বুধবার, ৩১ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা

কভিড আগ্রাসন ও পুলিশের ভূমিকা

জহিরুল হক শামীম

করোনার প্রথম ধাক্কা সামলে উঠতে না উঠতেই দ্বিতীয় ধাক্কা ছোবল জেনেছে। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ নিয়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বব্যাপী। ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিস এক মাসেরও বেশি সময়ের জন্য লকডাউনে গেছে। ফ্রান্সের ১৫টি বিভাগেও ১৯ মার্চ মধ্যরাত থেকে লকডাউন শুরু হয়েছে। সৌদি আরব, তানজানিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, পোল্যান্ড, ইউক্রেনসহ অনেক দেশ লকডাউন দিয়েছে। স্পেন জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে। জার্মানি এবং ইতালিও আংশিক লকডাউন দিয়েছে। ওয়ার্ল্ডোমিটারের হিসাব অনুযায়ী বিশ্বে ১৯ মার্চ পর্যন্ত করোনায় মোট আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১২ কোটি ২৪ লাখ। মোট মৃত্যু ২৭ লাখ ৫ হাজার। বর্তমানে বিশ্বে দিনে আক্রান্ত হচ্ছে ৫ লাখ করে। মৃত্যু হচ্ছে সাড়ে ১০ হাজার মানুষের।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বারবার দেশবাসীকে মাস্ক পরার আহ্বান জানানোর পাশাপাশি, সবার মাস্ক পরা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে আইন প্রয়োগের নির্দেশনা দিয়েছেন। সরকার ‘নো মাস্ক, নো সার্ভিস’ নীতি কার্যকর করার উদ্যোগও গ্রহণ করেছে।

বাংলাদেশ পুলিশ করোনাভাইরাস সম্পর্কে ইতিমধ্যে জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে ২১ মার্চ ২০২১ থেকে ‘মাস্ক পরার অভ্যাস, কভিডমুক্ত বাংলাদেশ’ স্লোগানে দেশব্যাপী উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশ পুলিশের ইন্সপেক্টর জেনারেল ড. বেনজির আহমেদ বিপিএম (বার) ১৮ মার্চ সকালে রাজারবাগে বাংলাদেশ পুলিশ অডিটরিয়ামে করোনা প্রতিরোধে জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে আয়োজিত প্রেস ব্রিফিংয়ে এ কথা জানান। এসব কর্মসূচির আওতায় কভিড-১৯ মোকাবিলায় কমিউনিটি পুলিশিং ও বিট পুলিশিংয়ের মাধ্যমে উদ্বুদ্ধকরণ সভা করা হবে। এ সময় দরকার হলে পুলিশ জনগণের মাঝে মাস্কও বিতরণ করবে। কোনো স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন পুলিশের সঙ্গে এ কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে চাইলে তাদের সাদর আমন্ত্রণ জানিয়েছেন আইজিপি।

বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণের এক বছর পার হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সফল উদ্যোগ ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্ব এবং দেশের জনগণের সার্বিক সহযোগিতায় বাংলাদেশ করোনা মোকাবিলায় সক্ষম হয়েছে। করোনাকালে বাংলাদেশ পুলিশ সদস্যরা নিজের জীবনের মায়া ত্যাগ করে কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করা, ঘরে ঘরে খাবার পৌঁছে দেওয়া, অসুস্থদের হাসপাতালে পৌঁছানো, লাশ দাফন এমনকি জানাজাও পড়েছে। করোনা মোকাবিলায় ৮৫ জন পুলিশ সদস্য ইতিমধ্যে প্রাণ উৎসর্গ করেছেন। যে আটটি দেশ করোনা মোকাবিলায় সাফল্য দেখিয়েছে তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। করোনা মোকাবিলায় সাফল্যের ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ প্রথম। আবার করোনার টিকা পাওয়া ২২টি দেশের তালিকায়ও রয়েছে বাংলাদেশ। এ পর্যন্ত দেশের ৪৫ লাখ মানুষ করোনার টিকা নিয়েছেন। আমাদের দেশের লোকসংখ্যা ১৮ কোটি। দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কার্যক্রম গতিশীল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে করোনা প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থায় শিথিলতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। আকস্মিকভাবে বর্তমানে করোনা সংক্রমণে ঊর্ধ্বগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। প্রতিদিন গড়ে প্রায় এক হাজার মানুষ করোনাক্রান্ত হচ্ছে। আমাদের করোনা সংক্রমণ মোকাবিলা করতে প্রত্যেককে ঘর থেকে বের হওয়ার সময় অবশ্যই মাস্ক পরতে হবে। করোনা মোকাবিলায় স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে মেনে চলতে হবে। কেননা, দেশে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে অধিক সংক্রমণশীল করোনাভাইরাসের ইউকে ভেরিয়েন্ট। ফলে সংক্রমণ বাড়ছে। এমত পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও ইউজিসি অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার আহ্বান জানিয়েছেন। আইসিডিসিআরবি উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন ও কভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য ডা. নজরুল ইসলাম মাস্ক পরার জন্য গুরুত্বরোপ করেছেন।

কিন্তু এ কথা স্বীকার করতেই হবে জনগণের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিষয়ে শিথিলতা প্রবলভাবে বিদ্যমান। মাস্ক পরার বিষয়ে রয়েছে অনীহা। যদিও রাজধানী ঢাকাসহ অন্যান্য নগরীতে পুলিশ জনগণকে সচেতন করতে নিজেরা মাস্ক বিতরণ করছে। কোথাও কোথাও মাস্ক না পরার অপরাধে জরিমানাও করছে। কিন্তু জনগণ নিজেরা যদি সচেতন না হন তাহলে হিতে বিপরীত হতে পারে। এ প্রসঙ্গে রবিঠাকুরের ‘জুতা আবিষ্কার’ কবিতাটির উল্লেখ অপ্রাসঙ্গিক হবে না। চামার কুলপতি জুতা আবিষ্কার কবিতায় ধুলা দূর করার বদলে পা দুটি ঢেকে রাখার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তেমনি আমরা যদি মাস্ক পরে নিজেদের নাক-মুখ ঢেকে রাখি তাহলে আমাদের ঘরে আটকে রাখার জন্য বাধ্য হয়ে রাষ্ট্রকে জরুরি অবস্থা জারি, কারফিউ অথবা লকডাউনে যেতে হবে না। করোনাযুদ্ধে মাস্কই হতে পারে প্রতিরোধের অন্যতম হাতিয়ার। সুতরাং সবাইকে সচেতনভাবে মাস্ক পরার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। প্রয়োজনে সরকারকেও নিতে হবে কঠোর ভূমিকা। দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে সরকার লকডাউন উঠিয়ে দিয়েছে। কিন্তু স্বাস্থ্যবিধি মেনে কাজকর্ম করা তো আমাদের দায়িত্ব। মনে রাখতে হবে অর্থনীতির চাকা বন্ধ হলে শুধু করোনায় নয়; অনাহারেও মরতে হতে পারে। যারা টিকা নিয়েছেন তাদেরও মাস্ক পরতে হবে। যারা এখনো টিকা নেননি তাদের দ্রুত টিকা নেওয়াই স্বাস্থ্যসম্মত। প্রয়োজন স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা- নিজেদের পরিবার পরিজনের স্বার্থে। সর্বোপরি দেশের স্বার্থে। মনে রাখতে হবে পৃথিবী থেকে করোনা বিদায় নেয়নি। দ্রুত বিদায় নেবে এমন লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। সুতরাং দীর্ঘকাল আমাদের করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেই হয়তো বাঁচতে হবে। এক্ষেত্রে বিশ্ববাসীর কাছে আপাতত একমাত্র হাতিয়ার মাস্ক। মাস্ক ব্যবহার করে ও স্বাস্থ্যবিধি মেনেই লড়াই করা সম্ভব মরণব্যাধি করোনার বিরুদ্ধে। আসুন নিজে মাস্ক পরি, অন্যকে পরতে উৎসাহিত করি।

লেখক : সাংবাদিক।

সর্বশেষ খবর