বুধবার, ২৬ মে, ২০২১ ০০:০০ টা

ফিলিস্তিনে আর কত রক্ত ঝরবে

তুষার কণা খোন্দকার

ফিলিস্তিনে আর কত রক্ত ঝরবে

দুনিয়ার অন্যান্য দেশের মুসলমানরা যখন বলছিল, ‘রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’ তখনই জেরুজালেমের মুসলমানদের জীবনে ইসরায়েল রক্তাক্ত বেদনার এক ঈদ উপহার দিয়েছে। শিশু-নারীসহ ২৩২ ফিলিস্তিনি ইসরায়েলের বিমান হামলায় নিহত হয়েছে। ইসরায়েলি রকেটের স্পিøন্টারের আঘাতে রক্তাক্ত হয়েছে অগণিত শিশু। শুক্রবার যুদ্ধবিরতির আগ পর্যন্ত ইসরায়েল আকাশ থেকে বিমান হামলা এবং মাটি থেকে ছোড়া রকেটের আঘাতে ৬২ শিশুকে কবরের আঁধারে চিরকালের জন্য ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে। ইসরায়েল ২০২১ সালে এ কাজটি প্রথম করছে তা তো নয়। ইসরায়েল রাষ্ট্র তার জন্মের শুরু থেকে আমেরিকার সমর্থন নিয়ে আরব ভূখন্ডের নারী-শিশুসহ নিরীহ সাধারণ মানুষকে নির্বিচারে হত্যার কাজে দারুণ দক্ষতা দেখিয়ে আসছে।

কৌতূহলী পাঠক ২০০৮ সালে গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনের ছবিগুলো মনের পর্দায় জাগিয়ে দেখুন। আপনাদের কি মনে আছে ইসরায়েলের রকেট হামলায় গাজায় ধসে পড়া দেয়ালের নিচে চাপা পড়া চার বছর বয়সী একটি শিশুর মৃত মুখ। শিশুটির বিস্ফারিত দুই চোখের চাউনি আজও আমাকে তাড়া করে ফেরে। মনে হয়, ছিঃ! এ কোন পৃথিবীতে আমরা বেঁচে আছি। এত শত নিষ্পাপ তাজা প্রাণ ইসরায়েলি বর্বরতার কাছে ঝরে গেলেও মানবতার ধ্বজাধারীরা একবার আহা বলার তাগিদ বোধ করে না। ২০০৮ সালে গাজায় ইসরায়েলি বর্বরতার সময় ওবামা ছিলেন হোনেওয়ালা প্রেসিডেন্ট আর তাঁর দোসর ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। উনারা তখন হোয়াইট হাউসে আসীন হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। বারাক হোসেন ওবামা এবং তাঁর দোসর হোয়াইট হাউসে আসীন হয়ে ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধান করবেন তাঁদের কাছে এতটা আশা করিনি। আমরা ভেবেছিলাম, জেরুজালেম, গাজা কিংবা পশ্চিম তীরে বসবাসকারী ফিলিস্তিনিদের দুঃখ অনুভব করে উনারা দুজন একবারের জন্য সামান্য সমবেদনা জানাবেন। হায় খোদা! আসলে সবই আমাদের দূরাশা। বারাক হোসেন ওবামা গদিতে বসে সব হারানো দুঃখী ফিলিস্তিনিদের কথা একবারও ভাবলেন না, বরং তিনি সংবাদ সম্মেলন করে এক ইসরায়েলি সৈন্যের জন্য কেঁদেকুটে বুক ভাসিয়ে দিলেন। বললেন, গাজায় হামাসের সশস্ত্র যোদ্ধারা একজন ইসরায়েলি সৈন্যকে আটক করে একটি সুড়ঙ্গে নিয়ে গেছে যা মানবতার গুরুতর লঙ্ঘন! অবিলম্বে ওই বন্দী সৈন্যকে ছেড়ে না দিলে তিনি কঠোর হতে বাধ্য হবেন। আট বছর ধরে ওবামা ও বাইডেন হোয়াইট হাউস আলো করে বসে গণতন্ত্র আর মানবতার জন্য কত মেকি কান্নাই না কাঁদলেন। এখন ২০২১ সালের ১৬ মে ওবামার ভাইস প্রেসিডন্ট বর্তমানে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলছেন তিনি গাজা ও পশ্চিম তীরে ইসরায়েলের হামলাকে পূর্ণ সমর্থন করেন। ফিলিস্তিনিদের প্রতি তিনি ইসরায়েলে হামলা বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছেন। এটি মানবতার আমেরিকান মডেল। আমেরিকার ইউরোপিয়ান মিত্ররাও মানবতার সংজ্ঞা নির্ধারণের জন্য আমেরিকাকে গুরু মেনে বসে আছে। কাজেই ইউরোপ প্যালেস্টাইন সমস্যা সমাধানের জন্য স্বাধীন মত ব্যক্ত করবে এমনটি কখনো আশা করা যায় না। বর্তমান সময়ে প্যালেস্টাইনে শান্তি আলোচনার প্রসঙ্গ উঠলেই ইসরায়েলের একান্ত অনুগত বন্ধুরাষ্ট্রগুলো বলবে, কার সঙ্গে শান্তি আলোচনা? হামাসের সঙ্গে? হামাস তো কোনো রাজনৈতিক দল নয়। ওটি একটি সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ! আমরা যারা মুক্তবুদ্ধির মানুষ তারা কেউ হামাসকে সমর্থন করতে রাজি হব না। হামাসের সশস্ত্র যুদ্ধ ফিলিস্তিন-ইসরায়েল বিরোধের সমাধান দিতে সক্ষম এ কথা কেউ দাবি করবে না। আমার প্রশ্ন, ১৯৯০ সালে ইসরায়েল-পিএলও (প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন) যখন শান্তি সমঝোতায় পৌঁছাল তখন সারা দুনিয়া স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল। মানুষ ভেবেছিল, যাক এখন থেকে আমাদের আর নারকীয় হত্যাযজ্ঞ দেখতে হবে না। ইসরায়েলি বর্বরতা দেখতে দেখতে বিবেকবান দুনিয়া ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। কিন্তু দুনিয়া তখনো ইসরায়েলি কূটকৌশলের চরম উৎকর্ষ দেখে সারেনি। পিএলওর মতো একটি ধর্মনিরেপেক্ষ আধুনিক রাজনৈতিক শক্তির উত্থান ঠেকানোর সব প্রস্তুতি ইসরায়েল আসলে আগেই নিয়ে রেখেছিল। ইসরায়েলের স্বার্থ হাসিলের জন্য ফিলিস্তিনের মাটিতে ইসরায়েলি অর্থ ও অস্ত্রের সরবরাহ নিয়ে হামাসের জন্ম। হামাস নেতারা ইসরায়েলের টাকা ও পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে আমাদের দেশের মামুনুল হকদের মতো মসজিদে বসে বয়ান দিত। সেই সঙ্গে ইসরায়েলের টাকায় ফিলিস্তিনিদের সমাজসেবা করে সমাজে প্রভাব খাটানোর জন্য শক্তি সঞ্চয় করছিল। ইসরায়েল ও প্যালেস্টাইনের মধ্যে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর হওয়া মাত্র হামাস তার সমাজসেবার খোলস ছেড়ে জোব্বার তলা থেকে হিংস্র থাবা বের করে বলল, আমরা ওসব শান্তিচুক্তির ধার ধারি না। আমরা যুদ্ধ করে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করব। সেই সঙ্গে তারা বেশ কিছু আত্মঘাতী হামলার আয়োজন করে ফেলল যেসব হামলায় প্রায় ৬০ ইসরায়েলি মারা গিয়েছিল। হামাসের সন্ত্রাসী কর্মকান্ড দেখে ইসরায়েল ও ইসরায়েলের একান্ত অনুগত অনুসারী আমেরিকা এবং তাদের ইউরোপীয় মিত্ররা একযোগে হামাসের গায়ে সন্ত্রাসী সংগঠনের সিল মেরে দিল। ইসরায়েল নিজেদের স্বার্থে হামাস নামের ধর্মান্ধ গোষ্ঠী সৃষ্টি করেছে এ তথ্য দুনিয়াজুড়ে বিজ্ঞ সমাজে চাউর হয়ে গিয়েছিল। এ তথ্য চাপা দেওয়ার জন্য ইসরায়েল তার বর্বর খেলার শেষাঙ্ক খুব চমৎকার কৌশলে মঞ্চস্থ করে নিল। ইসরায়েলের হাতে গড়া নেতা হামাসের স্রষ্টা হাজী ইয়াসিন অনেক দিন ধরে ক্যান্সারে ভুগছিল। ক্যান্সারে আক্রান্ত হাজী ইয়াসিনকে ইসরায়েল তাদের খরচে তেলআবিবের একটি হাসপাতালে নিয়মিত চিকিৎসা দিত বলে তথ্য পাওয়া যায়। ইসরায়েল ভালো করেই জানত, ক্যান্সারের রোগী হামাস নেতা হাজী ইয়াসিনের আয়ু তখন বড়জোর কয়েক সপ্তাহ। ইসরায়েল যে হামাসের স্রষ্টা এবং পোষক নয় এ কথা প্রমাণ করার জন্য মৃত্যুপথযাত্রী হাজী ইয়াসিনকে ২০০৪ সালে ইসরায়েল হেলিকপ্টার গানশিপ থেকে গুলি করে মেরে দিয়েছিল। ক্যান্সার রোগী মৃত্যুপথযাত্রী হামাস নেতা হাজী ইয়াসিনকে মর্টারের আঘাতে মেরে ফেলে ইসরায়েল এক ঢিলে দুই পাখি মেরেছিল। হামাসের জিহাদি কর্মী বাহিনীর কাছে হাজী ইয়াসিন ইসরায়েলবিরোধী জিহাদি আন্দোলনের হিরো হয়ে গেল তাতে তারা ফিলিস্তিনিদের মধ্যে আরও বেশি প্রভাব খাটানোর সুযোগ পেল; আরেকদিকে ইসরায়েল যে নিজেদের দুরভিসন্ধি বাস্তবায়নের হাতিয়ার হিসেবে হামাসকে সৃষ্টি করেছে সেই নিন্দার দাগ ইসরায়েলের গা থেকে মুছে দেওয়া গেল। হাজী ইয়াসিনকে হত্যা করে ইসরায়েল প্রমাণ করল ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে তারা শান্তি আলোচনার দরজা বন্ধ করার জন্য হামাস পয়দা করেছে এ কথা সত্য নয়। সত্যি, রাজনীতির মঞ্চে এই এক ভয়ংকর নাটক!

পশ্চিমা দুনিয়া যে ইসরায়েলের মতলবের খবর জানে না এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। তাহলে প্রশ্ন, পশ্চিমা দুনিয়ার মানবতার খোলসে বারবার এত কাদা লেপে দেওয়ার পরও তারা ইসরায়েলকে অন্ধ সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে কেন? এ প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে আমার মনে হয় পশ্চিমা দুনিয়া খ্রিস্টধর্মে বিশ্বাসী। ইহুদিদের ঘৃণা করা খ্রিস্টানদের ধর্মীয় বিশ্বাসের অংশ। খ্রিস্টানরা বিশ্বাস করে ইহুদিরা ঈশ্বরপুত্র যিশুর হত্যাকারী। এ বিশ্বাস থেকে হাজার বছর ধরে ইউরোপের খ্রিস্টানরা ইউরোপের সমাজে ইহুদিদের মানুষের মর্যাদায় গ্রহণ করেনি। সমাজের বাইরে খোঁয়াড়ের মতো ঘেটো বানিয়ে ইহুদিদের সেখানে বাস করতে বাধ্য করেছে। ইউরোপের খ্রিস্টান সমাজের অন্তরে পুঞ্জীভূত ঘৃণা জার্মানির হিটলারের ইহুদি নিধনের মধ্য দিয়ে চূড়ান্তভাবে প্রকাশ পেয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে এবং বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে কয়েক মিলিয়ন ইহুদি ইসরায়েলে আরব বসতিকে জবরদস্তি হটিয়ে দিয়ে বসতি গড়ে তুলেছে। ইউরোপ এবং তাদের সঙ্গী আমেরিকা ভাবছে, ইহুদি আপদগুলোর জন্য আরব দুনিয়ায় একটি স্থায়ী ঠিকানা রয়ে যাক। এতে তাদেরও এক ঢিলে দুই পাখি মারা হবে। ইসরায়েল রাষ্ট্র নির্বিবাদে টিকে থাকলে ইহুদিদের একটি বড় অংশ তাদের আদি বাসভূমি ইউরোপ-আমেরিকায় ফিরে না গিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে রয়ে যাবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের কুকীর্তির ফলে খ্রিস্টান সমাজ ইহুদিদের প্রতি তাদের ঘৃণা প্রকাশ করতে দ্বিধাবোধ করে থাকে। ওরা ভাবে, ইহুদিদের বিরুদ্ধে কিছু বললে দুনিয়ার লোকে ইউরোপ-আমেরিকাকে হিটলারের মতো নাজি বলে গাল দেবে। তার চেয়ে ইহুদিদের অস্তিত্ব বরং ইসরায়েলকে ঘিরে আবর্তিত হতে থাক। এতে ইউরোপ-আমেরিকা নিরাপদ দূরত্বে বসে মানবতার বাণী কপচাতে পারবে। আর একটি কারণ পশ্চিমা দুনিয়া সযতেœ লালন করছে সেটি আরব দুনিয়ার কাছে অস্ত্র বিক্রির মওকা। ইসরায়েলের অস্তিত্ব আরব দুনিয়ার জন্য মূর্তিমান এক বিভীষিকা। আরব দুনিয়ার মধ্যে ইসরায়েল জুজু চিরকাল টিকে থাকলে আরব দেশগুলো যুদ্ধের আশঙ্কায় তটস্থ থাকবে। ইসরায়েলের হাতে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা যতক্ষণ থাকবে ততক্ষণ আরব দুনিয়া ইউরোপ-আমেরিকার কাছ থেকে ক্রমাগত অস্ত্রের চালান কিনতে থাকবে। মধ্যপ্রাচ্যে অস্ত্রের বাজার স্থায়ীভাবে জমজমাট রাখার এর চেয়ে ভালো উপায় আর কী হতে পারে! ইসরায়েলের অস্তিত্বের ভয় দেখিয়ে তেলসমৃদ্ধ আরব দুনিয়ার তেল বেচা টাকা ইউরোপ-আমেরিকা কত সহজেই হাতিয়ে নিয়ে পার পেয়ে গেল। পশ্চিমা দুনিয়ার অস্ত্র বিক্রির হিসাব-নিকাশ কত সঠিক গত পাঁচ দশকে মধ্যপ্রাচ্যে ইউরোপ-আমেরিকার অস্ত্র বিক্রির খতিয়ান দেখলে যে কেউ নিজেই সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারবেন।

                লেখক: কথাসাহিত্যিক।

সর্বশেষ খবর