সোমবার, ১৬ আগস্ট, ২০২১ ০০:০০ টা

প্রিয়াঙ্কা চোপড়া নায়িকা হওয়া ও ভাওয়াল সন্ন্যাসীর মামলা

নঈম নিজাম

প্রিয়াঙ্কা চোপড়া নায়িকা হওয়া ও ভাওয়াল সন্ন্যাসীর মামলা

প্রিয়াঙ্কা চোপড়া অভিনীত একটি ছবি দেখেছিলাম। নাম ফ্যাশন। নায়িকা মফস্বল থেকে মুম্বাই আসেন। তারপর মডেল তারকা বনতে গিয়ে জড়িয়ে যান নানামুখী জটিলতায়। এ ছবির আরেকজন নায়িকা আছেন। সেরা মডেল হওয়ার প্রতিযোগিতায় জড়িয়ে পড়েন তারা। একজন মডেল হিসেবে বিশাল অবস্থান তৈরি করেন। কিন্তু বেশি দিন টিকতে পারেন না। বিনিয়োগকারীদের চোখ পড়ে প্রিয়াঙ্কার দিকে।  ব্যস, দ্বিতীয় নায়িকা শেষ। আরেকজন লাইমলাইটে চলে আসেন। কিন্তু বেশি দিন তারও টিকে থাকা হয় না শহরের আলো-আঁধারির গোলকধাঁধায়। হতাশায় যার যার মতো ড্রাগে আসক্ত হন দুই নায়িকাই। প্রিয়াঙ্কার পাশে মফস্বল থেকে এসে পরিবারের সদস্যরা দাঁড়ান। কিন্তু আরেকজনের পাশে কেউ নেই। জটিল সিনেমা কাহিনি। মুম্বাই শুধু মারদাঙ্গা ছবি বানায় না, জীবনভিত্তিক অনেক ছবিও তৈরি করে। সমাজের আসল চেহারা বের করে আনে। বাংলাদেশের কথা আলাদা। একটা সময় অনেক ভালো ছবি নির্মাণ হতো। ছবির কাহিনি থাকত, প্রাণ থাকত। এখন অনেক কিছু বদলে গেছে। ঢাকায় সেই নির্মাতা, অভিনেতা, অভিনেত্রী কেউই নেই। সবকিছু হারিয়ে যাচ্ছে। আগামী প্রজন্ম হয়তো বিশ্বাস করবে না শাবানা, ববিতা, কবরীর ছবি দেখতে কালোবাজারির কাছ থেকে হলের টিকিট কিনতে হতো। সিনেমা হলগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সংকুচিত হচ্ছে মানুষের বিনোদন। যাত্রা, হাউজি, পুতুলনাচ, সার্কাস বা বিনোদন বন্ধ হলে জঙ্গিবাদের প্রসার ঘটে। সে কথা কেউ মনে রাখি না। মুখে প্রগতিশীলতা থাকলে চলে না। বাস্তবেও তা দেখাতে হয়। উদীয়মান অর্থনীতিতে মানুষকে শ্বাস ফেলার সুযোগ দিতে হবে। না হলে সামাজিক অপরাধ বেড়ে যায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চলে অসুস্থ প্রতিযোগিতা।

জানি আমাদের চলচ্চিত্রকে আগের অবস্থানে ফিরিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু চেষ্টা করলে সমস্যা কী? ঢাকার চেয়েও খারাপ হয়ে গিয়েছিল কলকাতার সিনেমাজগৎ। আমাদের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের তারা টেনে নিয়েছেন। শাকিব, ফেরদৌস, জয়া অনেক ভালো করেছেন কলকাতায়। নতুনভাবে সময়ের সঙ্গে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা থাকতে হয়। কলকাতার চলচ্চিত্র তা-ই করছে। সেদিন ভাওয়াল রাজার ওপর নির্মিত কলকাতার বাংলা ছবি দেখলাম। কী দারুণ ইতিহাসভিত্তিক নির্মাণ। এ ছবিতে জয়া আহসান ভাওয়াল রাজার বোনের চরিত্রে অভিনয় করেছেন। জয়ার আরেকটা ছবি দেখেছিলাম ‘কণ্ঠ’। ফ্লাইটে বসে সেই ছবিটি দেখা। জীবনভিত্তিক দারুণ একটি ছবি।

ভাওয়ালের জমিদাররা ছিলেন তিন ভাই। বড়জন ব্যস্ত বাবার উত্তরাধিকার ও সম্পদ রক্ষা নিয়ে। মেজ রাজকুমারের নাম ছিল রমেন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী। প্রজারা ডাকতেন রাজা মহেন্দ্র চৌধুরী। তিনি ছিলেন আমুদে মানুষ। বলা যায় অন্য ভাইদের চেয়ে আলাদা। দিনভর শিকার আর আনন্দ ফুর্তিতে সময় কাটাতেন। লক্ষেèৗ থেকে বাইজিরা আসত নাচের আসরে। কলকাতা যেতেন ফুর্তি করতে। প্রজারা তাকে পছন্দ করতেন। বলতেন, মেজ কুমারের মনটা উদার। দান করেন দুই হাতে। একদিন মেজ কুমার কঠিন অসুখে পড়লেন। সময় ১৯০৫ সাল। চিকিৎসকরা বললেন সিফিলিস। শুরু হলো চিকিৎসা। পরামর্শ দেওয়া হলো হাওয়া বদলের। দার্জিলিং যান চিকিৎসার জন্য। সঙ্গে ছিলেন রানী। ছিলেন আরও দুজন। একজন রানীর ভাই। আরেকজন ব্যক্তিগত চিকিৎসক। তারা রাজা রমেন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীকে দেখাশোনা করতেন। কিন্তু হঠাৎ করেই রাজার শরীরটা ভেঙে পড়তে শুরু করে। শরীরের চামড়ায় ফোসকা পড়ে। মহেন্দ্র চৌধুরী টের পেলেন চিকিৎসার কোথায় যেন গলদ রয়েছে। চিকিৎসককেও নিজের শঙ্কার কথা বললেন। চিকিৎসক, নায়েব সবাই বললেন সব ঠিক আছে। কিন্তু বাস্তবতা তা ছিল না। হুট করে সবকিছু চলে যায় আয়ত্তের বাইরে। রমেন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী মারা যান। সেদিন আকাশে মেঘ ছিল। তারিখটা ছিল ১৯০৯ সালের ৭ মে। মাত্র ২৫ বছর বয়সে ভাওয়ালের মেজ রাজকুমার চলে গেলেন চিরতরে। এরপর ১০ বছরের ভিতরে মারা যান আরও দুই কুমার। ভাওয়ালের বিশাল সম্পদের দায়িত্ব এসে বর্তায় রানীদের ওপর। কিন্তু অনেক বছর পর ১৯২১ সালে ঢাকায় ঝামেলা তৈরি হয়। ভাওয়াল এস্টেটের প্রজারা দেখলেন এক সন্ন্যাসী সারা অঙ্গে ছাই মেখে বসে আছেন এস্টেটের আওতাধীন ঢাকার একটি বাঁধের বটতলায়। সারা দিন চোখ বন্ধ করে জপমালা জপেন। উৎসাহী মানুষের ভিড় বাড়তে থাকে। প্রবীণরা বলতে শুরু করলেন এই সন্ন্যাসীর সঙ্গে রাজা রমেন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর চেহারার মিল আছে।

ঢাকার গুজবের ডালপালা আরও প্রসারিত হয় জয়দেবপুরে। প্রজারা দলে দলে আসতে থাকেন। নানা জনের নানা মন্তব্য। কিন্তু সন্ন্যাসী কারও সঙ্গে কথা বলেন না। তিনি সারাক্ষণই ধ্যানে। চারদিকের হইচই তাঁর কানে যায় না। টানা চার মাস এভাবে চলতে থাকে। একদিন ভাওয়ালের জমিদারের বোন জ্যোতির্ময়ীর কানে এ খবর যায়। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন সন্ন্যাসীকে দেখতে যাবেন। বোঝার চেষ্টা করবেন প্রজাদের কানাঘুষার ভিত্তি কতটুকু। যেমন ভাবা তেমন কাজ। জ্যোতির্ময়ী ছিলেন মহেন্দ্র চৌধুরীর প্রিয় বোন। ছোটবেলায় ভাইয়ের আদরেই জ্যোতির্ময়ীর বেড়ে ওঠা। ভাই বলতেই আপ্লুত হতেন। লোকজন নিয়ে বটতলায় এলেন জ্যোতির্ময়ী। সন্ন্যাসীকে দেখে বিস্মিত হলেন। তাঁর মন বলছে, এ সন্ন্যাসীই তাঁর ভাই মহেন্দ্র। ছাই মেখে নিজেকে আড়াল করে রেখেছেন। কারও কথায় সায় দিচ্ছেন না। জ্যোতির্ময়ী সন্ন্যাসীকে আমন্ত্রণ জানালেন রাজবাড়িতে। যাওয়ার ব্যবস্থা হলো। সন্ন্যাসী রাজবাড়িতে গেলেন। ভাওয়ালের জমিদারদের জয়দেবপুরের বাড়ি ছাড়াও বুড়িগঙ্গার তীরে আরেকটি বাড়ি ছিল। ছাইমাখা সন্ন্যাসী রাজবাড়ি যাওয়ার পর জ্যোতির্ময়ী বিভিন্ন ঘর ঘুরিয়ে দেখান। স্মৃতিশক্তি ফিরিয়ে আনাই ছিল তাঁর লক্ষ্য। চেনা চোখে সন্ন্যাসীও তাকাচ্ছেন চারদিকে। শুধু ঘর দেখানো নয়, পুরাতন দিনের কিছু প্রশ্নও করেন জ্যোতির্ময়ী। বলতে থাকেন দুই ভাইবোনের অনেক কথা। হঠাৎ দুধমায়ের নাম মনে পড়ল সন্ন্যাসীর। জ্যোতির্ময়ীর সংশয় কেটে গেল। কান্নায় ভেঙে পড়লেন। বললেন, দাদা তুমি সবকিছু কী করে ভুলে গেলে? মনে কর অতীতকে। দোহাই লাগে। সব ভাইকে হারিয়েছি। ভাগ্যগুণে তোমাকে ফিরে পেয়েছি। নিজেকে আগের মতো ফিরিয়ে আনো। সন্ন্যাসীকে গোসল করানো হলো।

গোসলের পর দেখা গেল মহেন্দ্র চৌধুরীর মতোই তার চেহারার আদল। শরীরের সব চিহ্নও একই। প্রজারা হইচই জুড়ে দিল। তাদের এক কথা- তিনিই মেজ রাজকুমার। কিন্তু সন্ন্যাসী বাংলায় কথা বলতে পারেন না। তিনি কথা বলেন উর্দুতে। রানী বিভাবতী দেবী দেখতে এলেন। তাঁর ডাকনাম ছিল চন্দ্রা। তিনি বললেন, এ লোক তাঁর স্বামী নন। কিন্তু প্রজারা মানবেন কেন? তারা দলে দলে ভিড় জমাতে থাকেন রাজবাড়িতে। বলতে থাকেন, এ-ই আমাদের মেজ রাজকুমার। মেজ রাজকুমারকে চাই ভাওয়াল এস্টেটের দায়িত্বে। জ্যোতির্ময়ী শক্ত অবস্থান নেন ভাইয়ের পক্ষে। বিভাবতীর পক্ষে যোগ দেন অন্য দুই রানীও। মামলা উঠল আদালতে। ভাইকে নিয়ে আদালতে গেলেন জ্যোতির্ময়ী। রানীর ভাই সত্যেন কঠিনভাবে সবকিছু আইনি মোকাবিলার সিদ্ধান্ত নেন। আদালতে জমল ভাওয়াল সন্ন্যাসীর মামলা। সন্ন্যাসীর টাকা নেই। কিন্তু টাকা কোনো ব্যাপারই না। মামলার খরচ জোগাতে শুরু করেন প্রজারা। তারা প্রতিদিন আদালতে উপস্থিত থাকেন। দল বেঁধে মেজ রাজকুমারের পক্ষে সেøাগান দেন। ঢাকা জেলা জজ আদালতে তিল ধারণের ঠাঁই থাকত না। জেলা দায়রা জজ অ্যালান হেন্ডারসন মামলার বিচারের দায়িত্ব দেন বিচারক পান্না লাল বসুকে। মামলা চলতে থাকে। বিভাবতী দেবী ও অন্য দুই কুমারের স্ত্রীদের বিবাদী করা হয়। বিবাদীদের আইনজীবীরা আদালতকে বলেন, সন্ন্যাসী বাংলা বলতে পারেন না। তিনি কোনোভাবে কুমার নন। তারা আদালতে হাজির করেন সন্ন্যাসীর নাগা গুরু ধর্মদাসকে। গুরু বলেন, এ সন্ন্যাসী তার পুরনো শিষ্য সুন্দরদাস। তার আরেক নাম মাল সিং। পাঞ্জাবে তার বাড়ি। জয়দেবপুর নয়।

এ বক্তব্যের বিরুদ্ধে আদালতে শুনানি চলতে থাকে। প্রজারা লাঞ্ছিত করে বসলেন নাগা গুরু ধর্মদাসকে। পরিস্থিতি জটিল রূপ নিতে থাকে। আদালতে সন্ন্যাসীর আইনজীবী বললেন, এই ধর্মগুরুকে রানী বিভাবতীর ভাই সত্যেন অর্থ দিয়ে ভাড়া করেছেন। তিনি ভুল তথ্য দিচ্ছেন। তিনি মেজ রাজকুমারকে পেয়েছেন শ্মশানে। স্লো পয়জনের মাধ্যমে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল। পুরো ষড়যন্ত্রে জড়িত খোদ রানী নিজে। সঙ্গে ছিলেন রানীর ভাই নায়েব সত্যেন ও চিকিৎসক ডা. অশি^নী দাশগুপ্ত। তারা আর্সেনিক পয়জনের মাধ্যমে মহেন্দ্র চৌধুরীকে মৃত্যুর দিকে নিয়ে যান। বৃষ্টির কারণে ভাগ্যগুণে তিনি বেঁচে যান। আইনজীবী এ ব্যাপারে আদালতে পর্যাপ্ত কাগজপত্র উপস্থাপন করেন। সাক্ষীরাও আসতে থাকেন। চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্রে আর্সেনিক পয়জনের ইনজেকশন লেখা ছিল। আইনজীবী বলেন, সিফিলিসের চিকিৎসায় এ ধরনের ইনজেকশন দেওয়ার সুযোগ নেই। শুধু ধীরে ধীরে হত্যার জন্য এ ইনজেকশন দেওয়া হয়েছে। আইনজীবী আরও বলেন, চিকিৎসা চলাকালে নিয়ে যাওয়া হয় দার্জিলিং। এখানেও উদ্দেশ্য সৎ ছিল না। আর্সেনিকযুক্ত ইনজেকশনের প্রভাবে রাজা বেহুঁশ হয়ে পড়েন। তিনি মারা যাননি। অচেতন অবস্থায় তাকে দাহ করার চেষ্টা হয়।

আইনজীবীর যুক্তিতে বলা হয়, নিকটজনদের খবর না দিয়ে দ্রুত লাশ দাহ করতে নিয়ে যাওয়া হয় স্থানীয় শ্মশানে। চিতায় লাশ ওঠানো হয়। কিন্তু হঠাৎ শুরু হয় ঝড়বৃষ্টি। দাহ কাজে অংশগ্রহণকারীরা দৌড়ে আশ্রয় নেন পাশের পরিত্যক্ত বাড়িতে। একদল নাগা সন্ন্যাসী সে পথ ধরে যাচ্ছিলেন। তারা দেখলেন চিতার কাঠের ওপর পড়ে থাকা দেহ নড়াচড়া করছে। তারা মানুষটিকে সঙ্গে নিয়ে নেন। তারপর শুরু করেন চিকিৎসা। ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠেন শ্মশানের মানুষটি। কিন্তু তাঁর স্মৃতিশক্তি লোপ পায়। কোনো কিছু মনে করতে পারেন না। তাই সন্ন্যাসজীবনই বেছে নেন। ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে টানা ১০ বছর সন্ন্যাসবেশে কাটিয়ে দেন উদ্ধারকারী দলের সঙ্গে। জীবন এক বহতা নদী। পথ চলতে চলতে একদিন কিছুটা স্মৃতিশক্তি ফিরে পান কুমার। দলের সদস্যদের কাছে নিজের পরিচয় প্রকাশ করেন। সবাই তাঁকে আবার জয়দেবপুর ফিরে আসতে বলেন। গুরু ধর্মদাসও সায় দেন। ১৯২১ সালের দিকে তিনি ফিরে আসেন। সর্বাঙ্গে ছাইমাখা সন্ন্যাসীকে দেখতে পান ঢাকাবাসী। টানা চার মাস তিনি বসে থাকেন একই স্থানে। জ্যোতির্ময়ী সন্ন্যাসীকে বাড়িতে নিয়ে গেলেই বেরিয়ে আসে সব রহস্য। গুরু ধর্মদাস কেন বিপরীত সাক্ষ্য দিলেন তা নিয়ে বিস্মিত ভাওয়াল রাজকুমার। মামলা চলতে থাকে।

বছরের পর বছর কেটে যায় মামলার শুনানিতে। সাক্ষীর অভাব নেই। আদালতের বাইরে ভিড়ও কমে না। জ্যোতির্ময়ী সন্ন্যাসী ভাইকে নিয়ে আদালতে আসতেন। আদালতে ধর্মদাসের তথ্য মিথ্যা প্রমাণ করতে পাঞ্জাবও যায় বিশেষ টিম। পাঞ্জাবে এ সন্ন্যাসীর পূর্ব কোনো ইতিহাস পাওয়া যায় না। আদালতে প্রজাদের হাতে হেনস্তা হয়ে গুরু ধর্মদাস পালিয়ে ঢাকা ছাড়েন। পরিস্থিতি জটিল রূপ নিতে থাকে। এ মামলার রায় নিয়ে সবাই অপেক্ষায় থাকেন। ১৯৩৩-৩৪ সালের দিকে মামলার কার্যক্রম গুটিয়ে আসতে থাকে। মাননীয় আদালত ৪০০ সাক্ষীর বয়ান নেন। সবার বক্তব্য গভীর পর্যবেক্ষণ করেন। ১৯০৫ সালে ইংল্যান্ডের ডা. ক্যারি চিকিৎসা করেন মেজ রাজকুমার মহেন্দ্র চৌধুরীর। সে সময় শরীরের বিবরণ তুলে ধরেন তিনি বিভিন্ন রিপোর্টে। সে রিপোর্ট আনিয়ে মিলিয়ে দেখা হয় সন্ন্যাসীর সঙ্গে। মেজ রাজকুমারের সঙ্গে সন্ন্যাসীর শরীরের বিভিন্ন দিক পুরো মিলে যায়। আদালত ড. ক্যারির ফরেনসিক রিপোর্ট গুরুত্বের সঙ্গে নেন। এতে শারীরিক দিকগুলোর সাদৃশ্য দেখা যায়; যা হুবহু। আদালতে ডাকা হলো ডা. অশি^নীকে। বিষপ্রয়োগ নিয়ে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এ জেরায়ও বেরিয়ে আসে অনেক তথ্য। ধৈর্য নিয়ে দীর্ঘ সময় চলা মামলার রায় প্রস্তুত করেন বিচারক।  শ্বাসরুদ্ধকর একটি মামলার রায় শোনার আগ্রহে ১৯৩৬ সালের ২৪ আগস্ট ঢাকার আদালতে জনতার ঢল নামে।

রায় প্রদান করেন বিচারপতি পান্না লাল বসু। মামলায় রায় সন্ন্যাসীর পক্ষে যায়। বিচারপতি পান্না লাল দীর্ঘ সময় ধরে রায় পড়ে শোনান। এ রায়ের মধ্য দিয়ে তিনি নিজের বিচারক জীবনের অবসান ঘটান। রায়ে হেরে হাল ছাড়েননি মহেন্দ্র চৌধুরীর স্ত্রী বিভাবতী দেবী। তিনি কলকাতার হাই কোর্টে আপিল করেন। আপিলের রায়ও যায় সন্ন্যাসীর পক্ষে। তার পরও লড়াই থামেনি। রানী ঘোষণা দেন লন্ডন যাবেন। এর মধ্যে শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। যুদ্ধের শেষে লন্ডনের প্রিভি কাউন্সিলে আপিল করেন বিভাবতী দেবী। দীর্ঘ ২৮ দিন হাউস অব লর্ডসে শুনানি চলে। সে রায়ও সন্ন্যাসীর পক্ষে যায়। সব আদালতই গুরুত্বের সঙ্গে দেখে ফরেনসিক রিপোর্ট। এ রিপোর্টে উভয় ব্যক্তির শরীরের গড়ন, আঁচিল, পায়ের ক্ষত, মাথা ও পিঠে ফোঁড়ার দাগ, ডান বাহুতে বাঘের থাবার দাগ অনেক কিছুতে হুবহু মিল পায়। রানী হারলেন। বললেন, বিচার করবেন ঈশ্বর।  রায়ের কিছুদিন পরই মারা যান ভাওয়ালের আলোচিত মেজ রাজকুমার সেই সন্ন্যাসী। মিথ আছে পূজা দিতে গিয়েই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। সম্পদ রাজা-রানী কারোরই ভোগ করা হলো না।

                লেখক : সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।

সর্বশেষ খবর