বৃহস্পতিবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

দিলীপ কুমারকে ‘ভারতরত্ন’ পুরস্কার না দেওয়া মস্ত বড় ভুল

তসলিমা নাসরিন

দিলীপ কুমারকে ‘ভারতরত্ন’ পুরস্কার না দেওয়া মস্ত বড় ভুল

দিলীপ কুমার ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের সিনেমা জগতে প্রথম ‘মেথড অ্যাকটর’। কেউ কেউ অবশ্য বলেন, বিশ্বের প্রথম মেথড অ্যাকটর তিনি। পঞ্চাশ দশকের শুরুতে হলিউড পেয়েছে প্রথম মেথড অ্যাকটর মারলোন ব্রান্ডোকে। হলিউড তখন জানতোই না ভারতে মেথড অ্যাকটর যে চল্লিশ দশকের মাঝামাঝিতেই এসে গেছেন, নাম তাঁর দিলীপ কুমার।

মেথড অ্যাকটিংটা কী জিনিস? নাটকে-সিনেমায় দুঃখ বা আনন্দের দৃশ্যে অভিনয় করার সময় নিজের জীবনের দুঃখ বা আনন্দের ঘটনা স্মরণ করতে হবে, তাহলে দৃশ্য হয়ে উঠবে বাস্তব। অথবা যে চরিত্রে অভিনয় করতে হবে, নিজের অস্তিত্ব সম্পূর্ণ ভুলে গিয়ে সেই চরিত্রের ভেতরে প্রবেশ করতে হবে, শরীরে এবং মনে সেই চরিত্রটি হয়ে উঠতে হবে। এ জন্য অবশ্য দীর্ঘদিনের প্রশিক্ষণ দরকার হয়। ড্যানিয়েল ডে লুইস, ক্রিশ্চান বেইল-এঁরা আজকের যুগের সিরিয়াস মেথড অ্যাকটর। এঁরা চরিত্রের ওজন পঞ্চাশ কিলো কমাতে হলে পঞ্চাশ কিলোই কমাবেন। অথবা পঞ্চাশ কিলো বাড়াতে হলে যে করেই হোক বাড়াবেন। চরিত্রের এত গভীরে প্রবেশ করেন যে মাঝে মাঝে এঁরা ভুলেই যান যে অভিনয় করছেন। স্যুটিংয়ের পরও ওই চরিত্রের মতো আচার আচরণ করেন, ঘোরের মধ্যেই ঘোরাফেরা করেন। লিঙ্কন ছবিতে অভিনয়ের সময় ড্যানিয়েল ডে লুইসকে এক সহ-অভিনেতা অবচেতনে সত্যিকার আব্রাহাম লিঙ্কনই ভাবতেন।

দিলীপ কুমারকে আমি বিশ্বের প্রথম না হলেও ভারতীয় সিনেমা জগতের প্রথম মেথড অ্যাকটর বলে মনে করি। দিলীপ কুমারের আগে অভিনেতা-অভিনেত্রীরা চোখ কুঁচকে সন্দেহ প্রকাশ করতেন, দাঁতে দাঁত চেপে রাগ প্রকাশ করতেন, চোয়াল শক্ত করে ক্রোধ প্রকাশ করতেন, চেঁচিয়ে সংলাপ বলতেন। গভীর ব্যক্তিগত আবেগও প্রকাশ করা হতো বড় সশব্দে। দিলীপ কুমার নিয়ে এলেন ন্যাচারাল অভিনয়, নিয়ে এলেন মেথড অ্যাকটিং। আমি অবাক হই যাঁর অভিজ্ঞতা বলতে ফল ব্যবসায়ী বাবার হিসেব নিকেশে সাহায্য করা আর দোকানে স্যান্ডুইচ বিক্রি করা ছাড়া তেমন কিছু নেই, তিনি কিনা অভিনয়কে শিল্পে উত্তীর্ণ করলেন এবং এক তুড়িতে শিল্পের শিখরে উঠে গেলেন। যখন বোম্বে টকিজ স্টুডিওতে ঢুকে চাকরি চাইছিলেন, তিনি স্বপ্নেও ভাবেননি তাঁকে অভিনয় করার চাকরি দেওয়া হবে। ঘাবড়ে গিয়েছিলেন কারণ অভিনয়ের অ-ও তিনি জানতেন না। পড়ালেখা আর ব্যবসাপাতির বাইরে ছিল শুধু ফুটবল আর ক্রিকেট খেলার শখ। বোম্বে টকিজ যখন তাঁর মাসিক বেতন ধার্য করলো ১২০০ টাকা, দিলীপ কুমার ভেবেছিলেন বছরে তাঁকে ১২০০ টাকা দেওয়া হবে। কিন্তু পরে যখন জানলেন বছরে নয়, তাঁকে ১২০০ টাকা দেওয়া হবে প্রতি মাসে, তিনি বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না এ তাঁর জীবনে ঘটছে। বোম্বে টকিজের মালিক দেবিকা রানীই মোহাম্মদ ইউসুফ খানের নাম দিলীপ কুমার রেখেছিলেন। দিলীপ কুমার অভিনয় জীবনের শুরু থেকেই শুধু অ্যাকটিং নয়, শুরু করলেন মেথড অ্যাকটিং। আমি আজও অবাক হই, অভিনয়ে অনভিজ্ঞ একজন মানুষের পক্ষে এ কী করে সম্ভব ছিল! তাঁর প্রথম ছবি জোয়ার ভাটার স্যুটিংয়ে তাঁকে বলা হয়েছিল, ‘তোমার প্রেমিকা চলে গেছে আত্মহত্যা করতে, তাঁকে দৌড়ে ধরতে হবে তোমাকে।’ যতবারই অ্যাকশন বলা হয়, দিলীপ কুমার খুব জোরে দৌড়োন মেয়েটিকে ধরতে। এদিকে বারবারই কাট বলে তাঁকে থামানো হয়, আর বলা হয়, এত জোরে দৌড়োচ্ছ যে ক্যামেরা তোমাকে ধরতে পারছে না। দিলীপ কুমার বললেন, ‘প্রেমিকা আত্মহত্যা করতে যাচ্ছে, আমাকে তো খুব জোরে দৌড়োতেই হবে তাকে থামানোর জন্য।’ মেয়েটাকে ধরেও ছিলেন তিনি খুব জোরে, কারণ সে যেন আত্মহত্যা করার জন্য ছুটে যেতে না পারে। পরে মেয়েটি অভিযোগ করেছিল তাকে নাকি এত জোরে ধরেছিলেন দিলীপ কুমার যে বাহুতে ব্যথা হচ্ছিল। প্রথম স্যুটিংয়েই তো নিশ্চয় বোঝা গিয়েছিল তিনি জাতশিল্পী, তিনি মেথড অ্যাকটিং করতে এসেছেন ভারতীয় সিনেমায়। তিনি যাত্রাপালার যান্ত্রিক চিৎকারকে ছুট্টি দিয়ে মানুষের জীবন তুলে আনতে এসেছেন রুপোলি পর্দায়। আত্মহত্যা করতে চাওয়া মেয়েটির প্রেমিককে তিনি তাঁর ভেতরে অনুভব করেছিলেন। দিলীপ কুমার এত ডুবে যেতেন কাহিনীর চরিত্রে, যে, নিজের ইউসুফ খানের, নিজের দিলীপ কুমারের আবরণ ছুড়ে ফেলে দিয়ে তিনি জোয়ার ভাটার জগদীশ, মিলনের রমেশ, শহিদের রাম, মেলার মোহন, আন্দাজের দিলীপ, জোগানের বিজয়, দেবদাসের দেবদাস হয়ে উঠতেন। অবিশ্বাস্য সব অভিনয়, যে অভিনয়কে সামান্যও অভিনয় বলে মনে হয় না। তারানা ছবিতে মধুবালার সঙ্গে প্রেমের দৃশ্য দেখে ঘুণাক্ষরেও কারও মনে হবে না তাঁরা সত্যিকার প্রেম করছেন না। দিলীপ কুমারের অভিনয় তাঁর সমসাময়িক অভিনেতা-অভিনেত্রীদের, এমনকী তার পরের প্রজন্ম, তারও পরের প্রজন্মের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের প্রচ- প্রভাবিত করেছে। অভিনয় জগতের মানুষ আরও বহু যুগ ধরে নিজেদের অজান্তেই এভাবে প্রভাবিত হতে থাকবে। দিলীপ কুমার যেসব ছবিতে অভিনয় করেছেন, সেসব ছবি এক একটা মাস্টারপিস নয়। চল্লিশ-পঞ্চাশ দশকের ছবিগুলো সাধারণত সাদামাটা মেলোড্রামা ধরনের ছিল, অবাস্তবতায় ভরপুর। কিন্তু ছবিগুলোর সম্পদ দিলীপ কুমারের অভিনয়। তিনি ছবির চরিত্র হয়ে উঠতেন বলে অন্য অভিনেতাদের মতো একসঙ্গে অনেকগুলো ছবি হাতে নিতেন না, একটি ছবির স্যুটিং সম্পূর্ণ শেষ হলে তবেই আরেকটি ছবির স্যুটিং শুরু করতেন। অন্য হিরোরা কিন্তু সকাল, দুপুর, বিকেল ভিন্ন ভিন্ন ছবির স্যুটিং দিব্যি করে ফেলতে পারতেন। মেথড অ্যাকটিং যাঁরা করেন, তাঁরা পারেন না।

অনেকে তাঁকে ট্র্যাজিডি কিং বলে। কিন্তু তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন তিনি ট্র্যাজিডির অভিনয় যেমন, কমেডির অভিনয়ও তেমন চমৎকার করতে পারেন। অভিনয়ের জগতে তিনি বাদশাহ ছিলেন। বাস্তব জীবনে তিনি ছিলেন একা। প্রেমিকের চরিত্রে অভিনয়ে তাঁর ধারে কাছে কেউ ছিল না, অথচ বাস্তবে তাঁর জীবন প্রেমহীন ছিল দীর্ঘ বছর। প্রথম যৌবনে কামিনী কৌশলের প্রেমে পড়লেন, কিন্তু হিন্দু মুসলমানের বিয়ে হতে দেবে না বলে বাধা দিল কামিনীর ভাই। পিস্তল নিয়ে এসে শাসিয়ে গেল দিলীপ কুমারকে। সম্পর্ক ভেঙে গেল। এর কয়েক বছর পর অনিন্দ্যসুন্দরী মধুবালার সঙ্গে দীর্ঘদিনের প্রেম এবং শেষে বিয়ের কথাবার্তা পাকা হওয়ার পরও সম্পর্কটি নানা কারণে ভেঙে গিয়েছিল। আজীবন চিরকুমার থাকবেন বলেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। থাকছিলেনও। কিন্তু অভিনেত্রী নাসিম বানুর অনুরোধে বিয়ে করেছিলেন তাঁর কন্যা সায়রা বানুকে। বিয়ের কয়েক বছরের মধ্যেই ডাক্তার বলে দেন সায়রার পক্ষে গর্ভবতী হওয়া সম্ভব নয়।

ভালো যে একটি আত্মজীবনী লিখে গিয়েছিলেন। দ্য সাবস্ট্যান্স অ্যান্ড দ্য শ্যাডো। এই জীবনী থেকেই জানতে পারি পেশোয়ারে জন্মেছিলেন ১৯২২ সালে। পেশোয়ার থেকে তিরিশের দশকে পুরো পরিবার চলে এলেন মহারাষ্ট্রে। বাবা মা অল্প বয়সে গত হওয়ার পর দিলীপ কুমার তাঁর এগারো ভাই বোনকে লালন পালন করেছেন। তাঁদের ইস্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছেন। সবাইকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। বাবা মা’র ভূমিকা তিনি একা নিয়েছিলেন। প্রথম কয়েকটি ছবি জনপ্রিয় হওয়ার পর পঞ্চাশ দশকে তিনি প্রতি ছবিতে এক লাখ টাকা পারিশ্রমিক নেওয়া শুরু করেছিলেন। টাকার তো তাঁর দরকার ছিলই। এতগুলো ভাই বোনকে নিয়ে থাকবেন বলেই তিনি বোম্বের পালি হিলে অমন বড় বাংলো কিনেছিলেন। বাংলো বড় ছিল, কিন্তু জীবনযাপন করতেন অতি সাধারণ।

দিলীপ কুমার খুব বেশি ছবিতে অভিনয় করেননি। তাঁর সমসাময়িক অভিনেতারা তাঁর চেয়ে দ্বিগুণ ত্রিগুণ ছবিতে অভিনয় করেছেন। মাদার ইন্ডিয়া, বৈজু বাওড়া, পিয়াসার মতো ছবির প্রস্তাবকে তিনি নাকচ করে দিয়েছেন। প্রতিটি ছবিই তুমুল জনপ্রিয় হয়েছিল, মাদার ইন্ডিয়া অস্কারের জন্যও মনোনীত হয়েছিল। মাদার ইন্ডিয়াতে দিলীপ কুমারের অভিনয় না করার কারণটিও আমার মনে হয় মেথড অ্যাকটিংয়ের অংশ। দিলীপ কুমারকে নার্গিসের ছেলের চরিত্রে অভিনয় করতে বলা হয়েছিল, কিন্তু তিনি রাজি হননি। তাঁর যুক্তি ছিল, ‘আন্দাজ, বাবুল, মেলা, আনোখা পেয়ার, দিদার ছবিতে নার্গিস আমার প্রেমিকা ছিল, আমরা প্রেম করেছি, দর্শক আমাদের প্রেমিক প্রেমিকা হিসেবে দেখেছে, এখন সে আমার মা হবে, এ কী করে সম্ভব!’ এ যে কেবল অভিনয়, তা যেন দিলীপ কুমার বুঝতে চাইতেন না। মাদার ইন্ডিয়াতে নার্গিসের প্রেমিক সুনীল দত্তই তো অভিনয় করেছিলেন নার্গিসের পুত্রের চরিত্রে। অমিতাভের সঙ্গে যে তিনি শক্তি ছবিটি করেছিলেন, সেখানে রাখি ছিল অমিতাভের মা, অথচ কত ছবিতেই তো রাখি ছিল অমিতাভ বচ্চনের স্ত্রী বা প্রেমিকা! অন্য অভিনেতারা পারেন, দিলীপ কুমার পারেন না কেন! চরিত্রের গভীরে ঢুকে গেলে চরিত্রটি হয়তো রক্ত মাংসে আর মস্তিষ্কের কোষে কোষে কোথাও রয়ে যায়।

দিলীপ কুমার প্রতিবন্ধী, বোবা বধির শিশুদের সংগঠনকে বড় অংকের টাকা দান করেন প্রতিবছর। এই শিশুরা যে কোনও ধর্মের, যে কোনও জাতের। দিলীপ কুমার ছিলেন মনেপ্রাণে ধর্মনিরপেক্ষ। নিজের লেখা গল্প নিয়ে গঙ্গা যমুনা বানিয়েছেন, গঙ্গা চরিত্রকে গঙ্গাজল পান করিয়েছেন মৃত্যুর সময়। না করালেও কিন্তু ছবি হিট হতো। এই ধর্মনিরপেক্ষ মানুষটিকেও ভারতবর্ষে দুঃখ পেতে হয়েছে। দেশ ভাগের সময় আর সব মুসলমানের মতো ভারত ত্যাগ করেননি। তিনি ভারতকেই নিজের দেশ ভেবে ভালোবেসেছিলেন। পাকিস্তান থেকে দিলীপ কুমারকে এক সময় নাগরিক সম্মান ‘নিশান-ই-ইমতিয়াজ’ দেওয়া হয়। এই সম্মানটির জন্য শিবসেনার নেতারা তাঁকে কম অসম্মান করেননি, বলেছেন, ‘হয় এই সম্মান দিলীপ কুমারকে ফেরত দিতে হবে, নয় তাঁকে পাকিস্তান চলে যেতে হবে।’ এই হুমকি মানুষের অফুরন্ত শ্রদ্ধা ভালোবাসা পাওয়া দিলীপ কুমারকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল। বিজেপি বলেছিল, দিলীপ কুমার যেটা করতে ইচ্ছে করেন করবেন। দিলীপ কুমার দিল্লি গিয়ে প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ির সঙ্গে দেখা করে বলেছিলেন, ‘আপনি যদি মনে করেন, এই সম্মান আমি গ্রহণ করলে ভারতের কোনও ক্ষতি হবে, তাহলে আমি সম্মানটি ফেরত দেবো।’ বাজপেয়ি অবশ্যই চাননি দিলীপ কুমার সম্মান ফেরত দিন। তিনি একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে অনুরোধ করেন দিলীপ কুমারকে। বাজপেয়ি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে ফোন করে দিলীপ কুমারের সঙ্গে কথা বলতে বলেন। দিলীপ কুমার এ দেশ ও দেশ সব দেশেই জনপ্রিয়। তিনি নেহরুর প্রিয় অভিনেতা, নওয়াজ শরিফেরও প্রিয় অভিনেতা। দিলীপ কুমার অনুরোধ করেন নওয়াজ শরিফকে, ভারতের মাটিতে যেন কোনও সন্ত্রাস না করে পাকিস্তান, যদি করে তাহলে ভারতীয় মুসলমানদের জীবন হুমকির সম্মুখীন হয়ে ওঠে, তারা মৃত্যুভয়ে সিঁটিয়ে থাকে। তখন কার্গিল যুদ্ধ চলছিল। ভারতীয় মুসলমানদের নিরাপত্তার জন্য নওয়াজ শরিফ সন্ত্রাসের লাগাম কিছুটা তো টেনে ধরেই ছিলেন।

দিলীপ কুমার বাংলা জানতেন। তরুণ বয়সে তিনি বোম্বে টকিজের বেতনভুক অভিনেতা ছিলেন, তখন বোম্বে টকিজ ভর্তি বাঙালিতে। হেমাংশু রায়, দেবিকা রানী, শশধর মুখার্জি, অশোক কুমার, অমিয় চক্রবর্তী, অনিল বিশ্বাস, নিতিন বসু। পরে তো এলেন বিমল রায়, দিলীপ কুমারের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বাঙালি বন্ধু। বিমল রায় দেবদাস না করলে আমাদের দেখাই হতো না দিলীপ কুমারের অভিনয়ের আকাশচুম্বী পারদর্শিতা। সাহিত্যনির্ভর ছবি হচ্ছে না বলে আশির দশক থেকেই দিলীপ কুমার খুব আক্ষেপ করতেন।  তিনি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ঋত্বিক ঘটক, জরাসন্ধের সাহিত্য নিয়ে ছবি করেছেন। রাতের পর রাত জেগে রুমির কবিতা পড়া দিলীপ কুমার নিভৃতে এক কবি ছিলেন, এমন জাত শিল্পী ছিলেন যে তিনি শুধু অভিনয় করতে নয়, গান গাইতে জানতেন, গল্প লিখতে জানতেন, সেতার বাজাতে জানতেন। সেতার বাজানোটা শিখেছিলেন কোহিনুর ছবির জন্য। ক্যামেরা তাঁর হাতের ক্লোজ আপ নেবে, আর বাজনার সঙ্গে তাঁর হাতের আঙ্গুল সঠিক তার ছোঁবে না, এ তিনি মানতে পারেননি।

অমিতাভ বচ্চন একটা কথা বলেন, বলিউড দুই ভাগে বিভক্ত, একটি দিলীপ কুমারের আগের, আরেকটি দিলীপ কুমারের পরের। ঠিকই, একটি মেলোড্রামার বলিউড, আরেকটি অভিনয়-শিল্পের বলিউড। এই অভিনয় শিল্পের বলিউডের প্রায় সবখানি কৃতিত্ব দিলীপ কুমারের। তিনি ন্যাচারাল অভিনয় শিখিয়ে না দিলে মানুষ আজ যে জেনারেশনের পর জেনারেশন ন্যাচারাল অভিনয় করছে, তা পারতো না। তিনি ভারতের চলচ্চিত্র শিল্পকে সমৃদ্ধ করেছেন। তাঁর প্রাপ্য ছিল ‘ভারতরত্ন’। ভারতরত্ন কত অপাত্রের হাতে গিয়েছে। শুধু তুখোড় একজন শিল্পীর হাতে যায়নি। পদ্মবিভূষণও বড় দেরিতে পৌঁছেছে তাঁর হাতে। তখন তিনি আলজাইমারে আক্রান্ত।

ভারতের এই রত্নকে, আফসোস, ‘ভারতরত্ন’ পুরস্কার দেওয়া হয়নি। দিলীপ কুমার একজনই হয়। আমরা আর তাঁর মতো কোনও বিস্ময়কর প্রতিভা পাবো না। তিনি পদক পুরস্কার না পান, মানুষের অন্তরে বিরাজ করা সত্যিকারের ‘ভারতরত্ন’ তিনি।

লেখক : নির্বাসিত লেখিকা।

সর্বশেষ খবর