঠ জাতীয় অনুষ্ঠানে পরিণত হওয়া সত্ত্বেও সূচনায় এই আন্দোলন কি সব শ্রেণির বাঙালির (বাংলাদেশের) জাতীয় জাগরণের উপলব্ধি থেকে শুরু হয়েছিল? না, নব উত্থিত, শিক্ষিত বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্ত শ্রেণির রাষ্ট্রীয় ও প্রশাসনিক ব্যবস্থায় অধিকার হারানো এবং নতুন রাষ্ট্রের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হওয়ার শঙ্কা থেকে শুরু হয়েছিল? যদি এ শঙ্কা থেকে আন্দোলনটি শুরু হয়ে থাকে, তাহলে এ আন্দোলনে ভাষাপ্রেম কতটা ছিল, সে প্রশ্নটিও আজ উঠতে পারে।

আমি ছাত্রজীবনে ভাষা আন্দোলনে যুক্ত ছিলাম। একবার নয়, দুবার এই আন্দোলনে জেল খেটেছি। এই আন্দোলনের গুরুত্বকে খাটো করে দেখার অবকাশ আমার নেই এবং এই আন্দোলন থেকেই যে স্বাধীনতার আন্দোলনে আমাদের উত্তরণ, তাতেও আমার সন্দেহ নেই। কিন্তু ভাষা আন্দোলন সফল হওয়ার পর ভাষার প্রতি আমাদের বাঙালি শাসকদের বিমুখতা, স্বাধীনতা অর্জনের পর ভাষা জাতীয়তাভিত্তিক এই স্বাধীনতার মূল সেক্যুলার ও গণতান্ত্রিক আদর্শ সম্পর্কে আমাদের মধ্যে বিতর্ক, বিভ্রান্তি ও বিভক্তি লক্ষ্য করে আমার মনে এই উপলব্ধি দেখা দিয়েছে যে, একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধ যতটা ছিল বাঙালিত্ব অর্জনের, তার চেয়ে অনেক বেশি ছিল বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন। পাকিস্তানের অবাঙালি শাসকদের হাতে ক্রমাগত বঞ্চনা ও বৈষম্যের শিকার না হলে সম্ভবত উদীয়মান বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্ত স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন থেকে স্বাধীনতার আন্দোলন পর্যন্ত এত দ্রুত এগিয়ে যেত না।

এ কথা আমাদের ভাষা আন্দোলন সম্পর্কেও হয়তো সত্য। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দিনটি পর্যন্ত বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্তের মনে উর্দুভীতি ছিল না; ছিল পরম উর্দুপ্রীতি। উর্দুকে ‘ইসলামী ভাষা’ মনে করা হতো। বাংলাকে ‘হিন্দুর ভাষা’ বলে অনেক মুসলিম সমাজপতি অবজ্ঞা দেখাতেন। বাঙালি মুসলমান-পরিচালিত অধিকাংশ বাংলা সংবাদপত্রের নাম ছিল উর্দু, ফার্সি অথবা আরবিতে। যেমন আজাদ, ইত্তেহাদ, সোলতান, সওগাত, তকবির ইত্যাদি। বাঙালি মুসলমান অভিজাত শ্রেণি উর্দুতে কথা বলা আভিজাত্যের প্রমাণ হিসেবে দেখত। বাংলা ভাষা ছিল অনেকটা ‘ইতরজনের ভাষা’।

এই অবস্থায় পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার এক বছর না যেতে বাঙালি মুসলমান হঠাত্ কী করে আবিষ্কার করল, তারা মুসলমান বটে, তবে আগে বাঙালি (আগে ছিল প্রথমে মুসলমান, তারপর বাঙালি) এবং বাংলা ভাষা তাদের মায়ের ও প্রাণের ভাষা এবং এই ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বায়ান্নতে অকাতরে প্রাণ দিল, তা এক বিস্ময়ের বিষয়। ভাষা আন্দোলনের দীর্ঘ ৬১ বছর পর আমার কোনো কোনো গবেষক বন্ধুর (এবং আমারও) ধারণা, ভাষা আন্দোলন পরে ব্যাপক জাতীয় আন্দোলনে পরিণত হলেও প্রথমে তার শুরু শ্রেণি-আন্দোলন হিসেবে। উঠতি শিক্ষিত বাঙালি মধ্যবিত্তের স্বপ্নভঙ্গ ও অধিকার বঞ্চিত হওয়ার ভীতি ও ক্ষোভ থেকে এই আন্দোলনের শুরু। ফলে বায়ান্নর আগে পর্যন্ত এই আন্দোলনকে দেখা যায় সমাজের সবচেয়ে অগ্রসরমান শ্রেণি হিসেবে পরিচিত ছাত্রদের দ্বারা পরিচালিত হতে ও শিক্ষাঙ্গনেই এই আন্দোলন শুরু হতে।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার শুরুতেই গভর্নর জেনারেল জিন্নাহ যদি না বলতেন ডিকটেটরসুলভ ভাষায়, ‘উর্দু— উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’ এবং সরকারি কাজকর্ম, শিক্ষার মাধ্যমে উর্দুকেই একচেটিয়া ব্যবহারের একতরফা ব্যবস্থা না করতেন, তাহলে এত শিগগির বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্ত ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার খোলসে ঢাকা জাতীয়তার পরিচয় ত্যাগ করে ভাষাভিত্তিক সেক্যুলার জাতীয়তাকে আত্মরক্ষার বর্ম হিসেবে হয়তো গ্রহণ করত না। পরবর্তীকালে এক পাকিস্তানি গবেষকই বলেছেন, ‘রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠালগ্নেই যদি পাকিস্তানের অবাঙালি শাসকরা পুরো রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কুক্ষিগত করে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ বাঙালি মুসলমানের মধ্যে এই ভীতি সৃষ্টি না করতেন যে চাকরি-বাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা-স্বাস্থ্য— সর্বক্ষেত্রে তাদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকের অধিকারও দেওয়া হবে না, তাহলে দেড় হাজার মাইলের ভৌগোলিক দূরত্ব সত্ত্বেও বাঙালি মুসলমান পাকিস্তানে তাদের অস্তিত্ব ও অধিকার সম্পর্কে এত শিগগির মোহযুক্ত হতো না।’ আমার ধারণা, বিশ্লেষণটি সঠিক।

‘উর্দুই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে’— এই ঔদ্ধত্যপূর্ণ হঠকারী ঘোষণা তখন পূর্ব পাকিস্তানের আম-বাঙালির মধ্যে প্রথম ক্ষোভ সৃষ্টি করেনি। করেছে শিক্ষিত বাঙালি ও তাদের অগ্রদূত ছাত্রসমাজের মধ্যে। তাদের বুঝতে দেরি হয়নি, উর্দু একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হলে উর্দুভাষীরাই হবে চাকরি-বাকরি থেকে সব ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সহজ বিজয়ী। ভাষার আধিপত্য বাঙালি মুসলমানদের রাষ্ট্রে দ্বিতীয়, এমনকি তৃতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করবে এবং আর্থ-সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় তারা সব অধিকার বঞ্চিত হবে এবং বৈষম্যের শিকার হবে।

এই উপলব্ধি থেকেই পাকিস্তানের অবাঙালি শাসকদের বিরুদ্ধে বাঙালি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিদ্রোহ এবং তা ভাষাপ্রেমের আবরণে দ্রুত জনজীবনে ছড়িয়ে পড়ে এবং আন্দোলনটি সর্বজনীন চরিত্র লাভ করে। দেশের সাধারণ বাঙালি, যাদের মুখের ভাষা বাংলা, মাতৃভাষা বাংলা, তারা ভাষাপ্রেমী হলেও শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির কাছে ভাষাপ্রেমের চেয়েও তাদের স্বার্থ ও অধিকার রক্ষার হাতিয়ার হিসেবে ভাষাকে ব্যবহারের প্রবণতাই জিম্মি ছিল বলে অনেকে এখন মনে করেন।

এই শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি তাদের শ্রেণি-স্বার্থ উদ্ধারের পর, অর্থাত্ দেশের শাসনক্ষমতা দখল করে শাসক শ্রেণিতে উন্নীত হওয়ার পর জনগণের কাছে ধরা না পড়ার জন্য তাদের ভাষাপ্রেমের আবরণটি সযত্নে রক্ষা করে চলেছে; অর্থাত্ ভাষাকে রাষ্ট্রীয় জীবনে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে, তার উন্নয়ন ও গবেষণায় অর্থ বরাদ্দ চলছে। কিন্তু জাতীয় বা রাষ্ট্রীয় জীবনে তার ব্যবহারিক প্রতিষ্ঠা এখনো হয়নি এবং ব্যবহারিক ও বৈজ্ঞানিক যুগে ভাষা হিসেবে উন্নয়নেরও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। বরং ঔপনিবেশিক যুগের ভাষা ও কালচারের আধিপত্যের কাছে আবার নতশির হওয়ার ব্যাপারে আমাদের শাসক শ্রেণির বাঙালিরা এখন দ্বিধাহীন। ফলে পাকিস্তান আমলেও বাংলাদেশের বাঙালি যতটা সেক্যুলার বাঙালি ছিল স্বাধীন বাংলাদেশে এখন আর তা নেই। স্বদেশেই ইংরেজি ও হিন্দির দাপটে (হিন্দি এখন উর্দুর স্থলাভিষিক্ত) বাংলা ভাষা রাষ্ট্রীয় ভাষার স্বীকৃতি পেয়েও মর্যাদাহীন ও ম্রিয়মাণ। শাসক শ্রেণির অপসংস্কৃতি অনুকরণের দাপটে বাংলার হাজার বছরের সামাজিক ও সেক্যুলার সংস্কৃতি এখন বিপন্ন।

রাজনীতির ক্ষেত্রেও এই পশ্চাদগতি লক্ষ্য করা যায়। বাংলাদেশের বাঙালি শাসকদের এখন আর পাকিস্তানের শাসকদের সঙ্গে যুদ্ধে ভাষাভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তার বর্ম ধারণ করে রাখার দরকার নেই। ফলে তাদের এক অংশ নতুন জাতীয়তা আবিষ্কার করেছে— বাংলাদেশি জাতীয়তা, যা ঔপনিবেশিক যুগের বিকৃত আত্মপরিচয়ের নব রূপায়ণ। শাসক শ্রেণির যারা এতকাল সেক্যুলার বাঙালি জাতীয়তার কথা বলেছেন বা এখনো বলছেন, তারাও ধীরে ধীরে রাজনীতি ও জাতীয়তার সাম্প্রদায়িক ও ধর্মীয় কালচারের সঙ্গে আপস করে চলেছেন।

বাংলাদেশের সুবিধাবাদী ও শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত শাসক শ্রেণি সত্যই দেখাল, তারা তাদের শ্রেণি-স্বার্থে ভাষাপ্রেম, দেশপ্রেমকেও ব্যবহার করতে পারে, ভাষাপ্রেমী ও দেশপ্রেমী সাজতে পারে এবং প্রয়োজন শেষ হলে তাকে দূরে ছুড়ে ফেলে রাতারাতি ভোল পাল্টাতে পারে। তাই বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করার পরও তার স্বাধীনতার এত বিকৃতি। তার ভাষাপ্রেম, দেশপ্রেম খণ্ডিত। জাতীয় জীবনের সব পর্যায়ে বিভক্তি। জাতীয়তাবাদী নামে শাসক শ্রেণির একটি অংশের উদ্ভব ঘটেছে। তাদের জাতীয়তাবাদের চেহারা ও চরিত্র ভিন্ন। তাতে বাঙালিত্ব নেই।

প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারিতে তাই শাসক শ্রেণি আনুষ্ঠানিকভাবে দিবস পালন করবে।  কিন্তু সচেতন ও দেশপ্রেমিক বুদ্ধিজীবীদের উচিত, আমাদের ভাষা আন্দোলনের প্রাথমিক যুগের শ্রেণি-চরিত্র বিশ্লেষণ করে এই আন্দোলনে গণসম্পৃক্তি কী করে ফিরিয়ে আনা যায় এবং বাংলা ভাষা ও বাঙালি জাতীয়তার আন্দোলনকে শাসকদের শ্রেণি-স্বার্থের কবল থেকে মুক্ত করে দেশের ভাষা, সাহিত্য ও রাজনীতিকেও হাজার বছরের গণতান্ত্রিক ও সেক্যুলার ঐতিহ্যের ভিত্তিতে পুনঃ নির্মাণ ও পুনর্গঠন করা যায়, তার উপায় নির্ধারণ  করা।

লেখক : একুশের প্রভাতফেরির গানের রচয়িতা, লন্ডন প্রবাসী সাংবাদিক, সাহিত্যিক।

সর্বশেষ খবর