রবিবার, ১৭ মে, ২০২০ ০০:০০ টা

এমনিতেই ভীত, আর ভয় দেখাবেন না

প্রভাষ আমিন

এমনিতেই ভীত, আর ভয় দেখাবেন না

করোনা এসে পাল্টে দিয়েছে গণমাধ্যমের চিত্র। ডাক্তার, পুলিশের মতো গণমাধ্যম- কর্মীরাও করোনার ফ্রন্টলাইন ফাইটার। সরকার-ঘোষিত সাধারণ ছুটিতে অনেক কিছুই বন্ধ বা সীমিত আছে। কিন্তু অন্য অনেক জরুরি সেবার মতো সর্বক্ষণ চালু আছে গণমাধ্যমও। পৃথিবীর যত বড় দুর্যোগই হোক, গণমাধ্যম কিন্তু সরব থাকে। তবে এবারের দুর্যোগটি ভিন্নমাত্রার। করোনা আক্রান্ত গণমাধ্যমকর্মীদের অনেকেই। এরই মধ্যে তিন গণমাধ্যমকর্মী মারা গেছেন। আক্রান্ত হয়েছেন আরও অনেকে। ডাক্তার, পুলিশসহ আরও অনেকের মতো সাংবাদিকদেরও মাঠে থেকে কাজ করতে হয়। তাই তাদের ঝুঁকির মাত্রাটাও বেশি। আর ঝুঁকিটা শুধু ব্যক্তি গণমাধ্যমকর্মীর নয়, তার পরিবারের সদস্যদেরও। ডাক্তার, পুলিশসহ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য নানা রকমের ইন্স্যুরেন্স বা আর্থিক প্রণোদনা থাকলেও সমান ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে যাওয়া গণমাধ্যমকর্মীদের জন্য দুই ফোঁটা চোখের জল তো দূরের কথা, শুকনো শোকও বরাদ্দ নেই।

শারীরিক ঝুঁকি তো আছেই, আছে চাকরির ঝুঁকিও। এ করোনা দুর্যোগে গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়া, সংকুচিত করে আনা, ছাঁটাই, অনিয়মিত বেতন- সব ধরনের অনিয়মই চলছে। তবে এখনকার চেয়ে এ দুর্যোগের প্রভাবে সামনের দিনগুলো গণমাধ্যমের কী অবস্থা হবে, তা নিয়ে শঙ্কিত অনেকে। বিজ্ঞাপনদাতারা বিজ্ঞাপন দেবেন কিনা, সময়মতো বিজ্ঞাপনের বিল দেবেন কিনা, বিল না পেলে মালিকরা বেতন দেবেন কোত্থেকে; এমন অনেক শঙ্কা গণমাধ্যমকর্মীদের মনে। এরই মধ্যে অধিকাংশ অনলাইনের কর্মীরা বাসায় থেকে অফিস করছেন। অনেক দৈনিকও কর্মীসংখ্যা কমিয়ে এনেছে। টেলিভিশনগুলোও ভাগ করে কাজ করছে। ঘরে থেকে হোক আর মাঠে থেকে; আতঙ্কটা কিন্তু থাকছেই মনে।

করোনা সংক্রমণের শঙ্কা, চাকরির ঝুঁকি; সব মিলিয়ে গণমাধ্যমকর্মীরা একটা ভয়ের সময় পার করছেন। কিন্তু এই সময়েও যখন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে কথা বলতে হয়, সাংবাদিকদের হাতকড়া নিয়ে কথা বলতে হয়, গুম হয়ে যাওয়া সাংবাদিকের মুক্তির দাবি করতে হয়; তখন আমাদের ভয় তো যায়ই না, বরং আরও চেপে বসে। ১০ মার্চ ঢাকা থেকে হারিয়ে গিয়েছিলেন ফটোসাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজল। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তাঁর সন্ধান মেলেনি। পরিবারের পক্ষ থেকে মামলা করা হলেও কোনো অগ্রগতি হয়নি। এর মধ্যে করোনা আতঙ্ক চলে এলে পরিবার ছাড়া আর সবাই ভুলে যান কাজলকে। কেন কাজল হারিয়ে গেলেন, তার কোনো উত্তর মেলেনি। পাপিয়াসংক্রান্ত একটি নিউজ নিয়ে সংসদ সদস্য সাইফুজ্জামান শিখর মানবজমিন সম্পাদকসহ অনেকের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন। সেই মামলার আসামি ছিলেন শফিকুল ইসলাম কাজল। তিনি অবশ্য নিউজটি করেননি। তিনি শুধু শেয়ার করেছিলেন।

সেই মামলার দুই দিনের মধ্যে হারিয়ে গিয়েছিলেন শফিকুল ইসলাম কাজল। অনেকে তাই কাজলের হারিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সংসদ সদস্য সাইফুজ্জামান শিখরের মামলার যোগসূত্র খুঁজছিলেন। আমি এ ধারণার সঙ্গে কোনোভাবেই একমত ছিলাম না। কারণ যিনি গুম করবেন, তিনি মামলা করবেন না। আর মামলাই যেহেতু করে ফেলেছেন, তাহলে আর গুম করতে হবে কেন? কোনো সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা হলে অনেকেই দেখি তীব্র প্রতিবাদ জানান। আমিও জানাই। তবে আমি মনে করি, গুমের চেয়ে মামলা ভালো, অন্তত নিরাপদ। আর সংক্ষুব্ধ যে কারও প্রচলিত আইনে মামলা করার অধিকার আছে।

আমার হাতে কলম আছে বলেই আমি কারও বিরুদ্ধে যা ইচ্ছা তাই লিখে দেব, আর তিনি মামলা করলে আমি প্রতিবাদ করব; তা তো হয় না। আমি মনে করি, সংক্ষুব্ধ যে কারও প্রচলিত আইনের আশ্রয় নেওয়ার অধিকার আছে। তাই সাইফুজ্জামান শিখরের মামলা করাকে আমি অত খারাপ বলে মনে করিনি। বা কাজলের গুমের সঙ্গে সাইফুজ্জামান শিখরের মামলার কোনো যোগসূত্র খুঁজিনি। আমি মামলাকে ভয় পাই না, গুমকে ভয় পাই। একবার গুম হলে ফিরে আসার কোনো গ্যারান্টি নেই।

ক্রসফায়ারে তবু লাশ পাওয়া যায়, মৃত্যু দিন থাকে, কবর থাকে। কিন্তু গুম মানে হতে পারে, একেবারে হারিয়ে যাওয়া, পরিবারের অনন্ত অপেক্ষা। গুমকে আমি খুব ভয় পাই, কারণ গুমের জন্য কাউকে দায়ীও করা যায় না। খোঁজখবরও করা যায় না। অচেনা লোকজন তুলে নিয়ে যায়। তারপর আর কেউ দায়িত্ব স্বীকার করে না। পুলিশের কাছে গেলে বলে, আমরা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি। ব্যস, এ চেষ্টাতেই শেষ পুলিশের দায়িত্ব! আবার কারও কারও জঙ্গি তৎপরতায় অংশ নিতে স্বেচ্ছায় আত্মগোপনে যাওয়া গুম পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে। কে যে গুম হয়েছে আর কে যে স্বেচ্ছায় পালিয়েছে; বোঝা মুশকিল হয়ে যায়। তবে শফিকুল ইসলাম কাজল ভাগ্যবান। ৫৪ দিন পর হলেও তিনি ফিরে এসেছেন। আর ফিরে আসার জন্য তিনি বেছে নিয়েছিলেন মুক্ত গণমাধ্যম দিবসটিকেই। আমরা তাঁর ফিরে আসাকে নিয়েছিলাম মুক্ত গণমাধ্যম দিবসের উপহার হিসেবেই। অবশ্য বাংলাদেশে গুম বা ক্রসফায়ারের সঙ্গে আমরা যে একটি আষাঢ়ে গল্প উপহার পাই, এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ৫৪ দিন পর ভারত থেকে অনুপ্রবেশের সময় বেনাপোলের সাদিপুর সীমান্তে বিজিবি কাজলকে আটক করেছে। অন্যসব গল্পের মতো এটাও বিশ্বাসযোগ্য নয়। তবু আমরা সে গল্প বিশ্বাস করেছি। যদিও আমাদের মনে অনেক প্রশ্ন ছিল।

তিনি কি নিজে থেকেই হারিয়ে গিয়েছিলেন, নাকি কেউ তাঁকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল, এই ৫৪ দিন তিনি কোথায় ছিলেন, কেমন ছিলেন, কীভাবে তিনি পাসপোর্ট-ভিসা ছাড়া ভারতে গেলেন, যাওয়ার সময় কেউ তাঁকে আটকাল না কেন, এই লকডাউনের মধ্যে ফিরে আসতে গেলেন কেন, বাংলাদেশের লোকজন পালিয়ে ভারতেই যায় কেন? এমন অনেক প্রশ্ন ছিল মনে। কিন্তু কাজল অক্ষত অবস্থায় ফিরে এসেছেন, এতেই আমি সন্তুষ্ট। উত্তর আশা করা তো দূরের কথা, এসব প্রশ্ন আমি তুলিইনি। তুলিনি কেন, তা নিয়ে প্রচুর গালি শুনতে হয়েছে। বলা হচ্ছে, ভয় এবং পক্ষপাতিত্ব ছাড়া যেদিন সাংবাদিকতার কথা বলা হচ্ছে, সেদিনও ভয়ে আমরা কোনো প্রশ্ন তুলছিলাম না। আমি সব অভিযোগ স্বীকার করেই বলেছি, আমি ভীতু। আমার সহকর্মী বেঁচে আছেন, এতেই আমি সন্তুষ্ট ছিলাম। কিন্তু পরে যখন তাঁকে পিছমোড়া করে হাতকড়া পরিয়ে আদালতে তোলা হয়, আমার মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে যায়। ৫৪ দিন পর একজন সাংবাদিকের ফিরে আসাকে আমরা সেলিব্রেট করার সুযোগই পেলাম না। পুলিশ তাঁকে হাতকড়া পরিয়ে আদালতে তুলল আর আদালত জামিন বাতিল করে কারাগারে পাঠিয়ে দিল। পুলিশ বা বিচারক কি মঙ্গলগ্রহে থাকেন? তাঁরা কি জানেন না কাজল কীভাবে হারিয়ে গিয়েছিলেন, কীভাবে ফিরে এসেছেন? বাংলাদেশের একজন সাংবাদিককে নিজ দেশে ফিরতেও অনুপ্রবেশের মামলায় আসামি হতে হয়! ৫৪ দিন পর ফিরে আসা কাজলের মুক্তির দাবিও করতে হবে, এটা সত্যিই আশা করিনি। কাজলের হাতকড়া পরানো ছবি দেখে মনে হয়েছে, এটা সাংবাদিকদের ভয় দেখানোর চেষ্টা। তার পরও কাজল যে বেঁচে আছেন, এতেই আমি খুশি। কাজল যদি ফিরে না আসতেন, ভয় ও পক্ষপাতহীন সাংবাদিকতা দিয়ে কি আমরা তাঁকে ফিরিয়ে আনতে পারতাম? ৫৪ দিন চেষ্টা করে তো পারিনি। আমার ভাই অত সাহস নেই। আমি বিশ্বাস করি, বেঁচে থাকার চেয়ে বড় সাহস আর কিছু নেই।

শুধু যে কাজলকে হাতকড়া পরিয়ে বা কারাগারে পাঠিয়ে আমাদের ভয় দেখানো হয়েছে তা কিন্তু নয়। এই করোনা দুর্যোগেও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের যথেচ্ছ প্রয়োগ হচ্ছে। সরকারবিরোধিতার অপরাধে দেশি-বিদেশি ১১ জনকে আসামি করে মামলায় কার্টুনিস্ট, লেখক, অ্যাকটিভিস্টকে গ্রেফতারও করা হযেছে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের জন্য নীতিমালা করা হয়েছে। ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীদের গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে বারণ করা হয়েছে। এ সবই মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পথে অন্তরায়।

তবে আমি সব সময় বলি, সম্পূর্ণ স্বাধীনতা বলে কিছু নেই। কখনোই আপনি যা ইচ্ছা তা বলতে পারবেন না। আপনাকে অবশ্যই দায়িত্বশীল হতে হবে। আমাদের সংবিধানেও ‘রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশি রাষ্ট্রসমূহের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা ও নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত-অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ-সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসংগত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে (ক) প্রত্যেক নাগরিকের বাক্ ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের, এবং (খ) সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা’ দেওয়া হয়েছে। তার মানে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন থাকুক আর না-ই থাকুক; আপনি কিন্তু যা ইচ্ছা তা বলতে পারবেন না। একজন মানুষ হিসেবে আপনার বলা কথার সঙ্গে আপনার বিবেক এবং দায়িত্বশীলতার সম্মিলন ঘটাতেই হবে।

সাংবাদিক হিসেবে দায়িত্বশীলতা বেশি জরুরি। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ব্যাপক প্রসারের কারণে এখন সাধারণ মানুষের দায়িত্বশীলতাটাও কম জরুরি নয়। আবার গণমাধ্যমের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা যেমন জরুরি, তেমন সাধারণ মানুষের মতপ্রকাশের অধিকার নিশ্চিত করাটাও জরুরি। আমাদের এখানে সমস্যাটা হলো, আমরা সরকার আর রাষ্ট্রের পার্থক্যটা ভুলে যাই। সরকার-বিরোধিতাকে আমরা রাষ্ট্রবিরোধিতা মনে করে ঝাঁপিয়ে পড়ি। সরকারের সমালোচনা করার অধিকার কিন্তু সবারই আছে। এমনকি সরকারপ্রধানকে নিয়ে কার্টুন করারও অধিকার আছে। এই বাংলাদেশে একসময় শিশির ভট্টাচার্য তারকা খ্যাতি পেয়েছিলেন রাজনৈতিক কার্টুন করেই। কিন্তু আজ আমাদের সহিষ্ণুতা জিরো টলারেন্সে নেমে গেছে। হয় তুমি আমার পক্ষ, নয় তুমি শত্রুপক্ষ। আর শত্রুপক্ষ হলে তোমার মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সীমিত। যে কোনো মহামারীর সময় দায়িত্বশীল গণমাধ্যম খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। সত্য আটকাতে দরজা বন্ধ করলেই জানালা দিয়ে লাফিয়ে ছড়ায় গুজব। ভুল বা মিথ্যা তথ্য বা গুজব ছড়ানো যেমন অপরাধ; তেমন সত্য তুলে ধরা, সরকারের সমালোচনা করা, মতপ্রকাশও সবার অধিকার। কিন্তু একজন সাংবাদিককে হাতকড়া পরিয়ে কারাগারে পাঠিয়ে বা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের যথেচ্ছ ব্যবহারে আসলে সাংবাদিকদের ভয় দেখানোর চেষ্টা হচ্ছে। অথচ আমি শুরুতেই বলেছি, আমি একদম সাহসী নই। আমি খুব ভীতু। করোনার আতঙ্কেই আমরা কাবু, সঙ্গে আছে গণমাধ্যমের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা। নতুন করে আমাদের আর ভয় দেখাতে হবে না।

কেন জানি না, আমার খালি সুকুমার রায়ের ছড়া ‘বাবুরাম সাপুড়ে’র কথা মনে পড়ছে-

বাবুরাম সাপুড়ে,/কোথা যাস্ বাপুরে?

আয় বাবা দেখে যা,/দুটো সাপ রেখে যা!

যে সাপের চোখ্ নেই,/শিং নেই নোখ্ নেই,

ছোটে না কি হাঁটে না,/কাউকে যে কাটে না,

করে নাকো ফোঁস্ ফাঁস্,/মারে নাকো ঢুঁশ্ ঢাঁশ,

নেই কোন উৎপাত,/খায় শুধু দুধ ভাত-

সেই সাপ জ্যান্ত/গোটা দুই আনত!

তেড়ে মেরে ডান্ডা/ক’রে দিই ঠান্ডা।

                লেখক : সাংবাদিক।

সর্বশেষ খবর