বুধবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

তিস্তা চুক্তি নিয়ে সময় ক্ষেপণ কেন?

সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

তিস্তা চুক্তি নিয়ে সময় ক্ষেপণ কেন?

গত ১৭ ডিসেম্বর ভিডিও কনফারেন্সে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে উভয় দেশের মধ্যে নানা বিষয় নিয়ে কথাবার্তা হয়। তারপর এক যৌথ বিবৃতিতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী দীর্ঘদিন আটকে থাকা তিস্তার পানিচুক্তির প্রসঙ্গটি জোরের সঙ্গে উল্লেখ করেন। শেখ হাসিনা বলেছেন, ২০১১ সালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং ঢাকা সফরের সময় চুক্তির যে খসড়া তৈরি হয়েছিল তা থেকে বাংলাদেশ একচুলও নড়বে না। ১০ বছর ধরে দিল্লির টালবাহানার কারণ হলো পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির কাছে নতিস্বীকার করে যাওয়ার প্রবণতা। শেখ হাসিনা বলেছেন, ২০১১ সালে যে চুক্তিতে ঢাকা ও দিল্লি সম্মত হয়েছিল উভয় দেশের স্বার্থে তা দ্রুত সম্পন্ন করা প্রয়োজন। মোদি বলেছেন, দিল্লি ধারাবাহিকভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

এ খবরের প্রতিক্রিয়া দিতে গিয়ে পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থি ও কংগ্রেস নেতারা বিবৃতি দিয়ে বলেছেন, এটা নরেন্দ্র মোদির টালবাহানা মাত্র। তারা মনে করেন, এটা পরিষ্কার দিল্লির দাদা ও পশ্চিমবঙ্গের দিদির মধ্যে এ ব্যাপারে কোনো গোপন আঁতাত থাকতে পারে। তারা অভিযোগ করেন, ২০১৪ সালে মোদি ক্ষমতায় আসার পর থেকে ভারতের পার্লামেন্টের উভয় কক্ষে যেসব দেশবিরোধী, জনস্বার্থবিরোধী আইন পাস করানো হয়েছে, প্রতিটি ক্ষেত্রেই মমতার দল তৃণমূল প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বিজেপিকে সমর্থন করেছে।

এ অভিযোগ তুলে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্য মিত্র বলেন, তিস্তা চুক্তির জন্য জ্যোতি বসু, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের আমলের সরকার কোনো বাধা তো সৃষ্টি করেনি, বরং দিল্লির মনমোহন সিংয়ের সরকার এ চুক্তির যে খসড়া রাজ্য সরকারকে দিয়েছিল তা তারা সঙ্গে সঙ্গে অনুমোদন করে দিয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ কংগ্রেসের প্রবীণ নেতা, সাংসদ প্রদীপ ভট্টাচার্য বলেছেন, আমরা চাই এ চুক্তি দ্রুত সম্পন্ন হোক। তিনি মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের কথা উল্লেখ করে বলেন, ঢাকা সফরের আগে সে সময় বিরোধী দলনেত্রী বিজেপির সুষমা স্বরাজ ও রাজ্যসভার বিজেপি নেতা অরুণ জেটলি এবং প্রবীণ বিজেপি নেতা লালকৃষ্ণ আদবানিকে নৈশভোজে ডেকে মনমোহন সিং ঢাকায় যে আলোচনা হবে তার বিস্তারিত জানিয়েছিলেন। তারা সব বিষয়েই সম্মতি জানিয়েছিলেন।

ঢাকা থেকে ফিরে এসে আবার ওই তিন নেতাকে ডেকে শেখ হাসিনার সঙ্গে যে চুক্তি হয়েছিল, তার বিস্তারিত তাদের জানিয়েছিলেন। বিরোধীদের সমর্থন নিয়েই সংসদের উভয় কক্ষে তা অনুমোদিত হয়েছিল। ২০১৯ সালে শেখ হাসিনা দিল্লিতে এসেছিলেন, একটি নতুন চাল দিয়েছিলেন মমতা। তিস্তা নয়, তোরসা নদীর জল নিয়ে চুক্তি হোক। এমনটাই প্রস্তাব দিয়েছিলেন মমতা ব্যানার্জি। তোরসা নদীর উৎস হলো ভুটানে। মমতা জেনেশুনেই এটা করেছিলেন। যাতে তিনটি দেশের জটিলতা সামনে রেখে তিস্তা চুক্তি আটকে দেওয়া সম্ভব হয়।

মমতার এ প্রস্তাব সরকারিভাবে শেখ হাসিনা বা নরেন্দ্র মোদিকে দেওয়া হয়নি। শেখ হাসিনার দিল্লি ছাড়ার ঘণ্টাখানেকের মধ্যে দিল্লিতে কয়েকজন বাঙালি সাংবাদিককে ডেকে এ প্রস্তাবের কথা বলেন তিনি। দিল্লির বাঙালি সাংবাদিকরা ভৌগোলিক জটিলতা হয়তো অনেকেই জানতেন না। উত্তরবঙ্গের কোন নদীর কোথায় উৎস এবং কোন খাতে বইছে, সে ব্যাপারে বিখ্যাত সাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার বলেছেন, ‘তোরসা নদীর উৎস সম্পর্কে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর কতটা ধ্যান-ধারণা আছে আমি জানি না। তবে আমি নিজে উত্তরবঙ্গে জন্মেছি, বড় হয়েছি। আমি জানি, তোরসা নদীর উৎস ভুটানে। ১০ বছর ধরে শুনে আসছি ভারতের কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থাও সরকারকে রিপোর্ট দিয়েছে তিস্তা নিয়ে যখনই আলোচনা হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়, তখন বাংলাদেশের বিরোধী দল বিএনপি-জামায়াত এ চুক্তি সই না করার জন্য মমতা সরকারের ওপর নানাভাবে চাপ সৃষ্টি করে।

ওই সব দলের কোনো কোনো নেতা মাঝেমধ্যে কলকাতায় এসে মমতা ব্যানার্জি কিংবা তার ঘনিষ্ঠ নেতা ববি হাকিমের সঙ্গে দেখা করেন। আমার মনে আছে, ২০১৪ সালে বাংলাদেশের নির্বাচনের আগে মমতার ঘনিষ্ঠ মন্ত্রী ববি হাকিম বলেছিলেন, আমরা তিস্তা চুক্তি করব কি শেখ হাসিনাকে জেতানোর জন্য। পরে একটি টিভি সাক্ষাৎকারে আমি তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, আপনি আওয়ামী লীগ বা শেখ হাসিনাকে জেতানোর বিপক্ষে। তাহলে কি আপনি মুজিব হত্যাকারী জিয়ার বিধবা স্ত্রী বেগম খালেদাকে জেতাতে চান? তিনি উত্তরটি সেদিন এড়িয়ে গিয়েছিলেন।

আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নিয়ে মমতা ব্যানার্জির কোনো ধ্যান-ধারণা নেই। মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের আগে তার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশঙ্কর তিনবার কলকাতায় এসেছিলেন মমতাকে বোঝাতে যে, তিস্তা চুক্তি কেন প্রয়োজন। মমতা কোনো সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দিতে পারেননি। শুধু বলেছিলেন, আই উইল নট সো টু ঢাকা। পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক মহল মনে করে, মমতার ভোটব্যাংক হলো বাংলাদেশি জামায়াতপন্থিরা।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আশ্বস্ত করেছেন, তার সরকার ধারাবাহিকভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী কী বলতে চাইছেন, ঠিক স্পষ্ট নয়। কূটনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, ১২০ দিন পর পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় যে নির্বাচন হবে, সেখানে তার দল বিজেপি জয়ী হবে। তারপর বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী যিনি হবেন, তাকে দিয়েই তিনি তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে সম্মতি আদায় করে নেবেন। এ যেন গাছে কাঁঠাল আর গোঁফে তেল দেওয়ার মতো ব্যাপার।

তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেওয়া যায় বিজেপি জয়ী হবে। তাহলে বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী তিস্তা চুক্তিতে রাজি হবেন কিনা এ ব্যাপারে রাজনৈতিক মহলে যথেষ্ট সন্দেহ ও উদ্বেগ রয়েছে। বিষয়টি একটু খুলে বলা যাক। পশ্চিমবঙ্গের আরএসএসের এক নম্বর নেতা হলেন ত্রিপুরার সাবেক রাজ্যপাল তথাগত রায়। তথাগত রায়ের সঙ্গে কয়েক মাস আগে এ ব্যাপারে কথা হচ্ছিল। তিনি আমাকে সেদিন বলেছিলেন, উত্তরবঙ্গ থেকে বিজেপি লোকসভায় বেশ কয়েকটা আসন পেয়েছে। বিজেপির উত্তরবঙ্গের সাংসদরা তিস্তা চুক্তি করতে চাইবেন কি? নির্বাচনে যেসব বিধায়ক উত্তরবঙ্গ থেকে জিতে আসবেন, তাদের মনোভাবটাও জানতে হবে।

সুতরাং প্রশ্নটা থেকেই গেল। তথাগত বাবু বরাবরই বলে থাকেন, আই অ্যাম মোর আরএসএস দ্যান বিজেপি। মমতার ভোটব্যাংক যখন জামায়াত ও বিএনপি তখন বিজেপি চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে মতুয়াদের দলে টানতে। এ নিয়ে বিজেপি ও তৃণমূল যে হারে অর্থব্যয় করছে তা আর লুকানো নেই। তথাগত রায় শুধু আরএসএস নয়, ব্যক্তিগতভাবেও বাংলাদেশবিদ্বেষী। বিরোধী দল কংগ্রেস ও বামপন্থিরা মনে করে, মোদির উচিত মুজিব শতবর্ষে তার প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর জন্য এইচুক্তি পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনের আগেই করা। তা না হলে প্রতিবেশী রাষ্ট্রকে তাদের প্রকৃত পাওনা থেকে বঞ্চিত করে অপমান করা হবে।

ফারাক্কার পানিচুক্তি নিয়ে সাবেক মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু ও সাবেক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বরকত গনি খান চৌধুরীর মধ্যে বাংলাদেশের পানিসম্পদমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাকের মধ্যস্থতায় যদি ১১ মিনিটের মধ্যে সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হয় তাহলে মোদি কেন ১১ বছর লাগাচ্ছেন? এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাচ্ছে না।

 

সর্বশেষ খবর