শুক্রবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

বর্জ্য ব্যবস্থাপনার চ্যালেঞ্জ

হাবিবা আক্তার হ্যাপি

বর্তমান পৃথিবীতে প্রায় ৮ বিলিয়ন মানুষ বসবাস করছে এবং বর্জ্যরে পরিমাণ হিসাব করলে দেখা যায় জনপ্রতি দিনে প্রায় ১.২ কেজি বর্জ্য উৎপাদন করছে। বছর শেষে এর পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ১.৫ বিলিয়ন টন। ধারণা করা হচ্ছে, ২০২৫ সালের মধ্যে বর্জ্যরে পরিমাণ বেড়ে ২.২ বিলিয়ন টন হবে। দ্রুত নগরায়ণ ও শিল্পায়নের কারণে দিন দিন বেড়েই চলেছে কঠিন বর্জ্যরে পরিমাণ, আর তাই সঠিকভাবে কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়িয়েছে উন্নয়নশীল দেশগুলোয়। উচ্চ ও নিম্ন আয়ের দেশগুলোয এ বর্জ্যরে এক বিরাট অংশের (প্রায় ৫৯%) জায়গা হচ্ছে ল্যান্ডফিলে। বিশ্বজুড়ে ল্যান্ডফিলিং পদ্ধতি বর্জ্য নিষ্পত্তিতে ব্যবহৃত হচ্ছে। ল্যান্ডফিলিং হলো বর্জ্য অপসারণের এক ধরনের মাধ্যম যেখানে বর্জ্য অন্তর্নিহিত সেকশনগুলোয় জমা হয় এবং পচে গিয়ে সেখান থেকে নির্গত হয় কার্বন-ডাইঅক্সাইড ও মিথেন। মিথেন হলো শক্তিশালী গ্রিনহাউস গ্যাস। এ মিথেন উৎপন্ন হচ্ছে ল্যান্ডফিলগুলোর বর্জ্য থেকে এবং আমরা সবাই জানি মিথেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে গ্লোবাল গ্রিনহাউস গ্যাস উৎপাদনে। বিশ্বব্যাপী বছরে ১.৩ বিলিয়ন টন কঠিন বর্জ্যরে মাত্র ১৩.৫% পুনর্ব্যবহারযোগ্য এবং ৫.৫% কম্পোজ করা হচ্ছে, যখন প্রায় ৫৯% বর্জ্যরে জায়গা ল্যান্ডফিলে। আমরা আমাদের জীবনযাপনের জন্য যে পরিবেশ থেকে এত কিছু নিই, বিনিময়ে পরিবেশের জন্য কী করছি? দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে এবং জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্য আমরা নিত্যব্যবহার্য জিনিসপত্রের পরিমাণ বাড়িয়ে দিচ্ছি। ফলস্বরূপ আমাদের বাস্তুসংস্থান আস্তে আস্তে অস্থিতিশীল হয়ে পড়ছে। ল্যান্ডফিলিংয়ের বর্জ্যসমূহ আমাদের ম্যারিন সিস্টেমকে প্রভাবিত করছে, বায়ুদূষণ করছে এমনকি ভূগর্ভস্থ পানির ওপর প্রভাব ফেলছে। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের অন্যতম কারণ গ্রিনহাউস গ্যাস যা ল্যান্ডফিলের বর্জ্য থেকে নিঃসরণ হচ্ছে। বর্জ্য থেকে বিষাক্ত পদার্থগুলো আমাদের খাদ্য চেনে প্রবেশ করছে। গুরুতর এ বিষয়টি আমাদের সবার বিবেচনায় আনা উচিত। ল্যান্ডফিলগুলো বর্জ্য গ্রহণ করছে কোনোরকম পৃথক্করণ ছাড়াই। শিল্পকারখানা, হাসপাতাল ও অন্যান্য উৎস থেকে উৎপন্নকারী বর্জ্যগুলোকে পৃথক না করে ল্যান্ডফিলে একসঙ্গে ডাম্পিং করায় সঠিকভাবে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা হচ্ছে না। ফলে পরিবেশের বাস্তুসংস্থান ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছে। যথাযথভাবে বর্জ্য পৃথক্করণ না করায় সব ধরনের বর্জ্য একত্রে মিশে বিষাক্ত অবস্থায় পরিণত হচ্ছে। ফলে পরিবেশ ও মানবস্বাস্থ্য দিন দিন ঝুঁকির সম্মুখীন হচ্ছে। এতে ল্যান্ডফিলগুলোর শক্তি উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে ও বর্জ্য প্রসেসিংয়ে বাড়ছে অর্থব্যয়। যদি বর্জ্যগুলো পৃথক করে ল্যান্ডফিলে হস্তান্তর করা হয় তাহলে সঠিকভাবে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করা যাবে। ল্যান্ডফিলগুলো মুখ্য ভূমিকা রাখে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনে। বর্জ্যগুলো রোদের তাপে শুষ্ক হয়, গ্রিনহাউস গ্যাসগুলো বায়ুমন্ডলে কার্বন ডাইঅক্সাইড ও মিথেন আকারে নির্গত হয়। বৈশ্বিক উষ্ণতায় মিথেন গ্যাস কার্যকর ভূমিকা রাখে। দেখা যায় ২০ বছর সময়ের মধ্যে বৈশ্বিক উষ্ণতায় মিথেন গ্যাসের সম্ভাব্যতা কার্বন ডাইঅক্সাইডের চেয়ে ৮৬ গুণ বেশি। অর্থাৎ কার্বন ডাইঅক্সাইডের তুলনায় মিথেন ৮৬ গুণ বেশি কার্যকরভাবে বায়ুমন্ডলে তাপ ধরে রাখতে পারে। সুতরাং আমাদের কাছে পরিষ্কার, মিথেন গ্যাস সবচেয়ে শক্তিশালী গ্রিনহাউস গ্যাস। মানুষের কর্মকান্ডে উৎপাদিত মিথেনের বৃহত্তম উৎস হলো ল্যান্ডফিলে নিষ্পন্ন বর্জ্য। সাম্প্রতিক বৈশ্বিক উষ্ণতা বিশ্বজুড়ে চ্যালেঞ্জিং সমস্যা সৃষ্টি করছে। যেমন অতিরিক্ত হিটওয়েভস, আকস্মিক বন্যা, হারিকেন, হিমবাহ গলে যাচ্ছে (মেন্টিং গ্লেসিয়ারস), সমুদ্রের স্তর স্ফিত করছে (সি লেভেল রাইজিং), বন্যজীবের আবাস সংকুচিত হচ্ছে। বিশ্ব উষ্ণায়নের ব্যাপারে মানুষের সচেতনতা বাড়াতে হবে এবং আমাদের জানতে হবে সঠিকভাবে বর্জ্য নিষ্পত্তি না হলে জলবায়ুতে উৎপাদিত বর্জ্যরে ফলে। আমাদের ল্যান্ডফিলগুলো সঠিকভাবে নির্মিত এবং রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় না ফলে ল্যান্ডফিলের বর্জ্য থেকে বিষাক্ত ক্ষতিকর পদার্থ (লেড, মার্কারি) লিচেটের মাধ্যমে স্থানীয় স্ট্রিমস, মাটি, ভূগর্ভস্থ পানিতে প্রবেশ করে। সুতরাং ল্যান্ডফিল সাইটগুলো মাটি ও ভূগর্ভস্থ পানি দূষণের জন্য দায়ী। ল্যান্ডফিল সাইটগুলো পাখির স্থানান্তরের ওপর আংশিক নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। দেখা যায় কিছু পাখি ল্যান্ডফিল সাইটগুলো থেকে খাবার আহরণ করে, অনিবার্যভাবে প্লাস্টিক, অ্যালুমিনিয়াম, জিপসাম ও নানা রকম বিষাক্ত পদার্থ বিদ্যমান থাকায় মারাত্মক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয় পাখিসহ প্রাণিকুল।

বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোয় অনেকেই মনে করেন ল্যান্ডফিল বলতে সাধারণত খোলা জায়গায় বর্জ্য নিষ্পত্তি করা। আর এ ভাবনা হওয়া স্বাভাবিক কেননা আমাদের চলাফেরার পথে আমরা দেখতে পারি, রাস্তার একপাশে খোলা স্থানে বর্জ্য বহনকারী গাড়িগুলো এসে বর্জ্য জমা করছে। ন্যূনতম অবকাঠামো থাকে না বেশির ভাগ ল্যান্ডফিলে। উন্নয়নশীল দেশগুলোয যেখানে পরিবেশ সুরক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে সঠিক জ্ঞানের পর্যাপ্ত অভাব, আইন প্রণয়নের অভাব, দক্ষ কারিগরের অভাব, অপর্যাপ্ত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা অবকাঠামো, আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় আর্থিক সীমাবদ্ধতা, ল্যান্ডফিল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে সচেতনতার অভাব, ল্যান্ডফিল উন্নয়নের জন্য উপযুক্ত স্থান নির্বাচনের সমস্যা রয়েছে। আমরা আমাদের সুরক্ষিত জায়গাকে দিনে দিনে বসবাসের অনুপোযোগী করে তুলছি। আমাদের উচিত অন্যের ওপর দোষ দেওয়া বন্ধ করা এবং নিজেদের মধ্যে দায়িত্ববোধ নিয়ে আসা। আমরা আমাদের দ্বারা উৎপাদিত বর্জ্যগুলোকে সঠিকভাবে কম্পোস্টিং, পুনর্ব্যবহারযোগ্য এবং পুনরায় ব্যবহার করা যায় যেন সেই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারি। আমাদের সচেতনতাই পারে আমাদের পৃথিবীকে সুন্দরভাবে সাজাতে।

লেখক : শিক্ষার্থী এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়।

ইমেইল : [email protected]

সর্বশেষ খবর