বৃহস্পতিবার, ১২ মার্চ, ২০২০ ০০:০০ টা

ট্রাম্পের ভারত সফর রহস্য

সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

ট্রাম্পের ভারত সফর রহস্য

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভারত দর্শনের পেছনে কী উদ্দেশ্য জড়িত? এ প্রশ্ন অনেকের মনে। আগামী নভেম্বরে আমেরিকার রাষ্ট্রপতি নির্বাচন। এ নির্বাচনে আমেরিকায় প্রায় ১ কোটি ভারতীয় বংশোদ্ভূূত গুজরাটি ভোটার আছেন। তাদের আত্মীয়-পরিজনের মন জয় করার জন্যই ওয়াশিংটন থেকে সোজা দিল্লি না গিয়ে ট্রাম্প সোজা এসে নামলেন মোদির শহর গুজরাটের আহমেদাবাদে। আর আহমেদাবাদের ২০ মাইল পথ ধরে হাজার হাজার মানুষের সংবর্ধনা নিলেন, মোতেরা স্টেডিয়ামে যাওয়ার পথে। ১ লাখ লোকের সমাবেশে তিনি ভারতের বন্ধুত্বের কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে এও বললেন, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান তার বন্ধু। তিনি কাশ্মীর সমস্যা নিয়ে মধ্যস্থতা করতে প্রস্তুত। কাশ্মীর অনেকেরই গলার কাঁটা। মোতেরা থেকে আগ্রায় এসে তাজমহল পরিদর্শন করে দিল্লিতে রাষ্ট্রপতি ভবনে পৌঁছে ওয়াইনের গ্লাসে চুমুক দেওয়ার সময় খবর এসে পৌঁছল যে, দিল্লি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় জ্বলছে। এ বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে ট্রাম্প বলে গেলেন, এটি ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় তাই এতে তিনি নাক গলাবেন না।

আমেরিকার ১ কোটি ভারতীয় বংশোদ্ভূত মানুষের ভোট পাওয়ার জন্য তিনি এতই আগ্রহী যে, তাই তিনি ভারত সফর শুরু করলেন গুজরাট থেকে। ৭৫ বছর আগে জওহরলাল নেহরুর উদ্যোগে প্রস্তুত হয়েছিল নির্জোট আন্দোলন। সে আন্দোলনের জেরে পূর্ব আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্যের প্রভৃতি দেশ একের পর এক স্বাধীন হয় আর ব্রিটিশ তার সাম্রাজ্য গুটিয়ে নেয়। আফ্রিকার দেশগুলো স্বাধীন হওয়ার পর ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে অনেকে চলে যান আমেরিকা এবং কিছু লোক চলে যান লন্ডন ও তার আশপাশ এলাকায়। স্বয়ং মহাত্মা গান্ধীও গুজরাট থেকে দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়ে আইন ব্যবসা করতেন। গুজরাটিরা খুবই স্বাধীন ব্যবসার পক্ষপাতী, আমেরিকায় পূর্ব আফ্রিকা থেকে সবচেয়ে বেশি লোক যায়। মোদি নিজে গুজরাট ও দিল্লিতে আরএসএস স্কুলে পড়াশোনা শেষ করে প্রায় ১৫ বছর ধরে আরএসএসের আদর্শ প্রচারের জন্য আমেরিকার বিভিন্ন জায়গায় গিয়েছেন। সে সুবাদে তার সঙ্গে গুজরাটি ব্যবসায়ীদের পরিচয় হয়। মোদির নিজের ভাষায় বেলুড়মঠে এসে সন্ন্যাসধর্ম গ্রহণ করেন কারণ তিনি সন্ন্যাসী হতে চেয়েছিলেন। তখন বেলুড়মঠের প্রধান সন্ন্যাসী ছিলেন ভরত মহারাজ। ভরত মহারাজ তাকে দীক্ষা দেননি। ভারতীয় বংশোদ্ভূত গুজরাটি ব্যবসায়ীদের ভোট পাওয়া ট্রাম্পের সহায়ক, ২০১৫ সালে নিউইয়র্ক শহরে প্রবাসী গুজরাটিরা তাকে বিপুল সংবর্ধনা জানায়। আর গত বছর হিউস্টনে গিয়ে হাজার হাজার গুজরাটির সামনে ট্রাম্পের হাত ধরে মোদি দৌড়েছেন। তিনি প্রবাসী গুজরাটিদের এ বার্তা দিয়ে এসেছেন- ট্রাম্প আমার বন্ধু, ট্রাম্পকে তোমরা ভোট দাও, আর ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে ট্রাম্পকে গুজরাটে এনে আর একবার বুঝিয়ে দিলেন- বন্ধু ভয় নেই, তুমি আমেরিকার গুজরাটিদের ভোট পাবে। এটাই হলো ট্রাম্প সফরের উল্লেখযোগ্য সাফল্য। ভারতের অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, ট্রাম্পের কয়েক ঘণ্টা গুজরাট সফরে ভারত সরকার খরচ করেছে ৩০০ কোটি টাকা। আহমেদাবাদ শহর সুন্দর করে সাজানো হয়েছিল। জনসভার পর ট্রাম্পকে নিয়ে যাওয়া হয় সবরমতী গান্ধী আশ্রমে। গান্ধী আশ্রমে ট্রাম্পের একটি মন্তব্যকে কেন্দ্র করে ভারতের বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ, সাংবাদিক এবং ভারত ও আমেরিকার বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাবিদরা মোদিকে ধিক্কার জানিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, গান্ধীজি ছিলেন অহিংসার পূজারি আর তার রাজ্যে গিয়ে অস্ত্র বিক্রির কথা বলা শুধু নৈতিকতাবিরোধীই নয়, গান্ধীজিকে অপমান করা। ভারতের বিশিষ্ট কলামিস্টরা বিভিন্ন সংবাদপত্র ও টেলিভিশনের পর্দায় ট্রাম্পের এ ধরনের হীন ব্যবসায়িক মনোভাবের তীব্র নিন্দা করেছেন। ২০০২ সালে গুজরাটের হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার সময় আমেরিকার দুই সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ (জুনিয়র) ও বারাক ওবামা মোদি ও অমিত শাহকে আমেরিকা সফরে নিষিদ্ধ করে দেন। সেই দাঙ্গার ক্ষত এখনো গুজরাটবাসী হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। ২০১৪ সালে লোকসভা নির্বাচনের তিন সপ্তাহ আগে ভারতে নিযুক্ত আমেরিকান রাষ্ট্রদূত যিনি বেশ কয়েক বছর ধরে দক্ষিণ আফ্রিকায় CIA -এর ভারপ্রাপ্ত অফিসার ছিলেন সেই ন্যান্সি পাওয়েল মোদি ও আমিত শাহর ওপর থেকে আমেরিকা সফরের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন। ২০০১ সালে বাংলাদেশের নির্বাচনের সময় ন্যান্সি পাওয়েল ঢাকায় বসে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে খালেদাকে ক্ষমতায় আনেন, ২০০২ সালে গুজরাট দাঙ্গার সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন বিজেপির অটল বিহারি বাজপেয়ি। সেদিন সংসদে দাঁড়িয়ে বাজপেয়ি বলেছিলেন, মোদি রাজধর্ম পালন করছেন না। সেদিন তিনি মোদিকে মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে সরাতেও চেয়েছিলেন। অযোধ্যায় ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ভাঙার নায়ক লালকৃষ্ণ আদভানির চাপে বাজপেয়ি তা পারেননি। এই ন্যান্সি পাওয়েলই যখন ঢাকা থেকে কলকাতায় বদলি হয়ে আসেন তখন তার কাজের অগ্রাধিকারের মধ্যে ছিল বামপন্থিদের হটিয়ে মমতাকে ক্ষমতায় আনা। সে ব্যাপারেও ন্যান্সি পাওয়েল সফল। কলকাতা থেকে তাকে দিল্লিতে বদলি করা হলে দিল্লিতে বসে কেরল, পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরায় বামপন্থিদের উচ্ছেদ করতে সচেষ্ট হয়েছেন। সে সময় মনমোহন সিংয়ের নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশঙ্কর মেনন ওবামা প্রশাসনকে বলে ন্যান্সি পাওয়েলকে দিল্লি থেকে ওয়াশিংটনে ফেরত পাঠিয়ে দেন। ন্যান্সি যেখানেই গিয়েছেন সেখানেই তিনি সরকার উৎখাত করে নিজের পছন্দমতো সরকার গঠন করে গেছেন এ উপমহাদেশে।

ভারতের এক ডজনের অধিক অবসরপ্রাপ্ত কূটনীতিবিদ ট্রাম্পের ৩৬ ঘণ্টা সফরকে কেন্দ্র করে মোদি সরকারের কঠোর সমালোচনা করেছেন। বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে তারা এমন সব মন্তব্য করেছেন যা ভারতের পক্ষে খুবই ক্ষতিকর। এসব কূটনীতিবিদ তাঁদের দীর্ঘ কর্মজীবনে দেখেছেন এবং কাজও করেছেন নিজেদের প্রদর্শিত নির্জোট আন্দোলনের দেখানো পথেই। মোদি ৭৫ বছরের বিদেশনীতি ভেঙে দিয়েছেন। তাই ভারত এখন আমেরিকার তাঁবেদারি ছাড়া আর কিছুই বোঝে না। নির্জোট আন্দোলন কেন করা হয়েছিল, সে ব্যাপারে সাউথ ব্লক নীরব কারণ মোদি তাদের বলেছেন যেহেতু নির্জোট আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা নেহরু তাই তাঁর প্রদর্শিত পথে মোদি সরকার হাঁটবে না।

বিশ্বে একটি প্রচলিত ধারণা আছে, কোনো রাষ্ট্রে আগমনকারী পর্যটক সেই রাষ্ট্রের বিশেষ স্থান পরিদর্শন করার পর সে স্থানের বিষয় তাঁর মন্তব্য ভিজিটরস্ বুকে লিখে যান। আর তাতে সেই স্থানের গুরুত্বের কথাও তাঁরা লেখেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ট্রাম্প নিদর্শন রেখে গেলেন।

ট্রাম্প সবরমতী আশ্রমে গেলেন, মালা দিলেন গান্ধীর প্রতিকৃতিতে এমনকি চরকা কাটার চেষ্টাও করলেন তবে আশ্রমের ভিজিটরস বুকে গান্ধীর কথা না লিখে শুধু বন্ধু নরেন্দ্র মোদির কথাই লিখলেন, যার জেরে বিতর্কের মুখে পড়তে হলো ট্রাম্পকে, গান্ধীর স্মৃতিবিজড়িত আশ্রমে ট্রাম্প আসবেন কিনা সে বিষয়ে সফরের আগের দিন পর্যন্ত অনিশ্চয়তা ছিল কিন্তু নয়াদিল্লির তরফে ওয়াশিংটনকে জানিয়ে দেওয়া হয়, আহমেদাবাদে এসে সবরমতীতে না গেলে ভারতে ভুল বার্তা যাবে, গান্ধী আশ্রমে যেতে রাজি হন ট্রাম্প, খদ্দরের উত্তরীয় পরিয়ে তাদের স্বাগত জানানো হয়, গাইড ছাড়া মোদি নিজেই ট্রাম্প ও তার স্ত্রী মেলানিয়াকে আশ্রম ঘুরিয়ে দেখান। ট্রাম্পের সফরের আর একটা উদ্দেশ্য ছিল চীনকে চাপের মধ্যে রাখা। ট্রাম্প কথা দিয়েছিলেন ভারতে এসে মোদির সঙ্গে সিএএ, এনআরসি, কাশ্মীর ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নিয়ে কথা বলবেন কিন্তু বাস্তবে তিনি যা করে গেলেন সে বিষয়ে আনন্দবাজার পত্রিকায় সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, আহমেদাবাদের বর্ণাঢ্য শোভা, ট্রাম্প মোদির যৌথ সবরমতী আশ্রম পরিভ্রমণ, পরস্পরের ওপর মুগ্ধ প্রশংসাবাক্য বর্ষণ, অগণিত আলিঙ্গন- সব মিলিয়ে ভারত সরকারের এক বিলাসবহুল বিজয় মুহূর্ত। ভারতকে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন স্ট্র্যাটেজিক গ্লোবাল পার্টনার হিসেবে গণ্য করছে এটাও কূটনৈতিক লাভ, অন্তত এবারের সফরে ভারত যে পাকিস্তানের সঙ্গে এক ব্র্যাকেট থেকে বের হয়ে আসতে পারল, এয়ারফোর্স ওয়ান যে ইসলামাবাদ না ছুঁয়ে সরাসরি ওয়াশিংটন ডিসি থেকে দিল্লি এবং দিল্লি থেকে ওয়াশিংটন ডিসি যাতায়াত করল এটাও কম কথা নয়, ভারতের পক্ষ থেকে মার্কিন অস্ত্র কেনা ও দুই দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাসংক্রান্ত সহযোগিতা নতুন কথা নয়। এটা পূর্বাবধি শক্তপোক্ত। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এই অতি আগ্রহী মোদি-ভজনা থেকে কী পেলেন?

লেখক : ভারতীয় প্রবীণ সাংবাদিক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর