রবিবার, ১০ মার্চ, ২০১৯ ০০:০০ টা

রূপান্তরিত নারীদের অধিকার চাই

ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ

রূপান্তরিত নারীদের অধিকার চাই

গত শুক্রবার ছিল আন্তর্জাতিক নারী দিবস। নারীসত্তার মর্যাদা আলাদা করে নিশ্চিত করার একটি দিন। যুগ পাল্টেছে, পাল্টেছে সময়। অসাধারণ নারীদের ক্ষমতা ও অধিকার নিয়ে আমরা যেমন উচ্ছ্বসিত, সাধারণ নারীদের অধিকার ও দাবি নিয়েও তেমনি সোচ্চার। কিন্তু রূপান্তরিত নারীদের কথা আমরা তেমন ভাবি না, বলতে গেলে উদাসীনই থেকে এসেছি বরাবর। রূপান্তরিত নারী, শব্দটি আমাদের কাছে খুব অপরিচিত বলে মনে হয়। নারী তো নারী, নারী আবার রূপান্তরিত কী করে হবে? কিন্তু আশ্চর্য মনে হলেও রূপান্তরিত নারীরা কিন্তু আমাদের খুবই পরিচিত। আমরা সাধারণত এদের চিনি ‘হিজড়া’ হিসেবে। সময় এসেছে আমাদের এ ভুল ধারণা থেকে বের হয়ে আসার। ‘হিজড়া’ একটি সংস্কৃতি বা রীতি। ট্রান্সজেন্ডার বা রূপান্তরিত মানবরা কিন্তু ‘হিজড়া’ নয়। ট্রান্সজেন্ডার বা রূপান্তরিত মানবরা হলো তারা, যারা জন্মের সময় যে জেন্ডার পরিচয় নিয়ে জন্মায় তার সঙ্গে তাদের আচরণের মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। অর্থাৎ দৈহিকভাবে পুরুষ হলেও মানসিকভাবে তারা এক একজন নারী। ট্রান্সজেন্ডারদের মাঝে অনেকে হরমোন থেরাপি বা অপারেশনের মাধ্যমে নিজেদের যৌনাঙ্গ পরিবর্তন করে। আর তাদেরই আমরা বলি রূপান্তরিত নারী।

ধরুন পুরুষ হিসেবে জন্ম নেওয়া একজন মানুষ নিজেকে পরিবর্তন করে নিল একজন নারী হিসেবে। সে নারীদের মতো লম্বা চুল রাখল, নিজেকে সাজাল শাড়িতে, চুড়িতে, কাজলে। তাকে এ সমাজ কিন্তু সহজভাবে মেনে নিতে পারে না। পারিবারিক ও সামাজিক শত অপমান আর লাঞ্ছনার ভিতর দিয়ে যেতে হয় সেই মানুষটিকে। অনেককেই সর্বপ্রথম হারাতে হয় নিজের পরিবারকে। সে না পায় শিক্ষার সুযোগ, না খুঁজে পায় রোজগারের উপায়। মানুষটি হয়ে পড়ে খুব একা। তখন হয়তো সে গিয়ে যোগ দেয় কোনো ‘হিজড়া’ ডেরায়। এ পর্যায়ে সে এসে শিকার হয় আরও নির্যাতন ও ঘৃণার। অনেকেই অভিযোগ করেন রাস্তায় ‘হিজড়ারা’ খুব বিরক্ত করে টাকা চেয়ে চেয়ে। বাচ্চা হওয়া কিংবা বিয়েবাড়ি সবখানেই উপস্থিত হয়ে যায় হিজড়ারা। কিন্তু এহেন ব্যবহারের পেছনের কষ্টের গল্পটা কিন্তু আমরা ভেবে দেখি না, হয়তো জানিই না। সমাজই কিন্তু বাধ্য করছে তাদের এ কাজে। আমরা কি এই রূপান্তরিত নারীদের কর্মসংস্থান করে দিতে পেরেছি? আমাদের সমাজ যেখানে এখনো পুরোপুরি নারীবান্ধব নয়, সেখানে এই রূপান্তরিত নারীদের জন্য তো আরও নয়।

এ তো গেল সামাজিক গ্রহণযোগ্যতার কথা। সামাজিকভাবে হেয় হয়েও বাঁচতে গেলে মানুষের কিছু চাহিদা তো থেকেই যায়। পেটের ক্ষুধা কিংবা রোগবালাই তো জেন্ডার বোঝে না। কখনো কি ‘হিজড়া’ ডেড়ায় গিয়েছেন? গেলে বুঝতে পারবেন, এভাবে বেঁচে থাকা কত কঠিন। আয়ের টাকার প্রায় পুরোটা চলে যায় ‘গুরু’র কাছে। কেউ আলাদা থাকতে চাইলে তাও সম্ভব হয় না। আমাদের এ দেশে একলা একজন নারী বাসা ভাড়া পায় না, সেখানে একজন রূপান্তরিত নারী বাসা ভাড়া চাইলে যে তাকে তাড়িয়ে দেওয়া হবে সেটাই তো স্বাভাবিক। অসুস্থ হলে তাদের হাসপাতালে ভর্তি করাও হয়ে পড়ে এক যুদ্ধ। মহিলা ওয়ার্ডে নিয়ে গেলে বাকি নারী রোগীদের কাছ থেকে আসে প্রতিবাদ। অনেকেই বলেন রূপান্তরিত নারীরা শিক্ষিত না হওয়ায় তাদের চাকরি দেওয়া সম্ভব হয় না। কিন্তু তারা শিক্ষিত হতে পারছে না কেন? কারণ তাদের আচরণ বাকি সহপাঠীদের থেকে ভিন্ন হওয়ায় প্রথম বৈষম্যের শিকার হতে হয় সহপাঠী ও শিক্ষকদের কাছ থেকেই। এ কারণে স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেয় অনেকেই। কেউ বা স্কুল পেরোলেও একবার নারী হিসেবে নিজেকে সাজালে কোনো প্রতিষ্ঠানেই তাদের ভর্তি করতে চায় না।

বর্তমান সরকার হিজড়া জনগোষ্ঠীকে দিয়েছে তৃতীয় লিঙ্গের স্বীকৃতি। কিন্তু তাতে কি তারা পাচ্ছে তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার? উত্তরটি হচ্ছে, না। তারা নিজেদের বলছে রূপান্তরিত নারী। তারা তাদের নাম বদলে ফেলছে, তারা বদলে ফেলছে তাদের রূপ। কিন্তু জাতীয় পরিচয়পত্রে কি পরিবর্তন হয়েছে? হয়নি। গত নির্বাচনেও তারা অনেকেই পারেনি তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে। ভোট দিতে গিয়ে দাঁড়াতে পারেনি তারা কোনো লাইনেই। তাদের কেউ কেউ হয়তো গিয়ে দাঁড়িয়েছে এবং ভোটও দিয়েছে কিন্তু সে তো আগের নামে।

কিছুদিন আগেও আমরা সংবাদপত্রগুলোয় দেখতে পেয়েছি সংসদের নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসনে লড়াই করার জন্য মনোনয়নপত্র কিনেছেন বেশ কয়েকজন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ। কেন তারা নারী আসনের জন্য মনোনয়নপত্র কিনলেনÑ এ প্রশ্নের উত্তরে তারা বলেন, তারা নিজেদের নারী হিসেবে ভাবেন। কিন্তু তারা ভাবলেও সমাজ তো ভাবে না। আমাদের সংবিধানেও তো নারী বা পুরুষের বাইরে আলাদা করে কিছু বলা নেই। তাই বলা চলে গণতান্ত্রিক অধিকার চর্চা ও অধিকার নিশ্চিত করা থেকেও বঞ্চিত এই রূপান্তরিত নারীরা।

এবার আসি সম্পত্তি পাওয়ার অধিকার ও বাস্তবতা প্রসঙ্গে। বাংলাদেশে সম্পত্তি বণ্টনের ক্ষেত্রে আমরা ধর্মীয় আইন মেনে চলি। ফিকাহ ও বিভিন্ন ইসলামী পণ্ডিতের মতবাদ অনুযায়ী এই মানুষদের সম্পত্তি পাওয়ার ব্যাপারে বলা রয়েছে। কিন্তু লোভের কারণে তাদের বঞ্চিত করা হয় এ অধিকার থেকে। ইমাম শাফি বর্ণিত একটি পন্থা হলো, যাদের মাঝে পুরুষালি বৈশিষ্ট্য বেশি তারা পুরুষের মতো এবং যাদের মাঝে নারীসুলভ বৈশিষ্ট্য বেশি তারা নারীর মতো অংশ পাবে। আরেকটি পন্থা হলো, তারা সম্পত্তির সবচেয়ে ছোট অংশটি পাবে। কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখতে পাই, রূপান্তরিত হওয়ার পরে তারা উত্তরাধিকারী হিসেবে কোনো সম্পত্তিই পায় না, এ বিষয়ে আদালতে গিয়েও কোনো  লাভ হয় না। এমনও ঘটনা ঘটেছে যে, রূপান্তরিত নারীদের মৃত্যুর পর তাদের কবর দেওয়ার জন্য একটু স্থান পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়ছে।

আমরা বলি, সমাজ এগিয়ে যাচ্ছে। নারীরা এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু একটি জনগোষ্ঠীকে এড়িয়ে গিয়ে কি আমরা সত্যি এগিয়ে যেতে পারি? এই রূপান্তরিত নারীরাও কিন্তু সুযোগ পেলে অনেক এগিয়ে যেতে পারবে। তাদের মাঝেও রয়েছে অনেক মেধা ও মনন। শারীরিক কিংবা মানসিক, সব রূপেই সব নারী অনন্য। নারী এবং রূপান্তরিত নারী সবাই মানুষ। সবাই একসঙ্গে কাজ করলে সব বাধা পার হওয়া সম্ভব। আমরা যদি রূপান্তরিত নারীদের আলাদা না ভেবে আমাদের মতোই একজন ভাবতে শুরু করি, তাহলে হয়তো তাদের অবস্থান পরিবর্তন করা খুব কঠিন কিছু হবে না। আসলে পরিবর্তন দরকার আমাদের সবার মাঝে, আমাদের সবার মানসিকতায়।

            লেখক : আইনজীবী ও আইনের শিক্ষক।

সর্বশেষ খবর