শনিবার, ১০ এপ্রিল, ২০২১ ০০:০০ টা
লকডাউনের প্রজ্ঞাপন

আমলাদের সংবিধান লঙ্ঘন

সৈয়দ বোরহান কবীর

আমলাদের সংবিধান লঙ্ঘন

ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সম্পর্কে বহুল প্রচারিত এবং জনপ্রিয় একটি কথা আছে। কথাটি হলো, ‘ব্রিটিশ পার্লামেন্ট, একজন নারীকে পুরুষ এবং একজন পুরুষকে নারীতে রূপান্তর ছাড়া সবকিছু করতে পারে।’ সম্ভবত সংসদীয় গণতন্ত্রের পরিধি এবং ক্ষমতার বিশালতা বোঝাতেই এ রকম মন্তব্য প্রচলিত হয়েছে। বাংলাদেশে এখন এ উক্তির ভিন্ন ও নতুন সংস্করণ দেওয়া যায়। এ দেশের আমলাতন্ত্র নারীকে পুরুষ এবং পুরুষকে নারীও বানাতে পারে। ব্রিটেনের আদলেই বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রচলিত। কিন্তু সংসদের ক্ষমতা ও কার্যকারিতা কতটুক তা সবাই জানে। সংসদীয় গণতন্ত্রের মোড়কে বাংলাদেশে এখন আমলাদের শাসন দৃশ্যমান। মুজিববর্ষ উদ্্যাপন থেকে করোনা মোকাবিলার নির্দেশনা সবই পরিচালিত হচ্ছে আমলাতন্ত্রের নিপুণ হাতে। তারা সব বিষয়ে পন্ডিত, বিশেষজ্ঞ। তাদের অজানা কিছু নেই। তারা পারেন না এমন কোনো কাজ বাংলাদেশে নেই। সর্বশেষ বাংলাদেশের আমলাতন্ত্র এক অসাধারণ আবিষ্কারের জন্য পুরস্কৃত হতেই পারে। বাংলাদেশ ৫ এপ্রিল থেকে লকডাউনে আছে। এ এক অদ্ভুত লকডাউন। এ রকম লকডাউন বিশে^ খুঁজে পাওয়া যাবে না। তাই একে বিরল প্রজাতির লকডাউন বলা ভালো। এ লকডাউনের ঘোষণায় রাষ্ট্রের আইন ও সংবিধান মানা হয়নি।

৩ এপ্রিল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী জানালেন করোনার প্রকোপ বাড়তে থাকায় দেশে ৫ এপ্রিল সাত দিনের লকডাউন শুরু হবে। বিষয়টি আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের কিংবা সেতুমন্ত্রীর এখতিয়ারাধীন কি না এ প্রশ্ন কেউ কেউ করলেন। কিন্তু একটি রাজনৈতিক সরকারের দ্বিতীয় ক্ষমতাবান ব্যক্তির এ ধরনের ঘোষণা দেওয়ার মধ্যে দোষের কিছু নেই। রাজনৈতিক সরকারের সব কর্মকান্ডই পরিচালিত হবে রাজনীতি দিয়ে। তাই তার এ ঘোষণায় আমি মোটেও বিস্মিত নই। তবে বিশে^র সব দেশে আমরা দেখি লকডউন আগাম ঘোষণা দিয়ে দেওয়া হয় না। এটি তৎক্ষণাৎ কার্যকর হয়। যেন মানুষ এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাওয়ার সুযোগ না পায়। এ অভিজ্ঞতা গত বছরের মার্চে আমাদের হয়েছে। সে সময় অবশ্য আমলারা এর নাম ‘লকডাউন’ না দিয়ে ‘সাধারণ ছুটি’ বলেছিলেন। তখনো চার দিন আগে ঘোষণা দিয়ে এক হুলস্থুল কান্ড বাধিয়ে ফেলা হয়েছিল। যে যেভাবে পেরেছিল ঢাকা ত্যাগ করেছিল। এ নিয়ে সমালোচনা কম হয়নি। কিন্তু বাংলাদেশের আমলাদের একটি বড় গুণ তারা সমালোচনাকে মোটেও পাত্তা দেন না। ওবায়দুল কাদের ৩ এপ্রিলে কেন ৫ এপ্রিলের লকডাউনের ঘোষণা দিলেন? সম্ভবত তিনি জনতেন এরপর পুরো ব্যাপারটি আমলারা দখল করে নেবেন। তাই রাজনৈতিক সরকারের ন্যূনতম উপস্থিতি জানান দিতেই আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বোধকরি এ ঘোষণা দিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের ঘোষণার ঘণ্টাখানেকের মধ্যে টেলিভিশন পর্দায় উদ্ভাসিত হলেন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী। তিনি জানালেন ‘লকডাউন আসছে। আজ রাতে (শনিবার) অথবা কাল এ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে। এবার লকডাউন হবে কঠোর।’ আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের ঘোষণার পর জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রীর এ ঘোষণা কতটা দরকারি ছিল? ‘শিষ্টাচার’ বাংলা ভাষায় একটি মূল্যবান শব্দ। ছোটবেলা থেকে শিখেছি, বড়রা যখন কথা বলবেন ছোটরা চুপ করে থাকবে। আমি ভাবলাম, বিষয়টা বোধহয় জনপ্রশাসন মন্ত্রনালয়ের তাই তিনি এ নিয়ে বলেছেন। একটি সরকার পরিচালিত হয় ‘রুলস অব বিজনেস’ ও ‘অ্যালোকেশন অব বিজনেস’ দ্বারা। সেখানে দেখলাম জনপ্রশাসন মন্ত্রনালয়ের যাবতীয় কর্মকান্ড হলো ‘সরকারি কর্মকর্তা/কর্মচারী সংক্রান্ত। তাদের নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি, শাস্তিবিষয়ক।’ তাহলে প্রশ্ন উঠতেই পারে, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় লকডাউন/ছুটি নিয়ে এত হইচই করে কেন?

সকাল পেরিয়ে দুপুর গড়াতেই জানা গেল মন্ত্রিপরিষদ সচিব লকডাউনের পরিধি, কী করা যাবে, কী করা যাবে না ইত্যাদি নিয়ে সিনিয়র সচিবদের সঙ্গে জুম বৈঠক করবেন। অর্থাৎ লকডাউনের বিষয়টি চলে গেল আমলাদের হাতে। মন্ত্রিপরিষদ সচিবের নেতৃত্বে একগুচ্ছ আমলা লকডাউন বিধিনিষেধ প্রণয়ন করলেন। আবার জানতে ইচ্ছা করল, সরকার পরিচালনায় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের কাজ কী? মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের কার্যপরিধি দেখে একটু ভিরমি খেলাম। এ বিভাগের কাজ হলো প্রধানমন্ত্রীর অভিপ্রায় অনুযায়ী ‘মন্ত্রিসভার বৈঠক ডাকা। বৈঠকের আলোচ্যসূচি নির্ধারণ করা। মন্ত্রিপরিষদের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন মনিটরিং, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়/বিভাগের সফঙ্গ মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সমন্বয় এবং নির্দেশনা প্রদান, ইত্যাদি।’ করোনা মোকাবিলায বিধিনিষেধ আরোপের ক্ষমতা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের কোথায়?

আমাদের মতো নিপাট মূর্খ মানুষ সবকিছুতেই বইয়ের দ্বারস্থ হয়। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে যে প্রজ্ঞাপনটি জারি করা হয়েছে তাতে কোনো আইন বা বিধির উল্লেখ নেই। কোন আইন বা ক্ষমতা বলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এ প্রজ্ঞাপন জারি করল? প্রজ্ঞাপনটি জারি করা হয়েছে মাঠপ্রশাসন সমন্বয় অধিশাখা থেকে। পুরো প্রজ্ঞাপনে ১১টি বিধিনিষেধ জারি করা হয়েছে। এ বিধিনিষেধের বেশির ভাগই বাংলাদেশের সংবিধানের তৃতীয় ভাগে বর্ণিত ‘মৌলিক অধিকার’ অংশের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সংবিধানের ৩৬ অনুচ্ছেদে চলাফেরার স্বাধীনতা, ৩৭ অনুচ্ছেদে সমবেত হওয়ার স্বাধীনতা, ৪০ অনুচ্ছেদে পেশার স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে।

‘জনস্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসংগত বাধানিষেধ’ ছাড়া এ মৌলিক অধিকার হরণ করা যাবে না। সংবিধানের ২৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘মৌলিক অধিকারের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ আইন যতটা অসমাঞ্জস্যপূর্ণ হবে ততটুকু বাতিল হবে।’ তাহলে প্রথমেই বলে নিতে হয়, ৪ এপ্রিলের এ প্রজ্ঞাপনটি মৌলিক অধিকারসংক্রান্ত বেশ কয়েকটি অনুচ্ছেদের পরিপন্থী। কাজেই এটি অসাংবিধানিক। প্রশ্ন উঠতেই পারে, সরকার রাষ্ট্র ও জনগণের স্বার্থে এ ধরনের বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে না? অবশ্যই পারে। এজন্যই আমাদের সংবিধান এসব মৌলিক অধিকারকে ‘শর্তহীন’ করেনি। শর্তযুক্ত করেছে। কিন্তু মৌলিক অধিকারকে সাময়িকভাবে স্থগিত করতে হলে তা আইনগত যথার্থতার মাধ্যমে করতে পারে। যেমন জনস্বার্থ বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কায় সমাবেশের ওপর আইন প্রয়োগকারী সংস্থা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারে। শান্তি বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কায় জনচলাচল সীমিত করার, মৌলিক অধিকারের কিছু কিছু অনুচ্ছেদ স্থগিত রাখার আইন ও বিধান আছে। মহামারী নিয়ন্ত্রণেও সরকার বিভিন্ন বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে। বর্তমান সরকারই এ-সংক্রান্ত একটি চমৎকার আইন প্রণয়ন করেছে ২০১৮ সালে। ‘সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন, ২০১৮-তে সুস্পষ্টভাবে এ ধরনের বিধিনিষেধ আরোপের ক্ষমতা সরকারকে দেওয়া হয়েছে। তবে এ আইন অনুযায়ী এ ধরনের বিধিনিষেধ আরোপের কর্তৃত্ব স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকের। এ আইনের ১(ণ)-তে বলা হয়েছে ‘সংক্রামক রোগের বিস্তার রোধে কোনো বাজার, গণজমায়েত, স্টেশন, বিমান, নৌ ও স্থল বন্দরগুলো সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষণা করতে পারবে।’

আইনে ১ (ত)-তে বলা হয়েছে ‘সংক্রামক রোগের বিস্তার রোধে উড়োজাহাজ, জাহাজ, জলযান, বাস, ট্রেন ও অন্যান্য যানবাহন দেশে আগমন, নির্গমন বা দেশের অভ্যন্তরে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে চলাচল নিষিদ্ধকরণ।’ আইনের ১১ ধারায় স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালককে যে কোনো এলাকাকে সংক্রমিত এলাকা ঘোষণা করে যেখানে প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।

লক্ষণীয়, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের পক্ষ থেকে যে প্রজ্ঞাপনটি জারি করা হয়েছে সেখানে আইনগত কর্তৃত্বের কথা বলা হয়নি। আইনের শাসনের একটি প্রধান শর্ত হলো কোন আইনের ক্ষমতাবলে সরকার কাজটি করছে তা উল্লেখ করা। কিন্তু ৪ এপ্রিলের প্রজ্ঞাপনে আইনের নাম-নিশানাও নেই। এ প্রজ্ঞাপনটি দেশের সংবিধান, প্রচলিত আইন ও বিধিবিধানের প্রতি চরম অবমাননা এবং উপেক্ষার একটি দলিল। কোনো সরকার বা কোনো আমলা যা খুশি নির্দেশ দিতে পারেন না। তাকে সবকিছু করতে হবে আইনের আওতায়। আইনসম্মতভাবে।

লকডাউন নিয়ে সেতুমন্ত্রীর বক্তব্যকে আমরা একটি সরকারের মহামারী প্রতিরোধে রাজনৈতিক অভিপ্রায় বলে মেনে নিতে পারি। কিন্তু লকডাউন নিয়ে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী কেন কথা বললেন বোধগম্য নয়। তার চেয়েও দুর্বোধ্য হলো এ নিয়ে আমলাদের বৈঠক ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের প্রজ্ঞাপন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, অধিদফতর কোথায়? একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আইনকানুন মানতে আমলাদের এত অনীহা কেন? তারা কি সংক্রামক আইনটির কথা জানেন না?

গত রবিবার বাংলাদেশ প্রতিদিন সম্পাদক বন্ধু নঈম নিজাম একটি অসাধারণ লেখায় কিছু মৌলিক প্রশ্ন সামনে এনেছেন। ‘প্রশাসনের কাজ মিছিল নয়, মানুষের জানমাল রক্ষা’। লেখার পরতে পরতে অনেক ইঙ্গিত আছে। কিন্তু একটি স্পষ্ট সংকেত পেয়েছি ওই লেখাটিতে। তা হলো, যার যা দায়িত্ব তা সঠিকভাবে ও নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করা দরকার। এখন আমলারা নিজেদের দায়িত্ব ভুলে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় ব্যস্ত। লকডাউনের এ পরিকল্পনা ও ঘোষণা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে দিয়ে করালে কি মহাভারত অশুদ্ধ হতো, আমি জানি না। এ রকম একটি প্রজ্ঞাপন যার মূল লক্ষ্য হলো করোনা সংক্রমণের লাগাম টেনে ধরা তা প্রণয়নে চিকিৎসক এবং বিশেষজ্ঞদের মতামত নিলে কি সমস্যা হতো? প্রশাসনের কাজ যেমন মিছিল করা নয়, তেমনি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের কাজ সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ নয়। কিন্তু আমাদের আমলাদের ক্ষমতা অসীম। তারা সবকিছু করেন। এটা করতে গিয়ে সংবিধান ও আইন লঙ্ঘন করেন। আর এর দায় গিয়ে পড়ে সরকারের ওপর। লকডাউন-সংক্রান্ত যে প্রজ্ঞাপনটি জারি হয়েছে তা এখন বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় কৌতুক। এ লকডাউনে বইমেলা খোলা রাখা হয়েছে। অর্থাৎ আপনি বাড়ি থেকে বেরিয়ে বইমেলায় গিয়ে অবাধে ঘোরাঘুরি করতে পারবেন। প্রথম দুই দিন গণপরিবহন বন্ধ ছিল, কিন্তু সীমিত পরিসরে সরকারি-বেসরকারি অফিস খোলা রাখার কথা বলা হয়েছে। গণপরিবহন বন্ধ রেখে অফিস খোলা রাখা কীভাবে সম্ভব? এ নিয়ে অনেক কথাবার্তার পরও আমলারা ভুল স্বীকার করেননি। এ প্রজ্ঞাপনের অসংগতি ও অসামঞ্জস্যতা নিয়ে গত কয়েক দিনে গণমাধ্যমে অনেক কথাবার্তা হয়েছে। তাই নতুন করে সে প্রসংগের অবতারণা করতে চাই না। তবে আমার বিবেচনায় এ প্রজ্ঞাপনটি একটি অমূল্য দলিল। আমলারা কতটা জনবিচ্ছিন্ন তার দলিল। আমলারা কতটা গণবিরোধী হয়ে উঠেছেন তার প্রমাণপত্র। এ আমলারা জনগণ নিয়ে ভাবেন না। মানুষের কল্যাণকামিতার কোনো চিন্তা এদের মধ্যে নেই। এরা শুধু বোঝেন নিজেদের চেয়ারকে চিরস্থায়ী করা। এ ক্ষেত্রে এদের সাফল্য ঈর্ষণীয়। যারা এ অমূল্য প্রজ্ঞাপন প্রণয়নে জড়িত তারা নিজেদের ইতিমধ্যে অপরিহার্য প্রমাণ করেছেন। এদের বেশির ভাগই চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্ত। কাজেই যে কৌশলে এরা চুক্তিতে আছেন সে কৌশলে এরা ক্ষমতাবান থাকতে চান। বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ রাজনীতিবিদ ও আমলাদের পার্থক্য বুঝিয়েছিলেন চমৎকারভাবে। অত্যন্ত সহজ করে। তিনি বলেছিলেন, ‘আমলারা সবকিছু কার্পেটের তলায় ঢুকিয়ে রেখে বাইরে ফিটফাট দেখানোর চেষ্টা করে। এরা কোনো সমস্যার মুখোমুখি হতে চায় না। সমস্যাকে ধামাচাপা দিতে চায়। আর রাজনীতিবিদরা বাস্তবতাকে আলিঙ্গন করে। সমস্যার সমাধানের পথ খোঁজে।’ বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণের শুরু থেকেই আমলারা এ কার্পেট নীতি অনুসরণ করে চলেছেন। এর ফলে প্রতিদিন আমরা নিত্যনতুন সমস্যার মধ্যে ডুবে যাচ্ছি। আর সবকিছু ধামাচাপা দিয়ে আমলারা এখন দেশের হর্তাকর্তা হয়ে বসে আছেন। আর সমস্যায় জর্জরিত মানুষ দিশাহারা।

লকডাউনের হাস্যকর ও অসাংবিধানিক প্রজ্ঞাপনের পর আমি আশা করব সরকারের বোধোদয় ঘটবে। আমলাদের হাত থেকে ক্ষমতা জনগণের প্রতিনিধিদের দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হবে। সবকিছুতে আমলানির্ভরতার পথ থেকে সরকার সরে আসবে। এ লকডাউনের প্রজ্ঞাপনটি সরকারকে জনগণের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করিয়েছে। বিশেষ করে স্বল্প ও মাঝারি আয়ের মানুষ রাজপথে নামছে। আমলারা কি তাদের অযোগ্যতায় এ কাজ করেছেন নাকি জনগণকে খেপিয়ে তোলার পরিকল্পিত নীলনকশা এটি? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে। আমরা বিভিন্ন সময়ে দেখেছি আমলারা সরকারকে ভুল পথে পরিচালিত করেছেন। জনবিচ্ছিন্ন করেছেন। বিভ্রান্ত করেছেন। সরকারের পতনের পর হাঁসের মতো গা ঝেড়ে সাধু হয়ে গেছেন।

এরশাদ আমলের দুই প্রভাবশালী আমলা এরশাদের সার্বক্ষণিক ছায়াসঙ্গী ছিলেন। এরশাদ সব বিষয়ে তাদের পরামর্শকে গুরুত্ব দিতেন। এরশাদের পতনের পরপরই তারা ছুটে গেলেন ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে, বঙ্গবন্ধু ভবনে। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চাইলেন। এরশাদের সহযোগীদের তালিকায় এ দুই আমলার নাম ছিল। তিন জোটের রূপরেখায় বলা হয়েছিল, এরশাদের দোসরদের কেউ কোনো দলে জায়গা দেবে না। তাই আওয়ামী লীগ সভানেত্রী তাদের আবেদন প্রত্যাখ্যান করলেন। তাদের ফিরিয়ে দিলেন। সেখান থেকেই দুই আমলা ছুটে গেলেন বিএনপি কার্যালয়ে। বেগম জিয়া তাদের বরণ করে নিলেন। দুজনই ‘ধানের শীষ’ প্রতীকে নির্বাচনও করলেন। ওই নির্বাচনে জয়ী হয়ে বিএনপি সরকার গঠন করেছিল। এরশাদের ঘনিষ্ঠ ওই দুই আমলা বিএনপির মন্ত্রিসভায় স্থানও পেয়েছিলেন। এ ঘটনাটি উল্লেখ করলাম আমলাদের সুবিধাবাদী চরিত্র বোঝানোর জন্য। এরা নিজেকে ছাড়া কাউকে নিয়ে ভাবেন না। কাউকে ভালোবাসেন না। এরা নিজেদের স্বার্থের জন্য সবকিছু করতে পারেন। আজকে যারা বঙ্গবন্ধু বঙ্গবন্ধু বলে মাতম তুলছেন, যারা সকালসন্ধ্যা প্রধানমন্ত্রীর কাছে চাটুকারিতায় ভরা কিছু স্তুতি করছেন তারা কি আসলে এ সরকারের ভালো চান? আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রীকে নির্মোহভাবে এ প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে। প্রধানমন্ত্রী পঁচাত্তর-পরবর্তী আওয়ামী লীগের ভূমিকা নিয়ে খোলাখুলি কথা বলেন। একাধিক ভাষনে তিনি বলেছেন ‘এত বড় দল, এত নেতা তারা সেদিন কোথায় ছিল?’ পঁচাত্তরের পর আমলাদের ভূমিকা এবং অবস্থান নিয়েও নির্মোহ তথ্যানুসন্ধান করা যেতে পারে। সে সময় বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ আমলারা ১৫ আগস্টের পর কী করেছেন? কে খুনি মোশতাককে শপথ পাঠ করিয়েছেন? বঙ্গবন্ধুর রক্তের দাগ শুকানোর আগেই কোন আমলা খুনি মোশতাকের অনাপত্তিপত্র নিয়ে বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য গেছেন? এসব প্রশ্নের উত্তর নিশ্চয়ই প্রধানমন্ত্রীর জানা। তাই এ আমলাদের হাতে দেশ ছেড়ে দেবেন না প্লিজ। সুবিধাবাদী আমলারা জনগণের জন্য ক্ষতিকারক। লকডাউনের প্রজ্ঞাপন তার একটি প্রমাণমাত্র।

লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত।

[email protected]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর