শনিবার, ২২ অক্টোবর, ২০১৬ ০০:০০ টা

আওয়ামী লীগ— রাজনীতির চার অধ্যায়

আবদুল গাফ্‌ফর চৌধুরী

আওয়ামী লীগ— রাজনীতির চার অধ্যায়

আজ শুরু হচ্ছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ২০তম জাতীয় কাউন্সিল। চলবে দুই দিন। এই দীর্ঘ সাড়ে ছয় দশকে আওয়ামী লীগের কাঠামো ও নেতৃত্ব বারবার পরিবর্তিত হয়েছে। কিন্তু নীতি কি পরিবর্তিত হয়েছে? দলটির চরিত্র পাল্টেছে, কিন্তু নীতি তেমন পাল্টায়নি। এক পা এগিয়ে যাওয়ার জন্য দুপা পিছিয়ে যাওয়ার যে লেনিনীয় কৌশলের কথা জানা যায়, আওয়ামী লীগ সেই কৌশল বহুবার গ্রহণ করেছে। মৌলিক নীতি থেকে একেবারে পিছিয়ে যেতে পারেনি। এই নীতিটি হলো একটি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন।

এই নীতি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী থেকে শেখ  হাসিনা— এই জন্মকাল থেকে বর্তমানকাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ খুব একটা পেছনে সরতে পেরেছে তা মনে হয় না। মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে আওয়ামী মুসলিম লীগ যখন একটি সাম্প্রদায়িক দল হিসেবে জন্ম নেয়, তখন যেমন সে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছে, তেমনি ভাসানী-মুজিব নেতৃত্বে দলটি আনুষ্ঠানিকভাবে অসাম্প্রদায়িক দল হওয়ার পর প্রকাশ্যেই সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী রাজনৈতিক কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। সুতরাং ৬৭ বছরের জীবনে আওয়ামী লীগ একাধিকবার চরিত্র পাল্টেছে; নীতি পাল্টায়নি বলা চলে।

মওলানা ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেখ মুজিবুর রহমান, শেখ হাসিনা— এই চার নেতাকেই আওয়ামী লীগের ৬৭ বছরের জীবনে বিভিন্ন সময়ের প্রধান নেতা বলা চলে। এই চার নেতার সময়ের আওয়ামী লীগে অবশ্যই চারিত্রিক পরিবর্তন ঘটেছে। কিন্তু তা বাংলাদেশের কৃষিজীবী সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনসমাজের চরিত্র পরিবর্তনের সঙ্গে সমন্বিত। এ জন্যই আওয়ামী লীগকে বলা চলে বাংলাদেশের জন-চরিত্রের পরিবর্তনের সঙ্গে সংগতি রেখে পরিবর্তনশীল চরিত্রের একটি রাজনৈতিক দল। সে বাঙালি চরিত্রের ভালো ও মন্দ দুদিকেরই প্রতিনিধিত্ব করে এবং এই বাঙালির কৃষিজীবী চরিত্র থেকে বর্তমানের পাতিবুর্জোয়া চরিত্রে উত্তরণেরও সব বৈশিষ্ট্য বহন করে। এদিক থেকে বাঙালি, বাংলাদেশ ও আওয়ামী লীগের সম্পর্ক অভিন্ন। বাঙালিত্বের ভালো-মন্দ সর্বদিক মিলিয়ে আওয়ামী লীগ। এমন বৈশিষ্ট্য আর কোনো দেশে আর কোনো রাজনৈতিক দলের মধ্যে হয়তো বিরল। মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বের আমলেই আওয়ামী লীগ সাম্প্রদায়িকতার চরিত্র বর্জন করে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি মুসলমানরাও ততদিনে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র পাকিস্তানের চরিত্র সম্পর্কে মোহমুক্ত হয়ে সেক্যুলার (বাঙালি) জাতীয়তাবাদী চরিত্রের দিকে ঝুঁকছে। ইতিমধ্যেই ভাষা আন্দোলন হয়ে গেছে। স্বতন্ত্র নির্বাচনের বদলে যুক্ত নির্বাচন প্রবর্তনের দাবি উঠেছে। দাবি উঠেছে ভাষা ও স্বাধিকারভিত্তিক স্বায়ত্তশাসিত পূর্ব পাকিস্তান গঠনের। শিল্পে বাণিজ্যে ব্যবসায়ে বঞ্চনার শিকার হওয়া সত্ত্বেও একটি নগরভিত্তিক শিক্ষিত নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণি তখন গড়ে উঠছে যাদের সমাজ-চেতনা আধুনিক।

আওয়ামী লীগে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বের সময় দলটি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বসা সত্ত্বেও সেটা ছিল তার দুপা পিছিয়ে যাওয়ার যুগ। শহীদ সোহরাওয়ার্দী পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিলেও ছিলেন উনিশ শতকের ব্রিটিশ উদারনৈতিক রাজনীতির অনুসারী। তিনি সংগ্রামে নয়, আপসে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক (পেছনে সামরিক বাহিনী) অবাঙালি শাসকদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে পাকিস্তানে গণতন্ত্র ও পূর্ব পাকিস্তানে স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা করবেন ভেবেছিলেন। তিনি তাতে সফল হননি। তার সঙ্গে পাকিস্তানের অবাঙালি সামরিক শাসক চক্র বিশ্বাসঘাতকতা করে। ভগ্ন মনোরথ শহীদ সোহরাওয়ার্দী বিদেশে (বৈরুতে) মৃত্যুবরণ করেন।

শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বের আমলে আওয়ামী লীগের ভালোর দিকটি ছিল দলটি পলিটিক্যাল পার্টি থেকে পলিটিক্যাল প্লাটফরমে পরিণত হয়। দলে ডান, বাম, সেক্যুলারিস্ট, নন সেক্যুলারিস্ট সব রকমের মানুষ জমায়েত হয়। এ অবস্থাটি ঘটেছিল অবিভক্ত ভারতে নিখিল ভারত কংগ্রেসের বেলায়। কংগ্রেস ঘোষিতভাবেই জাতীয় রাজনীতির একটি প্লাটফরমে পরিণত হয়। তাতে কম্যুনিস্ট, সোশ্যালিস্ট এবং অন্যান্য ডান-বাম দলও কংগ্রেসের এফিলিয়েটেড পার্টি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। কংগ্রেসকে তাই বলা হতো ন্যাশনাল গ্রান্ড অ্যাসেম্বলি বা জাতীয় মহাসভা। এই মহাসভাতে নিখিল ভারত মুসলিম লীগও এক সময় যুক্ত ছিল এবং কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের যুক্ত অধিবেশনও হয়েছে।

ভারতের মুসলমানদের দাবি-দাওয়ার প্রশ্নে মুসলিম লীগ অনেক আগেই কংগ্রেসের প্লাটফরম ত্যাগ করে। তাতে রয়ে গিয়েছিল কম্যুনিস্ট, সোশ্যালিস্ট, ফরোয়ার্ড ব্লক, আরএসপি, গাফ্ফার খানের খোদাই খিদমতগার পার্টি, খাকসার, আহবার ইত্যাদি ডান ও বামের অসংখ্য দল। এ অবস্থা দেশভাগের দুবছর আগে পর্যন্ত (১৯৪৫) বহাল ছিল। কিন্তু ১৯৪২ সালে অবিভক্ত কম্যুনিস্ট পার্টি কংগ্রেসের আগস্ট আন্দোলনের বিরোধিতা করায় কংগ্রেস থেকে বহিষ্কৃৃত হয় এবং ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হওয়ার পর জয় প্রকাশ নারায়ণের সোশ্যালিস্ট দলসহ সব দলই কংগ্রেসের পক্ষপুট ত্যাগ করে। কংগ্রেস তখন স্বাধীন ভারতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়। জওয়াহের লাল নেহরু ঘোষণা করেন, এখন থেকে কংগ্রেস একটি রাজনৈতিক পার্টি, রাজনৈতিক প্লাটফরম নয়।

 

বাংলাদেশের আওয়ামী লীগের জন্ম পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর। তার আগে নয়। আর আওয়ামী লীগ কখনো ভারতের কংগ্রেসের মতো নিজেকে আনুষ্ঠানিকভাবে পলিটিক্যাল প্লাটফরম হিসেবে ঘোষণা দেয়নি। তা সত্ত্বেও অবস্থাদৃষ্টে আওয়ামী লীগকে প্রথম দিকে অঘোষিতভাবে একটি রাজনৈতিক প্লাটফরম হয়ে উঠতে হয়েছিল। কম্যুনিস্ট পার্টি (অবিভক্ত) নিষিদ্ধ ঘোষিত হওয়ার এক বিরাটসংখ্যক কম্যুনিস্ট নেতা-কর্মী আওয়ামী লীগে আশ্রয় নেন। ছোট ছোট আরও অনেক ডান ও বাম দলের নেতা-কর্মীও আওয়ামী লীগে যোগ দেন। সাম্প্রদায়িকমনা লোকেরাও যে ঢোকেনি তা নয়। তবে মওলানা ভাসানী বামদের দিকে থাকায় আওয়ামী লীগে বাম অংশই শক্তিশালী হয়ে ওঠে।

১৯৫৭ সাল আওয়ামী লীগের জন্য একটি ক্রান্তিলগ্নের বছর। শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে দলের ডানপন্থিদের এবং মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে বামপন্থিদের মধ্যে প্রত্যক্ষ শক্তি পরীক্ষা হয় নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতির প্রশ্নে। ঐতিহাসিক কাগমারী সম্মেলনে দলের ভাসানীপন্থি তথা লেফট গ্রুপ শক্তি পরীক্ষায় পরাজিত হয়। তারা দলত্যাগ করে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি নামে নতুন দল গঠনের উদ্যোগ নেন। এ সময়ও আওয়ামী লীগের চরিত্রে বাক পরিবর্তনের একটা বড় উদাহরণ দেখা যায়। বামপন্থিদের জোটবদ্ধভাবে দলত্যাগের ফলে আওয়ামী লীগ সম্পূর্ণভাবে আপসবাদী ডানপন্থিদের হাতে চলে যাবে এই আশঙ্কা দেখা দেয়। পূর্ব পাকিস্তানে গণতন্ত্র ও স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যায় এবং পাকিস্তানের সামরিক জান্তা তার সুযোগ গ্রহণ করে। দেশে সামরিক শাসন প্রবর্তিত হয়। আওয়ামী লীগ ও ন্যাপ দুই দলের নেতাদেরই জেলে নিক্ষেপ করা হয়। বস্তুত, এই ক্রান্তিকালেই আওয়ামী লীগে মুজিব-নেতৃত্বের প্রকৃত অভ্যুদয়। কেউ কেউ বলেন, তখন মওলানা ভাসানীর সঙ্গে শেখ মুজিবও আওয়ামী লীগ ত্যাগ করে ন্যাপে যোগ না দেওয়ায় দেশের ক্ষতি হয়েছে। এ অভিযোগটি সঠিক নয়। পরবর্তীকালে ইতিহাস প্রমাণ করেছে, দলের এবং দেশের সেই ক্রাইসিস মুহূর্তে শেখ মুজিব আওয়ামী লীগ ছেড়ে না গিয়ে বিরাট রাজনৈতিক বিচক্ষণতা দেখিয়েছেন, তিনি দল ছেড়ে ন্যাপে যোগ দিলে আওয়ামী লীগ সম্পূর্ণভাবে ডানপন্থিদের কব্জায় গিয়ে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর সামরিক শাসক ও পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীদের দ্বারা বহুল ব্যবহূত হয়ে মুসলিম লীগের দশাপ্রাপ্ত হতো। তিনি নিজেও কম্যুনিস্টদের দ্বারা প্রভাবিত ও পরিচালিত ন্যাপের অতি বাম তত্ত্বকথার রাজনীতিতে বন্দী হয়ে ওলি আহাদ, মোহাম্মদ তোহা প্রমুখ তখনকার অত্যন্ত সম্ভাবনাময় তরুণ নেতাদের ট্র্যাজিক পরিণতি বরণ করতেন।

শেখ মুজিব তা হতে দেননি, তার রাজনৈতিক প্রাগমেটিজম তাকে রক্ষা করেছে। তিনি আওয়ামী লীগকে সোহরাওয়ার্দী যুগের আপসবাদী রাজনীতির লেগাসি থেকে মুক্ত করে মধ্যবাম রাজনীতির সংগ্রামী ধারায় নিয়ে আসেন। তার নেতৃত্বের দিকে দেশের তরুণ প্রজন্ম বিরাটভাবে আকৃষ্ট হয়। মুজিব-নেতৃত্বের ডায়নামিক্সের কাছে পরাজিত হয়ে প্রবীণ ডান নেতারা জোট বেঁধে দল থেকে বেরিয়ে যান। আওয়ামী লীগের চরিত্র-বদল ঘটে। বাংলাদেশে যে শিক্ষিত নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণির ততদিনে বিপুলভাবে আবির্ভাব ঘটেছে এবং পাকিস্তানের রাষ্ট্রকাঠামোতে যারা ছিল বৈষম্যপীড়িত ও সুযোগ-সুবিধাবঞ্চিত, আওয়ামী লীগ তাদের লড়াকু প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠে।

এই লড়াকু প্রতিষ্ঠানের দেওয়া ছয় দফা ছিল বাঙালির জাতীয় মুক্তিসনদ। এই ছয় দফা দাবি আদায়ের লড়াইয়ে নেমে শেখ মুজিব বাঙালির জাতীয় নেতায় রূপান্তরিত হন। তিনি হন বঙ্গবন্ধু। বিশ্বের ইতিহাসে সম্ভবত এই প্রথম একটি গণতান্ত্রিক, নিয়মতান্ত্রিক দলের নেতৃত্বে একটি সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রাম পরিচালিত হলো। একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের কাঠামো ভেঙে জন্ম নেয় স্বাধীন সেক্যুলার বাংলাদেশ। বিস্ময়করভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে সন্নিবেশ করা হয়, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র এ চারটি রাষ্ট্রীয় মূল আদর্শ। তা হলে ক্রমশ কৃষিভিত্তিক চরিত্র থেকে আধা পুঁজিবাদী চরিত্রে উঠে আসা সুবিধাবঞ্চিত বাঙালি নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণি কি স্বাধীন বাংলাদেশে হঠাৎ সুবিধাভোগী শ্রেণিতে উত্তরিত হওয়ার পরও আগের লড়াকু চরিত্রে অবস্থান করার প্রবণতা দেখাচ্ছিল?

না, তারা তা দেখায়নি। আর এখানেই ছিল জাতির পিতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুর আশঙ্কা। তিনি ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন, স্বাধীনতা এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার আস্বাদ উঠতি মধ্যবিত্তের সামনে প্যান্ডোলার বাক্স খুলে দিয়েছে। তারা এখন বাঙালি আদমজী, বাওয়ানি হয়ে উঠতে চায়। লুটেরা নব্যধনী হতে চায়। যদি তাদের বাধা দেওয়া না হয়, তা হলে বাংলাদেশ সন্ত্রাস ও দুর্নীতিময় একটি পুঁজিবাদী রাষ্ট্র হবে; তার স্বপ্নের সমাজতান্ত্রিক সোনার বাংলা হবে না। এই সোনার বাংলা গড়ার লক্ষ্যেই তিনি বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ গঠন দ্বারা আওয়ামী লীগের চরিত্র আবার সম্পূর্ণ বদলাতে চেয়েছিলেন। নব্যধনী, শহুরে সুবিধাভোগী চ্যাটারিং শ্রেণিগুলোর বদলে দলে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষক শ্রমিক শ্রেণির স্বার্থ ও অধিকারকে অগ্রাধিকার দিতে চেয়েছিলেন।

তিনি শোষকদের স্বার্থের পাহারাদার পশ্চিমা গণতন্ত্রের বদলে শোষিতের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। এই শোষিতের গণতন্ত্রে কলোনিয়াল ব্যুরোক্রেসির বদলে তৃণমূল পর্যায়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা, পেশাভিত্তিক বৈষম্য ও শ্রেণিভেদ (যেমন ব্যারিস্টার, উকিল, মোক্তারের মতো আইনের পেশার লোককে সুবিধাভোগী ও সুবিধাবঞ্চিত শ্রেণিতে বিভক্ত করে রাখা) দূর করা এবং রাষ্ট্রকে কিছুকালের জন্য তথাকথিত বহুদলীয় ব্যবস্থার বদলে সম্মিলিত একটি গণমোর্চা দ্বারা পরিচালনার প্রাথমিক পদক্ষেপ ছিল।

তার এই পদক্ষেপ নেওয়া সফল হয়নি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেশি-বিদেশি চক্রান্তে বাংলাদেশের ভিতরে প্রতিক্রিয়াশীল সামাজিক আর্থিক ধর্মীয় সংস্থাগুলো এবার বিরাটভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়। কলোনিয়াল সামরিক ও অসামরিক আমলাচক্র তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়। নব্যধনী এলিট ক্লাস, সুশীল সমাজ, তাদের মিডিয়া তলে তলে এই চক্রান্তের সঙ্গে হাত মেলায়। ফলে স্বাধীনতা অর্জনের মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় বঙ্গবন্ধুসহ জাতীয় নেতাদের নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। বাকশাল— তথা আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হয়। জাহাজ নিমজ্জিত দেখলে ইঁদুর যেমন সবার আগে জাহাজ ছাড়ে; তেমনি বাকশালকে ক্ষমতাচ্যুত দেখে বামপন্থিরা সর্বাগ্রে বাকশাল ছেড়ে দিয়ে সামরিক শাসকদের কাছে দরখাস্তের রাজনীতিতে দীক্ষা নেন। অর্থাৎ সামরিক শাসকদের কাছে দরখাস্ত করে রাজনীতি করতে অনুমতি নিয়ে তারা আগের দল পুনর্জীবিত করেন। তাদের কেউ কেউ সামরিক শাসকদের ‘খাল কাটার বিপ্লবে’ গিয়ে অংশ নেন।

এই ভয়ঙ্কর দুঃসময় কাটিয়ে আওয়ামী লীগের আবার সহসা জেগে ওঠার কথা নয়। কিন্তু আওয়ামী লীগ দুঃসময় কাটিয়ে আবার জেগে উঠেছে এবং জেগে উঠেছে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে। এই জেগে ওঠার রহস্যটা কী? আমি আগেই লিখেছি, বাঙালি উঠতি মধ্যবিত্তদের শ্রেণি-চরিত্র আওয়ামী লীগেও বর্তমান। এই মধ্যবিত্তের ভালো-মন্দ, সুবিধাবাদিতা, আপস, সংগ্রাম সবই আছে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক চরিত্রে। কিন্তু আওয়ামী লীগ একটি খুুঁটির জোরে বেঁচে গেছে। এই খুঁটিটি হলো তার জন্মসূত্রে পাওয়া সংগ্রামের নীতি। বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনা যখন আবার এসে এই নীতির খুঁটি জড়িয়ে ধরেছেন, তখনই আওয়ামী লীগ আবার জেগে উঠেছে।

আওয়ামী লীগ এখন আর একটি রাজনৈতিক প্লাটফরম নয়, এখন একটি রাজনৈতিক পার্টি। একটি গণভিত্তিক বড় পার্টি। এই পার্টিতে ভালো-মন্দ লোক, চোর-সাধু সব রকমের নেতা-কর্মী-সমর্থক আছে। বঙ্গবন্ধুর আমলের আর্থ-সামাজিক অবস্থা এখন নেই। একটি চরিত্রহীন নব্যপুঁজিপতি শ্রেণি দেশে অসম্ভব ক্ষমতাশালী হয়ে উঠেছে। জঙ্গিবাদ, মৌলবাদ তাদের আশ্রিত। এমনকি বুদ্ধিজীবী শ্রেণির একটা বড় অংশ আত্মবিক্রীত। বহির্বিশ্বে সমাজতন্ত্রী শিবিরটি নেই। বিশ্বপুঁজিবাদ সর্বগ্রাসী এবং সর্বত্র তার আগ্রাসী ভূমিকা। তারপরও বাংলাদেশে শেখ হাসিনা ভয়ঙ্কর ঝড়ো বাতাসের মুখে গণতন্ত্রের বাতি আগলে আছেন। আওয়ামী লীগ তার নেতৃত্বে সব ত্রুটি-বিচ্যুতি, স্খলন-পতন সত্ত্বেও এখনো গণতন্ত্র ও সেক্যুলারিজমের ঘাঁটি আগলে আছেন। এটা শুধু উপমহাদেশে নয়, সারা দক্ষিণ এশিয়ায় একুশ শতকের একটি বড় ঘটনা।

আওয়ামী লীগের ২০তম জাতীয় কাউন্সিল। সামনে আরও কাউন্সিল হবে। বাঙালির জীবনধারায় আওয়ামী লীগ যেহেতু অভিন্ন প্রতিভূ ও প্রতিনিধি, সেহেতু আওয়ামী লীগের সামনে অতীতের মতো আরও হয়তো বিপর্যয় আছে, ধ্বংস নেই। বরং ধ্বংসের মুখেই আওয়ামী লীগ নতুন করে জেগে ওঠে। তার মধ্যে সংগ্রামী প্রেরণা দেখা দেয়। হাসিনা এখনো এই প্রেরণার উৎস। এখানেই তার নেতৃত্বের বৈশিষ্ট্য। ভাসানী থেকে শেখ হাসিনা— আওয়ামী লীগের দীর্ঘ ৬৭ বছরের রাজনীতির চার অধ্যায়ের  প্রত্যেকটি অধ্যায়ের ভিন্ন চরিত্র-বৈশিষ্ট্য আছে। কিন্তু তার মৌলিক নীতির কোনো পরিবর্তন হয়নি। এই নীতি বাংলাদেশকে অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় ধরে রাখা। আওয়ামী লীগ তার এই নীতি এবং বাঙালিত্ব নিয়ে আরও বহুকাল বেঁচে থাকবে এবং জাতিকে নেতৃত্ব দেবে।

            লেখক : লন্ডন প্রবাসী প্রবীণ কলামিস্ট।

সর্বশেষ খবর