শুক্রবার, ৮ নভেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

৩ ও ৭ নভেম্বরের অভিঘাত থেকে মুক্ত হতে হবে

মেজর জেনারেল এ কে মোহাম্মাদ আলী শিকদার পিএসসি (অব.)

৩ ও ৭ নভেম্বরের অভিঘাত থেকে মুক্ত হতে হবে

স্বাধীনতা-উত্তর বহমান বাংলাদেশের বাঁকে ১৯৭৫ সালের ৩ ও ৭ নভেম্বরের দুটি ঘটনার পারস্পরিক সম্পর্ক ও তার অভিঘাত থেকে জাতি এবং রাষ্ট্র হিসেবে আমরা এখনো বের হতে পারিনি। যেমনটি পারিনি ’৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পরিণতি থেকে। স্বাধীনতা অর্জনের সুবর্ণজয়ন্তী পালনের দুই বছর আগেও আজ আমাদের ভাবতে হচ্ছে আবার না, কখন সেই ’৭৫-এর অপশক্তি রাষ্ট্রের ওপর চেপে বসে। যেমনটি ’৭৫-এর পরে তারা বসেছিল এবং দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থেকে আমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জনগুলো তছনছ করে ছেড়েছে। তাই নভেম্বরের প্রথমার্ধে কোনো লেখা লিখতে বসলে অভিঘাতের সেই তারিখ ৩ ও ৭ নভেম্বরের কথা মনে পড়ে। ভাবী, ’৭১ সালে আমরা তখনকার তরুণরা অসামান্য ঝুঁকি নিয়ে ত্যাগ স্বীকার করে বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছিলাম। আজকের তরুণরা যদি একটু জেগে ওঠে, সজাগ হয় তাহলে ওই ’৭৫-এ আবির্ভূত অপশক্তি থেকে মুক্ত হয়ে আবার আমরা স্বাধীনতার পূর্ণতায় দেশকে ফিরিয়ে নিতে পারি, যার স্বরূপটি তৈরি হয়েছিল ’৭২-এর সংবিধানের মধ্য দিয়ে। ’৭১-এ আমরা সফল হয়েছিলাম বলেই আজকের তরুণরা বিশ্বব্যাপী মাথা উঁচু করে বলতে পারছে আমরা স্বাধীন বাংলাদেশের গর্বিত নাগরিক, যে বাংলাদেশের তরুণ সমাজ পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর যুদ্ধ ও হত্যাযজ্ঞের কাছে মাথা নত না করে মাত্র নয় মাসে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিল। তাই ’৭১-এর তরুণদের ত্যাগের ফসল ’৭৫ সালে যারা ছিনতাই করেছে এবং এখনো ছদ্মবেশী রাজনীতির আশ্রয়ে ষড়যন্ত্র করে চলেছে তাদের চূড়ান্তভাবে পরাজিত করার দায়িত্বটা আজকের তরুণ সমাজকে নিতে হবে। এই যুদ্ধটা হলো সঠিক উপলব্ধি, বুদ্ধি আর কৌশলের যুদ্ধ, ’৭১-এর মতো ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞের যুদ্ধ নয়। আজকের যুদ্ধটা মূলত রাজনৈতিক যুদ্ধ, আর ’৭১-এ ছিল সশস্ত্র যুদ্ধ। আজকের যুদ্ধটা কঠিন ও সময়সাপেক্ষ। তবে ’৭১-এর মতো ভয়াবহ নয়।

’৭১-এ শত্রু চেনা সহজ ছিল আজকে তেমনটি নয়। কারণ শত্রুরা আজ বাংলাদেশি চাদর পরে আছে। এই চাদর পরা বাংলাদেশিরা নিজেদের আবার মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি বলে দাবি করে। যদিও ২০০১-২০০৬ মেয়াদে নিজেদের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকা সত্ত্বেও যে দুজন যুদ্ধাপরাধী জামায়াতের মন্ত্রী বানিয়েছিলেন, তারা প্রকাশ্যে বলেছে, এ দেশে কোনো মুক্তিযুদ্ধ হয়নি। আগ বাড়িয়ে যাদের মন্ত্রিত্ব দেওয়া হলো, সেই মন্ত্রীরা যখন বলে এ দেশে কোনো মুক্তিযুদ্ধ হয়নি তখন তারা নিজেদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি বলে মিডিয়ায় বুলি আওড়ালে সেটিকে কী বলা যায়। কিন্তু তারা এ রকম প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে লাভবান হয়েছে বলেই আগস্ট ও নভেম্বর এলে এদের মুখোশ উন্মোচন করার জন্যই সে সময়ের ঘটনাবলি এবং পরবর্তীতে তাদের কার্যকলাপ তুলে ধরার প্রয়োজন হয়। তাই ’৭৫ সালের ৩ ও ৭ নভেম্বরে কী ঘটেছিল এবং তার প্রধান পৃষ্ঠপোষক, সুবিধাভোগী ও উত্তরসূরিদের আজকের পরিচয়টি সঠিক এবং যৌক্তিকভাবে তুলে ধরার জন্যই আজকের লেখা। তবে ৩ ও ৭ নভেম্বরের কথা বলতে গেলেই ১৫ আগস্টের কথাও অবধারিতভাবে আসবে। কারণ, এ তিনটি ঘটনা একই সূত্রে গাঁথা। ’৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কারা জাতির পিতাকে হত্যা করেছিল তা দেশের সর্বোচ্চ আদালত রায়ের মাধ্যমে স্পষ্ট করে বলে দিয়েছে। শুধু আদালত নয়, দেশি-বিদেশি গবেষক, লেখক ও সাংবাদিকদের প্রাঞ্জল বর্ণনায়ও তা এখন পাওয়া যাচ্ছে। সবকিছু মিলে এটা এখন দিনের মতো পরিষ্কার যে, ১৫ আগস্ট, ৩ ও ৭ নভেম্বরের হত্যাকা- যারা ঘটিয়েছে তাদের উদ্দেশ্য ছিল মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশকে হত্যা করা। এসব হত্যাকা-ের সুবিধাভোগী হিসেবে যারা ’৭৫ ও আশির দশকে এবং পরবর্তীতে জামায়াতকে নিয়ে ক্ষমতায় থেকেছে তাদের রাষ্ট্র পরিচালনা ও রাজনীতির প্রতিটি কর্মকা- প্রমাণ করে এখানে তারা বাংলাদেশের নামের খোলসে আরেকটি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আপ্রাণ চেষ্টা করেছে। ’৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর রাষ্ট্রপতির পদ দখল করলেন খোন্দকার মোশতাক। সেনাবাহিনী প্রধান হলেন বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়াউর রহমান। আর ১৫ আগেস্টের খুনি মেজররা বঙ্গভবনে বসে রাষ্ট্রের সর্বত্র ছড়ি ঘোরাতে শুরু করলেন। বিশৃঙ্খলা, উচ্ছৃঙ্খলতা এবং সশস্ত্র বাহিনীর চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়ে। এটা এখন সবাই জানেন মুক্তিযুদ্ধ চলার সময় থেকেই জিয়াউর রহমান ভীষণ উচ্চাভিলাষী ছিলেন। তাই ’৭৫ সালের ২৪ আগস্ট সেনাবাহিনী প্রধান হয়ে তিনি উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করার লক্ষ্যে একাধারে খুনি মেজরদের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার কূটকৌশল অবলম্বন এবং সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে প্রতিদ্বন্দ্বী মুক্তিযোদ্ধা জেনারেলদের কোণঠাসা করার কৌশল গ্রহণ করেন। তাতে তিনি নির্ভরশীল হয়ে পড়েন পাকিস্তান থেকে প্রত্যাবর্তিত অমুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের ওপর। ফলে সেনাবাহিনীর ভিতরে অন্তর্দ্বন্দ্ব, হতাশা, অস্থিরতা এবং অসন্তোষ চরম আকার ধারণ করে। সেনাবাহিনীসহ রাষ্ট্রের প্রশাসনের ভিতরে পরস্পরবিরোধী বহুমুখী গ্রুপের সৃষ্টি হয়। যার প্রথম গ্রুপে ছিলেন জেনারেল জিয়া ও তার অনুসারীরা। দ্বিতীয় গ্রুপে ছিলেন জেনারেল খালেদ মোশাররফ ও কর্নেল শাফায়াত জামিল, ঢাকার ব্রিগেড কমান্ডার। তৃতীয় গ্রুপে ছিলেন কর্নেল তাহের ও তার জাসদের গণবাহিনী এবং বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা। চতুর্থ গ্রুপে ছিলেন বঙ্গভবনে অবস্থানকারী ১৫ আগস্টের খুনি মেজররা ও মোশতাক। ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করতে না পারায় জেনারেল জিয়া সব গ্রুপের প্রতিই ভিতরে ভিতরে ক্ষুব্ধ ছিলেন। কিন্তু বঙ্গভবনে খুনি মেজররা ও কর্নেল তাহেরের সঙ্গে জিয়া প্রকাশ্যে ও গোপনে সব সময় একটা যোগাযোগ রক্ষা করে চলছিলেন। খুনি মেজরদের উচ্ছৃঙ্খলতা ও ঔদ্ধত্য আচরণ এবং জিয়া কর্তৃক ওদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়ার কারণে সেনানিবাসের বেশির ভাগ অফিসার জেনারেল খালেদ মোশাররফ ও কর্নেল শাফায়াতের দিকে ঝুঁকে পড়েন। সৈনিকের মধ্যে ছিল বহুমুখী বিভ্রান্তি। অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতার মধ্যেও খালেদ মোশাররফ ও শাফায়াত জামিলের নেতৃত্বে ৩ নভেম্বর ভোর হতে হতেই আরেকটি রক্তপাতহীন ও নীরব অভ্যুত্থান সম্পন্ন হয়ে যায়। জেনারেল জিয়াকে তার বাসায়ই গৃহবন্দী করা হয়। বঙ্গভবনের মেজররা সারা দিন দরকষাকষি শেষে সন্ধ্যার পরপর দেশ ত্যাগ করে চলে যায়। এই সময়ের মধ্যেই অর্থাৎ খালেদ মোশাররফের ক্যু শুরু হওয়ার প্রথম ধাপেই ২ নভেম্বর দিবাগত রাতে, ৩ নভেম্বরের শুরুতে দেশের সবচেয়ে নিরাপদ স্থান ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারের ভিতরে হত্যা করা হয় জাতীয় চার নেতাকে, অত্যন্ত নৃশংস ও বর্বরতার সঙ্গে। পরিস্থিতির বিশ্লেষণে মনে হয় ১৫ আগস্টে চার নেতাকে অন্যদের সঙ্গে হত্যা না করে মোশতাক একটা সুযোগ নেওয়ার পথ খোলা রেখেছিলেন, যদি ওই চার নেতাকে দলে ভেড়ানো যায় তাহলে সেটা হতো মোশতাকের জন্য সোনায় সোহাগা। কিন্তু প্রথম চেষ্টায় তা সম্ভব না হওয়ায় চার নেতাকে জেলে ঢোকানো হয়, যাতে সময় সুযোগ মতো খুনিরা যে কোনো প্ল্যান কার্যকর করতে পারে। ওই সময়ের যে বিবরণ পাওয়া যায় তাতে দেখা যায় খালেদ মোশাররফের ক্যু শুরু হওয়ার কয়েক ঘণ্টা পরে জেলখানায় হত্যাকা- সংঘটিত হয়। ১৫ আগস্টের হত্যাকা-ের মাধ্যমে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীরা মুক্তিযুদ্ধের সব আদর্শ বাতিল করে পাকিস্তানের আদর্শ ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিল। এ চার নেতাই বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে আপসহীনভাবে এগিয়ে নিতে পারতেন। শত্রুপক্ষ ঠিকই তা বুঝেছিল। তাই দেখা গেল খুনিরা যখন বুঝতে পারল তারা আর ক্ষমতায় থাকতে পারছে না, তখনই পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী জেলের ভিতরে চার নেতাকে হত্যা করা হলো যাতে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের আদর্শসংবলিত রাষ্ট্র হতে না পারে। জেনারেল খালেদ মোশাররফ যদি এই ষড়যন্ত্রটি উপলব্ধি করতে পারতেন এবং দূরদৃষ্টি ও কৌশলের মাধ্যমে ঘাতক দল জেলখানায় পৌঁছানোর আগেই জেলখানা থেকে চার জাতীয় নেতাকে মুক্ত করে সাংবিধান পুনরুজ্জীবিত করার ঘোষণা দিতেন, তাহালে স্বাধীনতার শত্রুদের সব ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়ে যেত। জেনারেল জিয়া ৬ নভেম্বর দিবাগত রাত ১২টার পরপরই মুক্ত হয়ে যান। আর খালেদ মোশাররফসহ তিনজন সর্বোচ্চ খেতাবপ্রাপ্ত মুুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করা হয় ৭ নভেম্বর সকালে নাশতা খাওয়ার সময়। জেনারেল খালেদ মোশাররফকে কার হুকুমে হত্যা করা হলো? জেনালেন জিয়া ও কর্নেল তাহের যথেষ্ট সময় পেয়েও কেন খালেদ মোশাররফকে বাঁচিয়ে রাখতে পারলেন না। এসব প্রশ্নের উত্তর আজও পাওয়া যায়নি। কিছু উচ্ছৃঙ্খল সেনা সদস্য এবং পূর্বপরিকল্পনা অনুসারে কিছু তথাকথিত জনতা কয়েকটি ট্রাকে ঢাকা শহরে স্লোগান দিল বাংলাদেশ জিন্দাবাদ, পাকিস্তান জিন্দাবাদ। আর এটাকেই একটি রাজনৈতিক পক্ষ আজও বিপ্লব ও সংহতি দিবস বলে যাচ্ছে। কিন্তু তারা কখনো বলতে পারেনি তাদের এই বিপ্লবের নেতা কে, আদর্শ কী। কী ছিল তাদের লক্ষ্য। ’৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ও ৭ নভেম্বরের ঘটনার পেছনে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইর প্রত্যক্ষ হাত ছিল। তার প্রমাণ পাওয়া পায় যখন দেখি জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় বসে জাতির পিতার স্বঘোষিত খুনিদের বিচার আইন করে বন্ধ করে দেন। হত্যাকারীদের উৎসাহিত করার জন্য বড় বড় চাকরির মাধ্যমে পুরস্কৃত করেন। ’৭২-এর সংবিধান রাতারাতি পরিবর্তন করে পাকিস্তানি আদলের সংবিধান তৈরি করেন। একই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের সব ইতিহাস মুছে ফেলে পাকিস্তানের দোসর জামায়াতের মতো যুদ্ধাপরাধীদের স্বাধীন বাংলাদেশে রাজনীতি করার সুযোগ করে দেন। এ কাজগুলো তো বাংলাদেশের কোনো মানুষ করতে পারে না, সমর্থনও করতে পারে না। কিন্তু সেটাই হয়েছে এবং এখনো সেই প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। ’৭৫ সালের ১৫ আগস্ট, ৩ ও ৭ নভেম্বরে সংঘটিত রাষ্ট্রীয় কলঙ্ক যত দিন আমরা পরিপূর্ণভাবে মুছে ফেলতে না পারব, তত দিন আমাদের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা বিপদমুক্ত হবে না। সংঘাতহীন উন্নত শান্তিময় বাংলাদেশ চাইলে ’৭৫ সালের ১৫ আগস্ট, ৩ ও ৭ নভেম্বরের কলঙ্ক ও অভিঘাত থেকে মুক্ত হতে হবে।

লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

[email protected]

সর্বশেষ খবর