মঙ্গলবার, ২২ জানুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

শুভ চেতনার উদয় হোক

শাম্মী আক্তার

দুঃখ হচ্ছে ওইসব মেয়ের জন্য যারা বা যাদের পরিবার আহমদ শফীর মতাদর্শে বিশ্বাসী। বাংলাদেশে যেখানে ছেলেমেয়েরা সমান্তরালভাবে এগিয়ে যাচ্ছে; পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের সব ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে সেখানে সেই দেশের জনগোষ্ঠীর একাংশকে অন্ধ করে রাখতে চাচ্ছেন আহমদ শফীর মতো মানুষ। পাশাপাশি আমরা এও শুনেছি তাদের জন্মনিরোধক ব্যবহারে অনুৎসাহিত করা হয়েছে। এ যেন বংশপরম্পরায় অনুসারী বৃদ্ধি করার এক সূক্ষ্ম কৌশল! যদি আমরা শহরের মানুষের সঙ্গে গ্রামের মানুষের জীবনমান তুলনা করি তাহলে দেখা যাবে গ্রামের মেয়েদের শিক্ষিত হওয়া বেশি জরুরি। না হলে দিনমজুর পরিবারের একজন মেয়ে দিনমজুরই হবে এবং অশিক্ষিত পরিবারের একজন মেয়ে আজীবন অশিক্ষিত হয়ে অন্ধকারেই থেকে যাবে। এর ফলে একদিকে যেমন এরা দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র থেকে মুক্তি পাবে না তেমন অন্ধকার জীবনের মধ্যেই ঘুরপাক খেয়ে শেষ হবে জীবনচক্র। এটা একদিকে যেমন পরিবারের জন্য অভিশাপস্বরূপ তেমন এই শ্রেণির মানুষ সমাজ ও জাতির জন্য বোঝাস্বরূপ। কিন্তু শুধু একটা ম্যাজিকাল পাওয়ার এ অভিশাপকে আশীর্বাদে রূপান্তর করতে পারে। তা হচ্ছে শিক্ষা। সব সম্পদের সম্পদ হচ্ছে ‘শিক্ষাসম্পদ’। বাংলাদেশে অবৈতনিক শিক্ষাব্যবস্থায় সবাই এ সম্পদের গর্বিত অংশীদার হতে পারে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে দেখা যাচ্ছে, একটা শ্রেণি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর চোখ বন্ধ করে তাদের সম্পদহীন করতে চায়, দাস বানাতে চায়, মানসিকভাবে পঙ্গু করে রাখতে চায়। বাংলাদেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠী যেখানে নারী সেখানে তাদের অক্ষম, অথর্ব করে রাখা মানে হচ্ছে দেশটাকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দেওয়া। আহমদ শফী যদি বলতেন যে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি তৎক্ষণাৎ মৃত্যুদণ্ড বা যৌন নিপীড়নের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করি তাহলে মনে হয় অনেক বেশি সমীচীন হতো। আহমদ শফী যদি বলতেন যে আমরা শিক্ষা ক্ষেত্রে, কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমতা নিশ্চিত হোক এ দাবি জানাই তাহলে খুশি হতাম। কর্মক্ষেত্রে, শিক্ষা ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের অনুপাত সমান হলে দেখা যাবে যৌন নিপীড়ন শব্দটার আর অস্তিত্ব থাকবে না।

তিনি যদি বলতেন আসুন আমরা পুরুষরা সবাই মিলে আমাদের মেয়েদের জন্য, বোনদের জন্য একটি নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করি যাতে সবাই সমানভাবে পরিবার গঠনে, সমাজ গঠনে, দেশ গঠনে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারে তাহলে কতই না শ্রুতিমধুর হতো! তিনি যদি বলতেন আসুন আমরা পুরুষরা নিজেদের সংযত করি কারণ মেয়েদের দিকে কুরুচিপূর্ণ দৃষ্টি দিয়ে তাকানো ব্যভিচারের শামিল সেজন্য আসুন আমরা আমাদের দৃষ্টি, মন সংযত করি, মানসিকতা উন্নত করি এবং মেয়েদের জন্য পরিবেশ নিরাপদ করি তাহলে তা অনেক বেশি আকর্ষণীয় হতো। তিনি যদি বলতেন যে শিক্ষাই হচ্ছে একমাত্র হাতিয়ার বা শক্তি যা মেয়েদের স্বাবলম্বী এবং পরিবারের, সমাজের চিত্র দারুণভাবে পরিবর্তন করতে পারে। আসুন আমরা সবাই তাদের প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য, নিরাপদ পরিবেশ তৈরির জন্য সোচ্চার হই তাহলে কতই না সুন্দর হতো! তিনি যদি বলতেন যেহেতু সব রকমের অসচ্ছলতা, অপুষ্টির কারণ হচ্ছে অশিক্ষা। তাই আসুন আমরা সবাই মিলে সমাজের সব রকমের কুসংস্কার দূর করে মেয়েদের শিক্ষিত করি, ছেলেদের মতো তাদেরও সম্পদে পরিণত করে তাদের আলোয় আলোকিত করি সমাজ ও দেশ। তাহলে তা অনেক বেশি আকর্ষণীয় হতো। তিনি যদি বলতেন আসুন আমরা পুরুষদের ওপর নজরদারি বাড়িয়ে দিই যাতে আমাদের মেয়েরা নিশ্চিন্তে নির্বিঘ্নে চলাফেরা করতে পারে, তা অনেক বেশি প্রশংসনীয় হতো।

তিনি যদি বলতেন আসুন আমরা আমাদের মেয়েদের সর্বোচ্চ শিক্ষা নিশ্চিত করি যাতে খুব দ্রুতই সেই সোনালি সময় আসে যেখানে ছেলে-মেয়ের কর্মক্ষেত্রে অনুপাত সমান থাকবে যা কিনা যৌন নিপীড়ন নির্মূলের অন্যতম অনুঘটক হবে।

মেয়েদের শিক্ষিত হওয়া মানে প্রাপ্ত বয়সে তাদের বিয়ে হওয়া, প্রাপ্ত বয়সে বিয়ে হওয়া মানে পুষ্ট সন্তান জন্মদান, পুষ্ট সন্তান মানে তার বুদ্ধিবৃত্তিক, শারীরিক বৃদ্ধি, মানসিক ও আবেগীয় বৃদ্ধি ভালো আর একটা বুদ্ধিদীপ্ত শিশু একটি ভালো চক্রের সূচনাকারী। মেয়েদের শিক্ষিত হওয়া মানে একটি স্বাবলম্বী পরিবারের সূত্রপাত হওয়া, মেয়েদের শিক্ষিত হওয়া মানে একটি শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর সূত্রপাত হওয়া, মেয়েদের শিক্ষিত হওয়া মানে একটি কর্মক্ষম পরিবারের সূত্রপাত হওয়া, মেয়েদের শিক্ষিত হওয়া মানে দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রের বিনাশ হওয়া, মেয়েদের শিক্ষিত হওয়া মানে পরিবারের সৌন্দর্য বর্ধন হওয়া। আশা করি সবার সঠিক উপলব্ধি হবে এবং শুভ চেতনার উদয় হবে এবং বাংলাদেশ দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাবে। জাতিসংঘের ১৯৩টি দেশ স্বাক্ষরিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাসমূহের (এসডিজি) মধ্যে অন্যতম ৪ নম্বর লক্ষ্যে স্পষ্টভাবে নারী শিক্ষার কথা বলা হয়েছে। তা হলো- সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করে ন্যায্য ও মানসম্মত শিক্ষা এবং সবার জন্য আজীবন শেখার সুযোগ সৃষ্টি করা যা কিনা ১. সব দেশ থেকে সব ধরনের দারিদ্র্য দূরীকরণ ২. স্বাস্থ্যকর জীবন নিশ্চিত করা এবং সব বয়সী মানুষের জন্য সমৃদ্ধ জীবনের প্রণোদনা প্রদান ৩. লিঙ্গসমতা অর্জন এবং কন্যাশিশু ও নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা ৪. সবার জন্য পানি ও স্যানিটেশন সহজলভ্য করা এবং এর টেকসই ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা ৫. সবার জন্য মানসম্মত কাজ ও উৎপাদনমুখী কর্মসংস্থান নিশ্চিত করার মাধ্যমে টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নকে উৎসাহ প্রদান ইত্যাদি লক্ষ্যের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সুখের বিষয় যে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সংবিধানের ১০ ও ২৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ‘জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে নারীদের অংশগ্রহণ’ এবং ‘রাষ্ট্র ও জনজীবনের সর্বস্তরে নারী-পুরুষের সমান অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায়’ বদ্ধপরিকর। কারণ বাংলাদেশ ও বাঙালি শিক্ষার অমৃত স্বাদ পেয়েছে এবং এ জাতি বিশ্বাস করে শিক্ষার ক্ষেত্রে যে জাতি যত সাফল্য অর্জন করবে, সে জাতি জীবন-জীবিকার মানোন্নয়নে ও মানবিক গুণাবলি বিকাশে ততটাই অগ্রগতি ও সমৃদ্ধি লাভ করবে। আমরা আশাবাদী, আমরা নিশ্চিত। কারণ আমরা জানি কোনো কিছুই শিক্ষানুরাগী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দমাতে পারবে না বরং এগুলো তার গতিকে আরও বেশি বেগবান করবে। জয় হোক শিক্ষার, জয় হোক সব নারীর।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক

ফলিত পুষ্টি ও খাদ্যপ্রযুক্তি বিভাগ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।

ইমেইল : [email protected]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর