শনিবার, ১৯ ডিসেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

ফুল বাণিজ্যের আলো নিভুনিভু

শাইখ সিরাজ

ফুল বাণিজ্যের আলো নিভুনিভু

বাংলাদেশে অপার সম্ভাবনা নিয়ে সম্প্রসারিত হচ্ছিল ফুল বাণিজ্য। ফুল বিলাসী পণ্য থেকে আমাদের কাছে হয়ে উঠছিল প্রয়োজনীয় এক উপকরণ। ফুল চাষ করে কৃষকও দেখছিল লাভের মুখ। কিন্তু সব হিসাব-নিকাশ পালটে দিয়েছে করোনার অভিঘাত। শুধু বাংলাদেশ নয়, ফুল চাষের জন্য বিখ্যাত নেদারল্যান্ডস, চীনসহ সারা বিশ্বেই ফুল বাণিজ্য পড়ল হুমকির মুখে। করোনার ভয়াল তরঙ্গে যখন সারা বিশ্ব কাঁপছে আমাদের দেশের ফুল চাষিদের মাঠ তখন ফুলে ফুলে ভরা। করোনার তান্ডবে ভয়ানক ক্ষতির মুখোমুখি হলো আমাদের ফুল চাষিরা। বাংলাদেশে প্রথমবার টিউলিপ ফোটানো দম্পতি গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার দেলোয়ার শেলি একদিন কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে জানালেন তাদের দুর্গতির কথা। অপরিসীম ক্ষতির মুখোমুখি হয়েও তারা সরকারের কাছ থেকে তেমন সাহায্য-সহযোগিতা পাননি।

যা হোক, এ ডিসেম্বরে ফুল চাষিদের খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করলাম। কতটা ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছেন তারা!

দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল সীমান্তঘেঁষা এলাকাগুলোয় ফুল চাষের ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে। এখানে ফুলই দখল করেছে কৃষকের বড় স্বপ্নের জায়গা। আমরা যশোরের গদখালীতে ফুল চাষ ঘিরে আর্থসামাজিক পরিবর্তনের যে চিত্রগুলো দেখে আসছি তা সারা দেশের জন্যই দারুণ আশাজাগানিয়া। ফুল চাষ বাণিজ্যিক হয়ে ওঠায় এখানে জড়ো হয়েছে বহু স্বপ্ন। আমার খুব মনে পড়ছে ২০০৫ সালের কথা। ঝিনাইদহের কালিগঞ্জ থেকেই আমরা ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’ অনুষ্ঠানে প্রথম বাণিজ্যিক ফুল চাষের চিত্র তুলে ধরেছিলাম। তারপর কেটে গেছে দেড় দশক। বাণিজ্যিক ফুল চাষের বহুমুখী সম্প্রসারণের গল্প আমরা দেখেছি। কিন্তু গদখালী থেকে একটু যেন ভিন্ন ঝিনাইদহের মহেশপুরের ফুল চাষ। ফুল এখানে যেন আর সব সাধারণ সবজি শস্যের মতোই। তবে ফুল চাষের মধ্যেও দারুণ বৈচিত্র্যের পথে হাঁটছে এখানকার তরুণ কৃষক। আর সব ফুলের মধ্যে চন্দ্রমল্লিকাই মহেশপুরের তরুণ ও অগ্রসর কৃষকের মন জয় করেছে। কারণ অন্যান্য ফুলের চেয়ে চন্দ্রমল্লিকার বাজারমূল্য ভালো পাচ্ছেন তারা।

প্রিয় পাঠক! চন্দ্রমল্লিকা কীভাবে পালটে দিয়েছে মহেশপুরের শ্যামপুর গ্রামকে আজ আপনাদের সে গল্পই বলব।

শীতের সকাল। এ অঞ্চলের প্রকৃতি এখনো সেই আদি। গ্রামের শীতসকালের দৃশ্যে চোখ জুড়িয়ে যায়। খেজুর গাছে ঝুলছে রসের হাঁড়ি। কোনো কোনো বাড়িতে চলছে রস থেকে গুড় বানানোর কাজ। ফসলের খেতজুড়ে নানা শস্যের বৈচিত্র্য। গ্রামে ঢুকেই দেখা হলো তরুণ কৃষক জসিম মল্লিকের সঙ্গে। জসিম স্বপ্নচারী এক কৃষক। বছর পাঁচেক আগে এসব জমিতে সবজি চাষ করতেন এখন ঢুকে গেছেন ফুল চাষে। দাঁড়িয়েছিলাম চন্দ্রমল্লিকার খেতের পাশে। এখানে ২০ শতক জমিতে চন্দ্রমল্লিকার চাষ। প্রতিটি গাছ থেকে এক মৌসুমে পাওয়া যায় ১০০ ফুল। প্রতি ফুলের মূল্য পায় আড়াই থেকে পাঁচ টাকা। এ বছর এ ২০ শতক জমিতে ফুল চাষে মোট খরচ হয়েছে দেড় লাখ টাকা। আর ফুল বিক্রি করেছেন ১ লাখ ৮৫ হাজার টাকায়। করোনার কারণে এবার বাজার মন্দ। তার পরও ২০ শতক জমি থেকে এ মৌসুমে লাভ পাচ্ছেন ৩৫ হাজার টাকা।

পাঠক! বলে রাখি ফুল চাষের জেলা হিসেবে যশোরকে যদি এক নম্বরে ধরতে হয় তাহলে ঝিনাইদহের স্থান দুই নম্বরে। এখন দেশের অনেক জেলাতেই ছড়িয়ে পড়েছে ফুল চাষ। কিন্তু এখানে কৃষকের অগ্রসরতা আমার কাছে অন্য রকম মনে হলো। কৃষক অত্যন্ত সচেতনভাবে প্রতিটি পদক্ষেপে প্রযুক্তি ও কৌশল প্রয়োগ করছে।

আপনাদের হয়তো মনে আছে, ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’ অনুষ্ঠানে চীনের গোয়াংডং প্রদেশের শিনশিং এলাকার একটি ড্রাগন খেতে এলইডি আলো ব্যবহারের চিত্র দেখিয়েছিলাম। সেটিই আমাদের কাছে ছিল বেশ নজরকাড়া এক দৃশ্য। আমরা ড্রাগন ফলের বাগানে এলইডি আলোর ঝলকানি দেখার জন্য প্রায় ৩ ঘণ্টা ঠায় অপেক্ষা করে ছিলাম। যদিও ইনডোর ফার্মিং এলইডি আলোর ব্যবহারের বহু চিত্রই আমরা এর আগে দেখেছি। জাপানের পাসোনা টু, নেদারল্যান্ডসের গ্রিন কিউ- এ প্রতিষ্ঠানগুলো সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে এলইডি আলো ব্যবহার করে উদ্ভিদের সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়াকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে। আর উন্মুক্ত মাঠে এলইডি আলোর ব্যবহার মানে আরও এক ধাপ অগ্রগতি। বোঝা যায় এ পদ্ধতিটি কৃষকেরই আবিষ্কৃত। কারণ রাতে আলো জ্বেলে দিনের দৈর্ঘ্য বাড়িয়ে দেওয়ার কৌশল। হৃদয়ে মাটি ও মানুষ অনুষ্ঠানে চীনের ওই প্রতিবেদন দেখে টাঙ্গাইলের মির্জাপুরের কমফোর্ট কম্পোজিট নামের পোশাকপ্রতিষ্ঠান একই পদ্ধতিতে ড্রাগন ফল উৎপাদনের উদ্যোগ নেয়। সে কৌশল প্রয়োগ করছে এখানকার কৃষকও। ভালো লেগেছে প্রত্যন্ত গ্রামে কৃষক পর্যায়ে ফুল চাষে এলইডি আলো ব্যবহারের এ উৎকর্ষ দেখে। কৃষক জসিম এরই মধ্যে এলইডি বাতি ব্যবহারের ভালো ফল পেয়েছেন।

এ গ্রামের আরেক তরুণ কৃষক ইসমাইল হোসেন। তার ১৭ কাঠা জমিতে চন্দ্রমল্লিকার চাষ। তিনিও এলইডি বাতি ব্যবহার করছেন। জানালেন, এলইডি বাতি জ্বালানোয় গাছ দ্রুত বাড়ে, ফুল আসে দ্রুত এবং ফুলের আকার ও রং হয় সুন্দর।

এ এলাকায় প্রথম বাণিজ্যিক কৃষিতে অভাবনীয় এক লাভের বার্তা নিয়ে এসেছিল গাঁদা ফুল। এখনো কৃষক গাঁদা ফুলের চাষ ধরে রেখেছে। কথা হলো আরেক তরুণ কৃষক নাজমুল হোসেনের সঙ্গে। জানা গেল, ১২ বছর ধরে ফুল চাষ করছেন তিনি। এলইডি বাতি ব্যবহারের সুফল পৌঁছে গেছে তার কাছেও।

এরই মধ্যে এলাকার বহু কৃষক যুক্ত হয়েছে চন্দ্রমল্লিকা চাষে। এর মধ্যে অনেকেই এলইডি বাতি ব্যবহার করে বেশ সুফল পাচ্ছেন। কৃষক বলছে, এলইডি বাতি ব্যবহার করলে সারও কম লাগে।

এগুলো প্রযুক্তির উৎকর্ষ। যেটি নানাভাবে কৃষকের কাছে এসেছে। কিন্তু কৃষক বরাবরই প্রত্যাশা করে কৃষি বিভাগের মাধ্যমে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষগুলো তাদের হাতে আসুক। এ বিষয় নিয়েও কথা বলেছি কৃষি বিভাগের মাঠ পর্যায়ে কর্মরত উপসহকারী কর্মকর্তা রবিউল কবির পল্লবের সঙ্গে। তিনি বললেন, আধুনিক কৃষি বিষয়ে তাদের প্রশিক্ষণ প্রয়োজন, প্রয়োজন নিজেদের দক্ষতা উন্নয়নের।

কৃষক এখন অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা ও আগ্রহ নিয়ে কৃষি কাজ করে। ফসলের উৎপাদন বাড়ানো ও বাণিজ্যিক লাভের জন্য সারা বছর চলতে থাকে তার অনুসন্ধান। যখনই নতুন কিছুর সন্ধান পায় প্রয়োগ করে নিজের মাঠে। কখনো সাফল্য আসে, কখনো আসে না। কিন্তু প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে ঝুঁকি নিতে কৃষক মোটেও পিছপা হয় না বরং একটি নতুন প্রযুক্তি নিজের আয়ত্তে আনার জন্য অব্যাহত রাখে তার চেষ্টা। মহেশপুরের এই তরুণ চন্দ্রমল্লিকা চাষিদের ক্ষেত্রেই দেখা গেল বিষয়টি। করোনার তান্ডব সামলে নিয়ে তারা ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। এসব উদ্যমী কৃষকের কাছে যদি নতুন নতুন প্রযুক্তি ও পদ্ধতিগুলো নিয়মিতভাবে জোগান দেওয়া যায় তাহলে আরও বেশি সাফল্য দেখাতে পাবেন তারা। এ ক্ষেত্রে বিশ্বের আধুনিকতম কৃষিপ্রযুক্তিগুলোর সঙ্গে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের যোগাযোগ ও জানা-শোনাটা অনেক বেশি জরুরি। পাশাপাশি করোনার অভিঘাতে বিপর্যস্ত ফুল চাষিদের পাশে সরকার সহযোগী হয়ে দাঁড়াবে- এমনটাই প্রত্যাশা করি।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।  

[email protected]

সর্বশেষ খবর