রবিবার, ৮ মার্চ, ২০২০ ০০:০০ টা

ইমাম তিরমিজি ইন্তেকাল করেছেন রজব মাসে

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

ইমাম তিরমিজি ইন্তেকাল করেছেন রজব মাসে

রসুল (সা.)-এর পবিত্র মুখ নিঃসৃত বাণীকে হাদিস বলে। সহি হাদিস ইসলামী আইনের দ্বিতীয় উৎস। প্রথম উৎস হলো আল কোরআন। শুরুতে হাদিসগুলো মুখে মুখে প্রচার হতো। পরবর্তীতে সংরক্ষণের জন্য হাদিস লেখার প্রয়োজন দেখা দেয়। তখন বহু মনীষী পুরো জীবনটাই হাদিসের জন্য উৎসর্গ করেন। ইমাম বুখারি-মুসলিমসহ জানা-অজানা অসংখ্য মানুষ হাদিসের খেদমত করে মুসলিম উম্মাহর কাছে চিরঋণী হয়ে আছেন। এদের মধ্যে ইমাম তিরমিজির নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। হাদিস শাস্ত্রের প্রথম সারির ইমামদের মধ্যে তিনি অন্যতম। হাদিস ও তাফসিরের ওপর বহু গ্রন্থ প্রণয়নের পরও শামায়েলে তিরমিজি এবং সুনানে তিরমিজির জন্য দুনিয়াব্যাপী নবী প্রেমিকদের মুখে প্রতিনিয়ত তার নাম স্মরণ হচ্ছে শ্রদ্ধার সঙ্গে। ইমাম তিরমিজির মূল নাম হলো মুহম্মদ। তার উপাধি আবু ঈসা। আবার তার বাবার নামও ঈসা। দাদার নাম সাওরাহ। ২০৯ অন্য বর্ণনা মতে ২১০ হিজরি সনে খোরাসান বর্তমান তাজিকিস্তানে তিনি জম্মগ্রহণ করেন। ওই সময় তাজিকিস্তান ছিল জ্ঞান-বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ এক নগরী। বিশেষ করে শহরটি ইসলামী জ্ঞানের বেলাভূমি হিসেবে খ্যাতি পেয়েছিল। এই অঞ্চলে এত বেশি আলেম-জ্ঞানীর বসবাস ছিল যে, ঐতিহাসিকরা একে মাদিনাতুর রিজাল বা হাদিস গবেষকদের শহর বলে উল্লেখ করেছেন। জ্ঞান-বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ খোরাসানে জম্মগ্রহণ করার কারণে এখানেই তিনি বাল্যশিক্ষা সমাপ্ত করেন। ইলমে দীনের উচ্চস্তরের শিক্ষার পাঠও তিনি এখান থেকেই নেন। পরবর্তীতে বাগদাদ, মিসর এবং সিরিয়ার মাদ্রাসাগুলো থেকেও তিনি ডিগ্রি নিয়েছেন। তার অসংখ্য শিক্ষকের মধ্যে ইমাম বুখারি, মুসলিম এবং ইমাম আবু দাউদের নাম উল্লেখযোগ্য। ইমাম তিরমিজি এতই মেধাবী ছিলেন যে, তার শিক্ষক ইমাম বুখারি বলেন, হে আবু ঈসা! তুমি আমার থেকে যতটুকু শিখেছ, আমি তোমার থেকে তার চেয়ে বেশি শিখেছি। ইমাম তিরমিজির সূত্রে ইমাম বুখারি অনেক হাদিস বিভিন্ন সময় বর্ণনা করেছেন। এ থেকেই বোঝা যায়, ইমাম তিরমিজি কত বেশি বিশ্বস্ত এবং মেধাশক্তির অধিকারী ছিলেন। বলাই বাহুল্য, পরিপূর্ণ বিশ্বস্ত খাঁটি মুসলমান ছাড়া ইমাম বুখারি অন্য কারও থেকে হাদিস বর্ণনা করেননি।

ইমাম তিরমিজির মেধা শক্তির ব্যাপারে একটি মজার ঘটনা জানা যায়। একবার তিনি তার এক শিক্ষককে বললেন, আমাকে কিছু হাদিস শোনান হে শায়খ। তখনকার নিয়ম ছিল- শিক্ষক নতুন কোনো হাদিস শোনালে ছাত্ররা তা লিখে ফেলত। কিন্তু ইমাম তিরমিজি তা লেখেননি। এতে করে শিক্ষক একটু রাগ করে বললেন, ওহে আবু ঈসা! তুমি লিখছ না কেন। ইমাম তিরমিজি বললেন, আপনি যা বলেছেন, একবার শোনাতেই তা আমার মুখস্থ হয়ে গেছে, তাই আর লেখার প্রয়োজন মনে করছি না। তখন ইমাম তিরমিজি সবাইকে অবাক করে দিয়ে সব হাদিস শায়েখকে মুখস্থ শুনিয়ে দিলেন। কিন্তু শায়েখ কোনোভাবেই ইমাম তিরমিজির এমন প্রখর স্মৃতিশক্তিকে বিশ্বাস করে উঠতে পারছিলেন না। তিনি বললেন, আবু ঈসা! তুমি হয়তো হাদিসগুলো অন্য কোনো শায়েখ থেকে আগে শুনে থাকবে। ঠিক আছে এখন আমি তোমাকে একদম নতুন কিছু হাদিস শোনাব, যেগুলো আমি বহু কষ্টে সংগ্রহ করেছি। অবিশ্বাস্যভাবে ইমাম তিরমিজি নতুন হাদিসগুলোও একবার শোনার পর হুবহু মুখস্থ শুনিয়ে দিলেন। তখন শায়েখ এই শিষ্যের জন্য প্রাণভরে দোয়া করলেন। শেষ বয়সে ইমাম তিরমিজি অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু তার স্মৃতির প্রখরতা কখনো কমেনি। একবার তিনি ছাত্রদের নিয়ে একটি সফরে বেরিয়েছেন। এক সময় একটি মাঠে এসে তিনি বললেন, এটা সেই মাঠ না? এখানে মাথা নিচু করে যাও, নয়তো গাছের সঙ্গে মাথায় ধাক্কা লাগবে। ছাত্ররা চারদিকে চেয়ে দেখে আশপাশে কোনো গাছ নেই। তখন তারা জিজ্ঞেস করল, উস্তাদজি এখানে তো কোনো গাছ দেখছি না। ইমাম তিরমিজি বললেন, এখন তো আর চোখে দেখি না, কিন্তু অনেক বছর আগে যখন এসেছিলাম তখন ঠিক এই জায়গাতেই একটি বাঁকানো গাছ দেখেছি। আমার কথা যদি মিথ্যে হয়, তাহলে তোমাদের আর হাদিস পড়াব না। ছাত্ররা এলাকার মুরুব্বিদের কাছে খোঁজ নিয়ে জানলেন সত্যিই এখানে একটি গাছ ছিল। আর এ পথে যেতে হলে পথিককে মাথা নিচু করেই যেতে হতো। হাদিস শাস্ত্রের এ মহান ইমাম ২৭৯ হিজরির রজব মাসের ১৩ তারিখে মহান মাবুদের ডাকে সাড়া দেন। ইমাম তিরমিজির জানাজায় এত মানুষ হয়েছে যে, অনেকের ধারণা অসংখ্য ফেরেশতা মানুষের বেশে তার জানাজায় অংশগ্রহণ করেছিলেন।

লেখক : মুফাসসিরে কোরআন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব, চেয়ারম্যান : বাংলাদেশ মুফাসসির সোসাইটি।

www.selimazadi.com

সর্বশেষ খবর