বৃহস্পতিবার, ২ এপ্রিল, ২০২০ ০০:০০ টা

ঘরে থাকুন জীবন বাঁচান

নাজনীন মুন্নী

মরে গেলে কেউ এসে ছোঁবে না আপনাকে। যাদের বুক জড়িয়ে  আজীবন বেঁচেছেন, তারা আপনাকে শেষবার বুকে জড়িয়ে চিৎকার করে সব হারানোর কান্না কাঁদবে না। এমন দিনও আসবে কে ভেবেছে কবে? ভাবনার সীমা পেরিয়ে সেই দিন বাস্তবে দেখছে সবাই। ১৯ ঘণ্টা লাশ পড়ে ছিল, কেউ ধরেনি। এখন মরে গেলে আর আপনি কারও স্বজন নন, ভয়াবহ এক মরণ ছোবল। যে আপনি কোনো দিন নামাজ কাজা করেননি। আল্লাহর সব নির্দেশ পালন করেছেন অক্ষরে অক্ষরে, সেই আপনার জানাজা পড়তে ভয় পাবে সবাই। শেষ পর্যন্ত হয়তো জানাজাটাও হবে না। এমন দিন কি ভাবতে পারেন আপনি! সেই দিনও এসেছে। সম্প্রতি মিরপুরের কবরস্থানে লাশ দাফন করতে দেয়নি কেউ। না, করোনায় মৃত্যু ছিল না তার। মৃত্যু হয়েছিল হার্ট অ্যাটাকে। তার পরও তার স্বাভাবিক কবর হয়নি। খিলগাঁও তালতলা কবরস্থানে গেটে ব্যানার ঝুলছে- ‘করোনা আক্রান্ত মৃতদেহ দাফন করা হবে না’ এই ঘোষণায়। আমরা কি তাহলে মাটিও পাব না মরলে?

কি ভয়াবহ এক দুঃসময় আমাদের। একদিকে শত শত মানুষ মরে যাওয়ার খবর। অন্যদিকে করোনায় আক্রান্ত হওয়ার আতঙ্ক। সব ছাপিয়ে সবচেয়ে বড় ভয়, চিকিৎসাটাই তো পাওয়া যাবে না। করোনার কবলে পড়েছেন কিনা  তা নিশ্চিত হওয়াই এখন সবচেয়ে কষ্টকর। চিকিৎসা তো দূর! করোনা শনাক্তে এ দেশে এখন পর্যন্ত আছে কেবল কয়েকটি ফোন নম্বর, যাকে বলে হটলাইন। গেল মার্চের এক মাসে এ হটলাইনে ফোন এসেছে প্রায় ৮০ হাজার। কিন্তু টেস্ট করার সৌভাগ্য হয়েছে কজনের অনুমান করত পারেন? নিশ্চয়ই অবাক হবেন শুনলে। সংখ্যা মাত্র ১ হাজার। আমি খুব অসহায় বোধ করি যথন ভাবী বাকি প্রায় ৭৯ হাজার, আসলে সেটা লাখো ছাড়াতে পারে- তারা কেমন করে দিন পার করছে? তারা সুস্থ হলো তো? শেষ পর্যন্ত জানতে পারল কি তারা আসলেই করোনায় আক্রান্ত নাকি সর্দিজ্বর? দেশজুড়ে আমরা যে কেবলই সর্দিজ্বরে মানুষ মরে যাওয়ার খবর পাই আজকাল প্রতিদিন!!

ডাক্তাররা সাবধান। অনেকেই ছুটি নিয়ে বাসায়। অনেকে হয়েছেন অসুস্থও। করোনা রোগী তো দূর, সাধারণ রোগীরাও দেখা পাচ্ছেন না ডাক্তারের। অবস্থা এমন বেগতিক যে করোনা না হলেও বিনা চিকিৎসায় মারা যেতে হবে অনেককে। যাচ্ছেও মারা। প্রতিদিনই আসছে তিন-চার হাসপাতাল ঘুরেও চিকিৎসা না পেয়ে মরে যাওয়ার খবর। শিশু থেকে টগবগে যুবক, নারী থেকে বৃদ্ধ আমরা কেবল শুনছি চিকিৎসা না পেয়ে মরে যাওয়ার খবর। হাসপাতালগুলো বুক চিতিয়ে বলছে ঠান্ডা জ্বরের রোগী তারা হাসপাতালে ঢুকতে দেবেন না। গোপন কিছু নয়, রীতিমতো প্রকাশ্যে সাইনবোর্ড টানিয়ে তাদের এই ঘোষণা! প্রবল জ্বর নিয়ে দিনমান লাইনে দাঁড়িয়ে কাকুতি-মিনতি করলেও কেউ পারছে না জানতে আসলে সে করোনার দখলে নাকি সামান্য সর্দি-কাশি। শেষ পর্যন্ত কি তাহলে সেদিকেই যাচ্ছে সময় যখন এই যুগে এসেও বিনা চিকিৎসায় মরে যেতে হবে? এমন দুর্যোগে বসে আছি ঘরে। না ভয়ে নয়, আমার ছোঁয়ায়, আমাদের ছোঁয়ায় যাতে বিষাক্ত না হয় কারও জীবন এই কারণে। আমরা ১৬ জন সাংবাদিক পড়তে গেছি কলকাতায়, এর আগে আরও কয়েকজন গেছেন রাষ্ট্রীয় সফরে। সবাই স্বেচ্ছায় নিজেদের বন্দী করেছি ঘরে। ১৪ দিনের স্বেচ্ছানির্বাসন! প্রতিদিন ভোরে চোখ মেলে প্রথমেই মনে হয় শ্বাস নিতে পারছি তো? গলাটা কি আজ একটু ব্যথা? জ্বর কেমন তা মাপতে থারমোমিটার খোঁজার তর সয় না। এমন আতঙ্ক। এমন আতঙ্ক। আপনাদের কি সেই ভয় হয় না? বদ্ধঘরে চোখ মেলে দেখি হাজারো, লাখো মানুষের গ্রামে ছুটে যাওয়ার দৃশ্য। দেখি কেবল ঘরে রাখতে রাস্তায় সশস্ত্র বাহিনী। এর পরও আমরা ঘরে নেই। আমাদের খেটে খেতে হয়, আমাদের কাজে বাইরে যেতে হয়, আমাদের বাজার, আমাদের ব্যাংক, আমাদের হাজারো বাহানা। সেই বাহানায় আমরা বাইরে। আমরা তোয়াক্কা করি না করোনা। অমরা ভাবী আমরা বীর বাঙালি! আমরা সব হজম করে ফেলি- এটা পারব না! হাজারো মানুষ এক হচ্ছে এক প্যাকেট খাবারের জন্য। মানুষগুলো কেবল খেয়ে বেঁচে থাকাটা জানে। তারা কেবল পেটটাকে ভয় পায়, আর কিছু না। কিন্তু আপনি? একটু সহায়তার নাম করে তাদের ঘর থেকে ডেকে নিয়ে আসছেন সহায়তা দিতে নয়, হত্যা করতে। আপনি কি তা বুঝতে পারেন? আপনার সহায়তার হাতকে আমরা বাহবা জানাই। কিন্তু আপনি আর একটু কষ্ট করে সেই হাতটা কি তার বাড়ি পর্যন্ত নিতে পারছেন না? আমরা কেমন করে এত নির্বোধ আর অসচেতন হতে পারি?

এই যে এত অসুবিধা, অজুহাত আমাদের, এই যে তোয়াক্কা না করা এসবই করেছিল আমেরিকা, ইউরোপ। দেখছেন কি তাদের অহংকারের ফল? প্রতিদিন মারা যাচ্ছে শত মত মানুষ।  আক্রান্ত হাজার ছাড়িয়ে লাখের ঘর ছুঁইছুঁই করছে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, যদি মৃতের সংখ্যা ১ লাখে বেঁধে রাখা যায় তবে তারা সফল। ১ লাখ মানুষ মরে গেলে যারা নিজেদের সফল ভাবছেন, তাহলে সেখানে কত মানুষ মারা যাওয়ার কথা? স্বপ্নের দেশ আমেরিকা এখন দুঃস্বপ্নের মৃত্যুপুরী। এখন পর্যন্ত সেখানে মারা গেছে প্রায় ৪ হাজার মানুষ। যার মধ্যে ৩৫ জন বাংলাদেশি। এক দিনে ক্ষমতাধর এই দেশে মারা গেছে ৭৭০ জন। আক্রান্ত প্রায় ২ লাখ। এখানেই কিন্তু শেষ নয়, সামনের দুই সপ্তাহ আরও ভযাবহ বলে জানিয়েছে দেশটি। কত মানুষ যে নেই হয়ে যাবে, কে রাখবে সে হিসাব। যে ভয়াবহ তান্ডব চলছে যুক্তরাষ্ট্রে তা থামাবে সেই শক্তি কার? বিশ্বের ক্ষমতাধর দেশের এমন অসহায় রূপ কে দেখেছে কবে? এ তো কেবল যুক্তরাষ্ট্রের কথা। পুরো বিশ্বের প্রায় সব দেশে বইছে করোনা বিষের হাওয়া। ১ এপ্রিল পর্যন্ত বিশ্বে প্রায় ৯ লাখ মানুষ করোনায় আক্রান্ত। মারা গেছে ৪৩ হাজারের বেশি। সুস্থ হয়েছে প্রায় ১ লাখ ৮৫ হাজার। মৃত্যুর সঙ্গে দেখা না করে যারা ফিরে এসেছেন তারাই কেবল বলতে পারবেন ঘটনা কতখানি কষ্টকর। আর যারা করোনার সঙ্গে হেরে যাচ্ছেন যুদ্ধে কখনো কি ভেবেছেন বুঝে ওঠার আগেই করোনা নামের মৃত্যুদূত কেড়ে নেবে প্রাণ?

বিশ্বের ধনী আর সক্ষম দেশগুলোর এমন অসহায় অবস্থা কি আমাদের সচেতন করে না? এর পরও আমরা ভাবী আমরা বেঁচে যাব? এখনো আমাদের হাসপাতাল প্রস্তুত নয়, পরীক্ষার কিট পর্যাপ্ত নয়, চাইলেই যে কেউ করত পারবে না টেস্ট, নেই পর্যাপ্ত ডাক্তার, ডাক্তারের নিরাপত্তা। কেমন করে বাঁচবেন আপনি? কেমন করে বাঁচব আমরা? কেমন করে বাঁচবে আমাদের দেশ? কষ্ট হবে, খারাপ লাগবে তার পরও থাকুন ঘরে। ঘরই এখন পারে বাঁচাতে- আমাকে, আপনাকে, পুরো দেশকে। হাত জোড় করে বলি- ঘরে থাকুন। আমাদের বাঁচান ।

                লেখক : সাংবাদিক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর