রবিবার, ৫ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা

বিএনপির সংস্কারপন্থিদের ‘জুতা মেরে গরু দান’!

কাজী সিরাজ

বিএনপির সংস্কারপন্থিদের ‘জুতা মেরে গরু দান’!

বিএনপি ঘুরে দাঁড়ানোর চিন্তা ও চেষ্টা করছে বলে একটা ধারণার সৃষ্টি হয়েছে। ১০ বছরের নানা ব্যর্থতা ঘুচিয়ে নেতা-কর্মী-সমর্থকদের মনে আশা ও সম্ভাবনার আলো জ্বালানোর চেষ্টা চলছে বলে মনে হয়। সিপিবি-বাসদের কর্মসূচির প্রতি নিঃশর্ত সমর্থন দিয়ে জামায়াতকে বোধহয় এই বার্তাই বিএনপি দিতে চেয়েছে যে, এবার তোমরা তোমাদের পথ দেখ। জামায়াতের সঙ্গে নিবিড় সখ্য রেখে কমিউনিস্টদের কোনো কর্মসূচির সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করা যায় না— এটা না বোঝার কোনো বিষয় নয়। রাজনৈতিক অঙ্গনে এ নিয়ে আলোচনা আছে। তবে একটি ঘটনা থেকেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসা যাবে না যে, শেষ পর্যন্ত বিএনপি জামায়াতের সঙ্গে বন্ধন ছিন্ন করবে। কারও কারও ধারণা, দলের ভিতর-বাইরের চাপ ও রাজনৈতিক বাস্তবতা বিবেচনায় সরকারবিরোধী সর্বদলীয় ঐক্য ও সংগ্রাম শুরুর চেষ্টা হিসেবে ২০-দলীয় জোট স্থগিত, এমনকি ভেঙে দেওয়া হতে পারে। তবে একটা ‘ডিসটেন্ট রিলেশন’ রাখার কথাও ভাবছেন দলের কেউ কেউ। সব কিছু ছাপিয়ে বিএনপিকে নিয়ে গেল সপ্তাহের বড় খবর হচ্ছে দীর্ঘদিন পর সংস্কারপন্থিদের নিয়ে নতুন দলীয় চিন্তাভাবনা।

বিএনপির সংস্কারপন্থিরা আবার দলে ফিরছেন, এমন একটা আভাসই যেন পাওয়া গিয়েছিল পার্টি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে সংস্কার-উদ্যোক্তা দুই নেতার সাক্ষাতের মাধ্যমে। এ নিয়ে ‘রাজনৈতিক বাজারে’ নানা মুখরোচক গল্প ছড়িয়েছে। কে আগে পা ধরেছে, কে বেশি কেঁদেছে, কে মান্নান ভূঁইয়ার ওপরই সব দোষ চাপিয়েছে ইত্যাদি। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই সাক্ষাতের অন্তর্নিহিত যে উদ্দেশ্য, তা কি সফল হবে? রাজনৈতিক দলে মতাদর্শগত লড়াই, নেতৃত্বের কোন্দল, স্বার্থের দ্বন্দ্ব, ক্ষমতার লোভে দলবদল, দলত্যাগ, পুনরায় দলে ফেরা, সর্বোপরি বিভক্ত দলে ঐক্য প্রক্রিয়া নতুন কোনো ঘটনা নয়। আমাদের এ উপমহাদেশে এমন ঘটনা বিরল নয়। ভারতে এককালে কংগ্রেসকে বলা হতো ‘ভারতের ঐক্যের প্রতীক’। সেই কংগ্রেসে ভাঙাগড়া, বিভক্তি এবং পুনরেকত্রীকরণের ঘটনা ঘটেছে একাধিকবার। এখনো যাওয়া-আসা চলছে। কমিউনিস্ট পার্টিতেও তাই। আঞ্চলিক দলগুলোতেও ভাঙাগড়ার খেলা চলছে। সর্বশেষ তামিলনাড়ু তার প্রমাণ। আমাদের দেশের প্রাচীন সংগঠন কমিউনিস্ট পার্টি, আওয়ামী লীগ ও বিএনপিও এই ইতিহাস-বিচ্ছিন্ন নয়। পুনরেকত্রীকরণ বা ঐক্য প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয় উভয় পক্ষের অর্থাৎ ব্যক্তি-গোষ্ঠী ও দলের প্রয়োজনে, বিশেষত দলের প্রয়োজনে। কারও দলত্যাগে যদি দল ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং তার বা তাদের পুনরায় ফিরে আসায় দল যদি উপকৃত হবে বলে বিবেচনা করা হয়, তাহলে পুনর্মিলন বলুন আর পুনরেকত্রীকরণ বলুন অথবা ‘ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে আসা’ বলুন— তা অর্থবহ হয়। সংস্কার আন্দোলনের সংগঠকদের দুজনের পার্টি চেয়ারপারসনের সঙ্গে সাক্ষাতের খবরটি যেভাবে মিডিয়ায় এসেছে, তাতে যে কারও মনে হতে পারে, কিছু দাগি-দোষী হাতে পায়ে ধরে, ক্ষমা চেয়ে, খত দিয়ে দলে ফিরতে চাচ্ছে তাই তাদের ক্ষমা করে দিয়ে ‘ঘরে ঢোকা’র সুযোগ দেওয়া হলো; এরা দলে ফিরলেই কী, না ফিরলেই কী? বিষয়টি যদি এমন হয় যে, যারা দলে ফিরতে চাচ্ছেন, তাদেরই দরকার দলে ফেরার, দলের কোনো প্রয়োজন নেই তাদের, তাহলে এই ‘ঘরে ফেরা’ হবে মূল্যহীন। বরং তা দলে সংকট বাড়িয়ে দিতে পারে। আর যদি এমন হয় যে, যারা দলে ফিরে আসতে চান, তারা যে উদ্দেশ্যে দলত্যাগ করেছিলেন বা দূরে সরে ছিলেন, তা করতে ব্যর্থ হয়েছেন এবং মনে করছেন একই রাজনৈতিক চিন্তা ও বিশ্বাস অটুট রেখে তা বাস্তবায়নের জন্য পুরনো মূল দলই ভরসা, তার অবশ্যই একটা রাজনৈতিক মূল্য আছে। সংস্কারপন্থিদের সঙ্গে বিএনপির রাজনীতির কোনো দ্বন্দ্ব ছিল না। একই রাজনীতি ও আদর্শের অনুসারী হয়ে তারা কিছু সংস্কার প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন। দুই টার্মের বেশি কেউ পার্টি চেয়ারপারসন বা মহাসচিব হতে পারবেন না এবং দল ক্ষমতায় গেলে পার্টিপ্রধান রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধান হতে পারবেন না, হলে পার্টি প্রধান থাকতে পারবেন না— এই দুটি বিষয় ছাড়া সংস্কার প্রস্তাবে দলের জন্য ক্ষতিকর কিছু কী ছিল? বরং সংস্কার প্রস্তাবে উত্থাপিত কিছু কিছু বিষয় এখন চেয়ারপারসন বেগম জিয়াই ধীরে ধীরে বাস্তবায়ন করছেন। কাজেই যারা সংস্কার প্রস্তাব উত্থাপনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, এখন তাদের কেউ কেউ ওই সময় ‘মহাপাপ’ করেছিলেন বলে ভাবছেন কেন বোঝা মুশকিল। দুজন ‘দর্শনার্থীর’ যে বক্তব্য মিডিয়ায় এসেছে, তাতে তারা হয়তো লজ্জা পাননি, কিন্তু অনেক সংস্কারপন্থি তাতে লজ্জা পাচ্ছেন, দলে গণতন্ত্রায়ণে তাদের সেই ব্যর্থ উদ্যোগের প্রতি সহানুভূতিশীলরা কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, এরা এসব কী বললেন? ধারণা করা হচ্ছিল যে, আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে এবং সরকারবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলন নতুন করে সূচনা করার লক্ষ্যে দলকে শক্তিশালী করার উদ্দেশ্যে যারা নানা কারণে দলের বাইরে চলে গেছেন, এমনকি ভিন্ন দল গঠন করেছেন, তাদের সবাইকে আবার দলে ফিরিয়ে আনার একটি শুভ উদ্যোগের অংশ সংস্কারপন্থি জহির উদ্দিন স্বপন ও সর্দার শাখাওয়াত হোসেন বকুলের সঙ্গে পার্টি চেয়ারপারসনের বৈঠক-আলোচনা। কিন্তু দলের ৩৫ ভাইস চেয়ারম্যানের মধ্যে বর্তমানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ (দল পুনর্গঠনের দায়িত্বপ্রাপ্ত) ব্যক্তি মোহাম্মদ শাহজাহান যা বলেছেন, তা সংস্কারপন্থিদের জন্য খুবই অপমানজনক। তিনি বলেছেন, ‘সংস্কারপন্থিদের ডাকা হচ্ছে না, যারা অনুতপ্ত হয়ে দলে সক্রিয় হতে চাচ্ছেন, তাদের বিএনপি চেয়ারপারসনের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে। এর আগে দলের হাইকমান্ড তাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে খোঁজখবর নিচ্ছে, তারা আসলেই অনুতপ্ত হয়ে দলে ফিরতে চাচ্ছেন, নাকি অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে, তা যাচাই করা হচ্ছে।’ তার বক্তব্য বিশ্লেষণ করলে এই দাঁড়ায়, সংস্কারপন্থিদের দলে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে দলীয় নেতৃত্বের কোনো আগ্রহ নেই। কিছু ‘দাগি-দোষী’ দলে ফিরে আসতে চাচ্ছে, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে কারও কারও ক্ষেত্রে কী ব্যবস্থা নেওয়া যায়, তা নেহাতই একটি ‘করুণার’ বিষয়। তার এ বক্তব্য তাদের দলের অন্য সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যের সঙ্গে মেলে না। সেই সূত্র বলছে, দেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষপটে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া দলের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করতে চান। যারা নানা কারণে দল ছেড়েছেন, নিষ্ক্রিয় হয়ে আছেন, তাদের সবাইকে ফিরিয়ে এনে দলের ভিতর নতুন প্রাণের সঞ্চার করতে চান, সরকারকে কার্যকরভাবে মোকাবিলা করতে চান। বিএনপিকে নিয়ে বিএনপির ‘মালিকপক্ষ’ কী করবেন, তা তাদের দলীয় সিদ্ধান্তের বিষয়। তবে বিএনপির শুভানুধ্যায়ীরা বলতে চান, শুরুটা ভালো হয়নি। এদের মতে, বিএনপির প্রয়োজন দলের সামগ্রিক পুনরেকত্রীকরণ, যা দলের ঝিমিয়ে পড়া অবস্থা থেকে উত্তরণে উজ্জীবনী শক্তি হিসেবে কাজ করবে। আর তাতে মান্নান ভূঁইয়ার অনুসারী সংস্কারপন্থিরাই শুধু নয়, আরও যারা নানা কারণে দলত্যাগ করেছেন, নতুন দল গঠন করেছেন, তাদের সবাইকে ফিরিয়ে আনা দরকার। বিএনপির প্রতিষ্ঠাকালীন মহাসচিব অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী, বিএনপি গঠনে পর্দার অন্তরালের অন্যতম দক্ষ কারিগর কর্নেল (অব.) অলি আহমদসহ তাদের সঙ্গে থাকা সাবেক বিএনপি নেতারা এখনো সজীব ও সক্রিয়। বি. চৌধুরী সাহেবের নেতৃত্বাধীন বিকল্প ধারার মহাসচিব মেজর (অব.) আবদুল মান্নান একজন সজ্জন ব্যক্তি।

একানব্বইর নির্বাচনে তিনি রমনা-তেজগাঁও এলাকায় আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে পরাস্ত করেছিলেন। বিকল্প ধারায় যারা আছেন, তারা সবাই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোক। কর্নেল (অব.) অলি আহমদের দল এলডিপির মহাসচিব রেদোয়ান আহমদ কয়েকবার এমপি নির্বাচিত হয়েছেন এবং সরকারের প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। চাঁদপুরে মিজানুর রহমান চৌধুরীকে ভোটে হারানো সাবেক এমপি প্রফেসর আবদুল্লাহসহ অনেকে আছেন- যারা একটি স্বচ্ছ রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের দাবিদার। সংস্কারপন্থি গ্রুপ ছাড়াও দলের বাইরে আছেন সাবেক প্রতিমন্ত্রী মে. জে. (অব.) আনোয়ারুল কবির তালুকদার, সাবেক প্রতিমন্ত্রী আলমগীর কবির, সাবেক প্রতিমন্ত্রী মনি স্বপন দেওয়ান, সাবেক এমপি আব্বাসী, সাবেক প্রতিমন্ত্রী জাহানারা বেগম, সাবেক হুইপ শহিদুল হক জামাল, সাবেক এমপি আবু হেনাসহ আরও অনেকে। শমসের মবিন চৌধুরীর মতো উজ্জ্বল ব্যক্তিরাও দল ছেড়েছেন নানা দুঃখে। সবাইকে আবার সসম্মানে দলে ফিরিয়ে আনা গেলে অবশ্যই বিএনপি দলের রাজনৈতিক মর্যাদা বাড়াতে পারবে। দলও শক্তিশালী হবে। এদের প্রায় সবারই নিজস্ব নির্ভরযোগ্য নির্বাচনী এলাকা আছে। তাদের ব্যক্তিগত রাজনৈতিক ক্যারিয়ার, সততা, এলাকায় ভাবমূর্তি ও সমর্থনের সঙ্গে বিএনপি আর ধানের শীষ যুক্ত হলে তাদের নির্বাচনী এলাকাগুলো নিয়ে লীগ নেতাদের দুশ্চিন্তা বেড়ে যাওয়ার কথা। যারা সংস্কারপন্থি বলে পরিচিত, তাদের মধ্যে অনেক সাবেক এমপি আছেন, যাদের নির্বাচনী এলাকায় পায়ের তলায় শক্ত মাটি আছে। সম্মানজনক প্রত্যাবর্তনের আয়োজন হলে সবাই যাবেন; কিন্তু মোহাম্মদ শাহজাহান যেমন ধারণা দিলেন, তেমন অনেকটা ‘কান ধরে উঠবোস করে নাকে খত দিয়ে’ বিএনপির ঠিকানা ব্যবহারের জন্য বেহায়া হয়ে যাবেন— অনেকের ক্ষেত্রে তেমন না-ও হতে পারে। সংস্কারপন্থি কেউ কখনো বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশ করেছেন বলে কখনো শুনিনি। বিএনপির অতীত-বর্তমানের প্রায় সব খবর রাখেন তেমন পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ওই ধরনের বক্তব্য শাহজাহান সাহেবের মুখে বেমানানই মনে হয়েছে। কে এম ওবায়দুর রহমান যখন দল ভেঙে বিএনপি ছেড়ে আলাদা দল গঠন করেন, মোহাম্মদ শাহজাহানও তার সঙ্গে বিএনপি ছেড়ে দিয়েছিলেন বলে অনেকে কনফার্ম করছেন। বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে এমন ঘটনা প্রায়ই বিভিন্ন দেশে ঘটে, আমাদের দেশেও ঘটেছে। আগেই উল্লেখ করেছি, ঘরের ছেলে ঘরে ফেরার কাহিনীও বিরল নয়। মূল দলে ফিরে এসে ওবায়েদ ভাই ফের স্থায়ী সদস্য হয়েছিলেন, শাহজাহান সাহেবও দলে ফিরে কমিটির বড় পদ পেয়েছেন, পদের চেয়ে বড় দায়িত্বও পেয়েছেন। অন্য যারা নানা কারণে দল ছেড়েছেন, এখন আবার পুরনো দলে ফিরে আসতে চান, তার তো তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়ার কথা। তাদের দলে ফিরতে নানা ধরনের শর্তের ছুঁতায় প্রতিবন্ধকতার দেয়াল তোলা বিএনপির জন্য কি খুব লাভজনক হবে? তিনি কি বিএনপির উপকার করলেন? ওয়ান-ইলেভেনের পর কতজনের কত গোপন কথাই তো গোপন থাকেনি। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, প্রক্রিয়াগত ত্রুটির মাধ্যমে কেউ কেউ বিএনপির শুভ একটি উদ্যোগকে অঙ্কুরে বিনাশ করার চেষ্টা করতে পারে।

 বিএনপির কী করা উচিত, তা বিএনপিই ঠিক করবে। তবে তাদের অনেক শুভানুধ্যায়ী প্রক্রিয়াটির সঙ্গে একমত নন। তাদের মতে, সংস্কারপন্থিদের সঙ্গে ইনডিভিজুয়াল অথবা গ্রুপ বৈঠকের কাজটি সম্পন্ন হওয়া উচিত মহাসচিব পর্যায়ে। আবদুল্লাহ আল-নোমান, মির্জা আব্বাস, নজরুল ইসলাম খানের মতো দু-তিনজন প্রবীণ নেতাও এর সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারেন। এক এক করে বা গ্রুপওয়ারি আলোচনা ও সমঝোতা শেষে সবার সঙ্গে পার্টি চেয়ারপারসনের একটা দীর্ঘ এবং প্রাণবন্ত বৈঠকের মাধ্যমে প্রক্রিয়াটির সফল পরিসমাপ্তি ঘটতে পারত। হতে পারত একটি আনন্দঘন মিলনমেলা। চক্রান্ত করে কেউ কি তাতে বাদ সাধল? প্রথমে ম্যাডাম দুজনের সঙ্গে সরাসরি কথা বলার পর এমন একটা ধারণার সৃষ্টি হওয়ার সুযোগ আছে যে, সংস্কারপন্থি যারা এখনো দলের বাইরে আছেন, সাক্ষাৎকারী দুজন বুঝিবা অন্য সবার নেতা। যারা দলে ফিরতে চান, তাদের কাছে কি এমন বার্তাই চলে গেল না যে, এই দুজনের মাধ্যমেই যা হওয়ার হবে। সংস্কারপন্থিদের সবাই তো এ দুজনকে তাদের ‘ইমাম’ না-ও মানতে পারেন। তাতে শুভ উদ্দেশ্যটা কি কিছুটা হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হবে না? এসব ক্ষেত্রে আগে-পরে ডাকা নিয়েও সমস্যা হয়। রাজনীতি-সংশ্লিষ্টদের কাছে অতীতের এমন অভিজ্ঞতা অবশ্যই আছে। সংস্কারপন্থিদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির এটা কোনো চক্রান্তের অংশ নয় তো! বিএনপির শুভানুধ্যায়ীদের সঙ্গে আলোচনা করে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, উদ্যোগটিকে তারা স্বাগত জানান এবং মনেপ্রাণে চান এটি সফল হোক; এ ব্যাপারে যাতে কোনো ধরনের ফাঁক-ফোকর না থাকে। তারা এমন মন্তব্যও করছেন যে, উদ্যোগটি নেওয়া উচিত ছিল আরও আগে। সংস্কারপন্থি সাবেক এমপিদের অনেকের এলাকাতেই সবল-দুর্বল যাই হোক বিএনপির একটি বিকল্প নেতৃত্ব গড়ে উঠেছে। নবম সংসদ নির্বাচনে ওইসব আসনে বিএনপি নতুন প্রার্থী দিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাও করেছে। নবম সংসদ নির্বাচনের আগেই যদি সংস্কারপন্থিদের বিষয়টি ফয়সালা হয়ে যেত তাহলে সংস্কারপন্থিরা ফিরে আসার পর ছোটখাটো যে সংকট সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা আছে তার কোনো সুযোগ থাকত না। জানামতে, একটি উদ্যোগ তখন নেওয়াও হয়েছিল। সবাই সম্মত ছিলেন। কিন্তু একজনের জন্য সব পণ্ড হয়ে যায়। তিনি সমঝোতা বৈঠকে আসবেন বলেও আসেননি। তৃতীয় একটি শক্তিশালী পক্ষই নাকি তখন বিএনপিকে ঐক্যবদ্ধ হতে দেয়নি। আওয়ামী লীগ কিন্তু বিচক্ষণতার সঙ্গে তাদের সংস্কারপন্থিদের হ্যান্ডলিং করেছে। তাই তাদের সংস্কারপন্থি কোনো নেতার আসনেই কোনো সাংগঠনিক সংকট বা বিশৃঙ্খলার কথা শোনা যায়নি। তবুও বিএনপিতে আনন্দঘন পরিবেশে যদি ‘ঘরের ছেলেদের ঘরে ফেরার’ পর্ব সম্পন্ন হয় এবং এ ব্যাপারে পার্টি চেয়ারপারসনের মনোভাব অনুকূল ও কঠোর হয়, তাহলে সংকট নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। বিষয়টি যদি দ্বিপক্ষীয় বিষয় হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তাহলে সমাধান সহজ হবে। সংস্কারপন্থিদের বিএনপি দরকার, আবার বিএনপিরও সংস্কারপন্থিদের দরকার— সামগ্রিক বিষয়টি যদি এই দৃষ্টিতে দেখা হয়, তাহলে সবকিছুই মিটে যাবে। কিন্তু সংস্কারপন্থিদের প্রতি ‘করুণা’ করা হচ্ছে, এমন ভাব দেখালে তো এ বার্তাটাই স্পষ্ট হয় যে, দলে তাদের প্রয়োজন নেই। যদি কারও দলে প্রয়োজনই ফিল করা না হয়, তাহলে দেখা-সাক্ষাতের নাটক কেন? আর শুধু সংস্কারপন্থিরাই নয়, একদা বিএনপির সঙ্গে যুক্ত সবাইকেই দলে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করলে বিএনপি বেশি লাভবান হবে বলে মনে করেন পর্যবেক্ষকরা। যেমন শেখ হাসিনা সভানেত্রী হয়ে আওয়ামী লীগের মিজান, রাজ্জাক, ফরিদগাজী— সব গ্রুপকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। ২৮ ফেব্রুয়ারির খবরের কাগজে বেরিয়েছে, বেগম খালেদা জিয়া জাতীয় ঐক্যের ডাক দেবেন শিগগিরই। যার দলই বহুভাগে বিভক্ত সেখানে দলকে ঐক্যবদ্ধ না করে জাতীয় ঐক্যের ডাক কি সফল হবে? আর বি. চৌধুরী, কর্নেল (অব.) অলি ও বিএনপি ত্যাগীদের নিয়ে ‘জাতীয় ঐক্যের’ বিষয় হবে হাস্যকর। জাতীয় ঐক্যে অন্য যাদের প্রতি ইঙ্গিত আছে, জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক থাকলে তারা যে বেগম জিয়ার সঙ্গে কোনো ঐক্য প্রক্রিয়ায় যুক্ত হবেন না, তা তো অনেক আগেই তারা জানিয়ে দিয়েছেন। ড. কামাল, কাদের সিদ্দিকী, সিপিবি, বাসদ, জাসদ এদের অবস্থান এ ব্যাপারে স্পষ্ট। বেগম জিয়া আসলে কী করতে চান, তিনি যা করতে চান তাকে ঘিরে রাখা ‘কুতুব’রা তা করতে দেবে কিনা, তারা বাধা দিলে তিনি সে বাধা উপেক্ষা করতে সক্ষম কিনা, বিষয়গুলো স্পষ্ট হওয়া দরকার।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট

ই-মেইল : [email protected]

সর্বশেষ খবর