রবিবার, ৯ মে, ২০২১ ০০:০০ টা

লাইলাতুল কদরের ফজিলত ও আমল

এম এ মান্নান

লাইলাতুল কদরের ফজিলত ও আমল

মহিমান্বিত রাত লাইলাতুল কদর। আরবি ভাষায় লাইলাতুল কদরের অর্থ হচ্ছে মর্যাদাপূর্ণ ও মহিমান্বিত রাত। এ রাতকে হাজার মাসের সেরা হিসেবেও অভিহিত করা হয়। কারণ মানব জাতির চলার পথের গাইডলাইন আল কোরআন নাজিল হয়েছে এ রাতে। কোরআনের ছোঁয়ায় একটি সাধারণ রাত ‘লাইলাতুল কদর’ বা সম্মানিত রাতে বিভূষিত হয়েছে। কোরআনের সঙ্গে যার যতটুকু সম্পর্ক ও সংস্পর্শ থাকবে, সে ততটুকু সম্মানিত ও মর্যাদার অধিকারী হবে। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘কোরআনওয়ালাই আল্লাহওয়ালা এবং তাঁর খাস ব্যক্তি।’ বুখারি। ‘যার অন্তরে কোরআনের সামান্যতম অংশও নেই, সে যেন এক বিরান বাড়ি।’ বুখারি, মুসলিম। লাইলাতুল কদর রমজানের মধ্যেই। রসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা রমজানের শেষ দশকের বিজোড় রাতগুলোয় শবেকদর সন্ধান কর।’ মুসলিম। এ রাতগুলো হলো ২১, ২৩, ২৫, ২৭ ও ২৯। আরবিতে দিনের আগে রাত গণনা করা হয়। মুহাক্কিকরা বলেন, আরবিতে ‘লাইলাতুল কদর’ শব্দদ্বয়ে নয়টি হরফ বা আরবি বর্ণ রয়েছে; আর সুরা কদরে ‘লাইলাতুল কদর’ শব্দদ্বয় তিনবার রয়েছে; নয়কে তিন দিয়ে গুণ করলে সাতাশ হয়, তাই সাতাশ রমজানের রাতে শবেকদর হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। তাফসিরে মাজহারি। রসুল (সা.) একবার বনি ইসরাইলের জনৈক ব্যক্তির ব্যাপারে বলেন, ‘বনি ইসরাইলের জনৈক ব্যক্তি সমস্ত রাত ইবাদতে কাটিয়ে দিত এবং সারা দিন জিহাদে লিপ্ত থাকত। এভাবে সে এক হাজার মাস পর্যন্ত কাটিয়ে দিত।’ এ কথা শুনে সাহাবায়ে কিরাম পরিতাপ করলেন, আমাদের তো  এত দীর্ঘ হায়াত পাওয়ার সুযোগ নেই। সুতরাং এমন মর্যাদা প্রাপ্তিও হবে না! সাহাবায়ে কিরামের এমন পরিতাপের দাবিতে এবং শেষ জমানার উম্মতের শ্রেষ্ঠত্বের পূর্ণতাদানের সুযোগ হিসেবে মহান আল্লাহ ‘সুরা কদর’ নাজিল করে মুসলিম উম্মাহকে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের সুযোগ করে দিলেন। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই আমি কোরআন নাজিল করেছি মহিমান্বিত কদর রাতে। আপনি কি জানেন কদরের রাত কী? মর্যাদাপূর্ণ কদর রাত হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। সে রাতে ফেরেশতাসহ হজরত জিবরাইল (আ.) অবতরণ করে; তাদের মহান প্রভুর নির্দেশক্রমে, সব বিষয়ে শান্তির বার্তা নিয়ে। এ শান্তির ধারা চলতে থাকে ফজরের উদয় পর্যন্ত।’ সুরা কদর, আয়াত ১-৫। এ সুরায় কদরের রাতকে হাজার মাস থেকেও শ্রেষ্ঠ বলা হয়েছে। অর্থাৎ এ রাতকে হাজার মাস বা প্রায় ৮৩ বছর চার মাস সমান মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। এ হিসাবে কেউ যদি জীবনে ১২টি রমজানে লাইলাতুল কদরের ফজিলত অর্জন করতে পারে তখন সে এক হাজার বছর ইবাদত করার চেয়ে বেশি ফজিলত পেয়ে যাবে। কোরআন নাজিলের কারণেই লাইলাতুল কদরের এত মর্যাদা। হজরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) রসুলুল্লাহ (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রসুল! (সা.) আমি যদি লাইলাতুল কদর সম্পর্কে জানতে পারি তাহলে আমি ওই রাতে আল্লাহর কাছে কী দোয়া করব? রসুলুল্লাহ (সা.) বললেন তুমি বলবে, ‘আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউন, তুহিব্বুল আফওয়া; ফাফু আন্নি’। অর্থাৎ ‘হে আল্লাহ! আপনি ক্ষমাশীল, ক্ষমা করতে ভালোবাসেন; তাই আমাকে ক্ষমা করে দিন।’ ইবনে মাজা, আলবানি।

ইতিকাফের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো শবেকদর প্রাপ্তি; রমজানের শেষ দশক ইতিকাফ করলে শবেকদর প্রাপ্তি প্রায় নিশ্চিত হয়ে যায়। ইতিকাফের মূল কথা হলো সবকিছু ছেড়ে আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে যাওয়া। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, রসুল (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি ইমানের সঙ্গে সওয়াবের নিয়তে কদরের রাত জেগে ইবাদত করবে, তার অতীতের গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে। বুখারি।

রসুল (সা.) রমজানের প্রতীক্ষায় সারা বছর প্রহর গুনতেন। কদরের ফজিলত পেতে রমজানের শেষ দশকে ইবাদতের জন্য প্রস্তুতি নিতেন, রাত জেগে ইবাদত করতেন, নিজের পরিবারবর্গকে জাগিয়ে দিতেন। বুখারি। কদরের ফজিলত পাওয়ার উদ্দেশ্যে রমজানের শেষ দশকের বিজোড় রোজার রাতে নফল ইবাদত করা। কোরআন তিলাওয়াত করা, তাসবিহ তাহলিল পাঠ করা। দুই রাকাত করে নফলের নিয়তসহ যে কোনো সুরা সুরা ফাতিহার সঙ্গে মিলিয়ে নামাজ পড়া। উত্তম হলো নফল নামাজ ধীরে-সুস্থে লম্বা লম্বা কিরাত দিয়ে পড়া এবং ধীরস্থিরে রুকু-সিজদা আদায় করা। লাইলাতুল কদর হলো বছরের শ্রেষ্ঠ রাত। এ রাতের শ্রেষ্ঠ দোয়া হলো ক্ষমা চাওয়ার দোয়া। এ রাতে মহানবী (সা.) ক্ষমা চাওয়ার শিক্ষা দিয়েছেন। বলেছেন, কেউ যদি জীবনে অনেক কিছু পায় কিন্তু তার গুনাহর জন্য ক্ষমা না পায় তাহলে তার জীবন ব্যর্থ। তাই এ রাতে অন্তর নরম করে চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়ার আগে খাঁটি দিলে তওবা-ইসতিগফার করতে হয়। খাঁটি তওবার চারটি শর্ত : আগের গুনাহ থেকে ফিরে আসা বা গুনাহ ছেড়ে দেওয়া; গুনাহর জন্য মনে মনে অনুতপ্ত হতে হবে যে আমি বড়ই অন্যায় করেছি; ভবিষ্যতে ওই গুনাহ আর করব না বলে মনে মনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করতে হবে; বান্দার কোনো হক নষ্ট করে থাকলে যথাসাধ্য সে হক আদায় করে দিতে হবে। এ রাতের আরেকটি আমল ফুকাহায়ে কিরাম বলেছেন যে, এ রাতে ইবাদতের আগে যদি কেউ গোসল করে নিতে পারে তার সেটাই উত্তম। ওই আমলগুলো শুধু ২৭ রমজান নয়, বরং রমজানের শেষ ১০ দিনের প্রতি বিজোড় রাতে লাইলাতুল কদর তালাশ করতে হবে। এজন্য রসুল (সা.) রমজানের শেষ ১০ দিনে ইতিকাফ করতেন। আর উম্মতের জন্য শরিয়তে ইতিকাফের বিধান কিয়ামত পর্যন্ত জারি রেখে গেছেন যেন তারা ইতিকাফের মাধ্যমে লাইলাতুল কদরের গুরুত্ব দিয়ে প্রতিটি বিজোড় রাতে ইবাদত করতে পারে।

লেখক : ইসলামবিষয়ক গবেষক।

সর্বশেষ খবর