রবিবার, ৭ নভেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানজনক ডক্টরেট : রবীন্দ্রনাথ বনাম শরৎচন্দ্র

শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানজনক ডক্টরেট : রবীন্দ্রনাথ বনাম শরৎচন্দ্র

যে কজন মানুষ ছাড়া বাঙালির দিন গুজরানের উপায় নেই তার অন্যতম কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বাঙালির সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, প্রেম-বিরহ, বিদ্রোহ, বিয়োগগাথা ও উৎসব- কোনোটাই রবীন্দ্রনাথকে ছাড়া সম্ভব নয়। বাঙালির শিক্ষাগুরু ও পথপ্রদর্শক রবীন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলেন। এখানে বসে গান রচনা করেছিলেন, সভায় বক্তৃতাও করেছিলেন। ১৯৩৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফ থেকে তাঁকে সম্মানজনক ডক্টরেটও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কবিগুরু অসুস্থতার অজুহাতে সেই ডক্টরেট নিতে আসেননি। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক ও তখনকার ছাত্রদের থেকে জানা যায় তাঁর সঙ্গে কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও যদুনাথ সরকারকে ডক্টরেট দেওয়ায় তিনি সমাবর্তনে আসেননি। বিষয়টি সত্যিই বেদনার!

দুই. সৈয়দ আবুল মকসুদ তাঁর ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা’ গ্রন্থে জানাচ্ছেন, প্রতিষ্ঠার পরবর্তী ৯০ বছরে দেশ-বিদেশের বহু গুণীজনকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সম্মানজনক ডক্টরেট ডিগ্রিতে ভূষিত করেছে। ১৯৪৭-পরবর্তীকালে এবং বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর অনেকে ওই সম্মান পেয়েছেন রাজনৈতিক বিবেচনায়। কিন্তু প্রথম দুই দশকে যাঁরা এ ডিগ্রিতে ভূষিত হয়েছেন তাঁরা নিজ নিজ ক্ষেত্রে বিশিষ্ট এবং ওই সম্মানের যোগ্য। প্রথমবার ১৯২২ সালে ডক্টর অব ল দেওয়া হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য বাংলার গভর্নর আর্ল অব রোনাল্ডসকে। দ্বিতীয়বার ১৯২৫-এ পান উপাচার্য স্যার পি জে হার্টগ। ১৯২৭ সালে পান বাংলার গভর্নর আর্ল অব লিটন এবং বাংলা বিভাগের প্রথম প্রধান মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। ১৯৩২ সালে দেওয়া হয় বাংলার গভর্নর ও সাবেক আচার্য স্যার ফ্রান্সিস স্ট্যানলি জ্যাকসন এবং নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত বিজ্ঞানী চন্দ্রশেখর ভেঙ্কটরমনকে। ১৯৩৬ সালে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক ব্যক্তিকে সম্মানজনক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করা হয়। তখন স্যার এ এফ রহমান ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। তাঁরই উদ্যোগে সাতজন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে ডিগ্রি দিয়ে সম্মানিত করার আয়োজন হয়। সংখ্যায় সেবার বেশিজনকে ডক্টরেট দেওয়ার কারণ তাঁদের অনেকের বয়স খুব বেশি হয়েছিল এবং তাঁরা অসুস্থ ছিলেন। সেবারের ডিগ্রিপ্রাপ্তরা হলেন- স্যার আবদুর রহিম, স্যার জগদীশচন্দ্র বসু, স্যার প্রফুল্লচন্দ্র রায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, যদুনাথ সরকার এবং গভর্নর ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক চ্যান্সেলর স্যার জন এন্ডারসন।

ডিগ্রি প্রদানের বিশেষ সমাবর্তনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অনুপস্থিত ছিলেন। অসুস্থতার অজুহাতে তিনি ঢাকা আসেননি। অথচ ১৯৩৫ সালে কাশী বিশ্ববিদ্যালয়ের ডি.লিট তিনি নিজে গিয়ে গ্রহণ করেন। ১৯৩৮ সালে তিনি ওসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানজনক ডক্টরেটও নিজে গিয়ে গ্রহণ করেন। সেবার তিনি ঢাকা না আসায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকসহ ঢাকার নাগরিকরাও হতাশ ও অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক ও তখনকার ছাত্ররা জানিয়েছেন ভিন্ন কথা। মূল বিষয়টি ছিল তাঁর সঙ্গে শরৎচন্দ্র ও যদুনাথকে ডক্টরেট দেওয়ায় তিনি সমাবর্তনে আসেননি। তখন তিনি মনে করতেন বাংলায় তিনি কারোরই সমপর্যায়ের নন। অবশ্য এটি মনে করার যৌক্তিক কারণও ছিল। এ এফ রহমানের উদ্যোগে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্সিকিউটিভ কাউন্সিল (সিনেট) ও অ্যাকাডেমিক কাউন্সিল (সিন্ডিকেট) শরৎচন্দ্রের নাম প্রস্তাব ও অনুমোদন করে। তথাকথিত উচ্চশিক্ষিত না হওয়ায় শরৎচন্দ্রকে ডি.লিট না দেওয়ার পক্ষে মূলধারার বাঙালি হিন্দু কবি-সাহিত্যিকের একটি গোষ্ঠী সক্রিয় ছিল। হিন্দু সমাজের রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে তাঁর গল্প-উপন্যাসে ছিল প্রতিবাদ ও কটাক্ষ। ফলে প্রতিক্রিয়াশীলরা শরৎচন্দ্রের প্রতি প্রসন্ন ছিলেন না। ঢাকার সবচেয়ে প্রভাবশালী সাময়িকী ‘ঢাকা প্রকাশ’ এক প্রতিবেদনে লিখেছিল : ‘[যাঁরা ডি.লিট পাচ্ছেন]...সেই তালিকার মধ্যে শ্রীযুক্ত শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মহাশয়ের নাম দেখিয়া রুচির প্রশংসা করিতে পারিতেছি না বলিয়া দুঃখিত। তালিকায় প্রকাশিত অপরাপর সুধীবর্গের তুলনায় নীতি ও যোগ্যতার দিক দিয়া শ্রীযুক্ত শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে “ডক্টর অব লিটারেচার” উপাধি প্রদান করা যাইতে পারে কি না, সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ আছে।’

শরৎচন্দ্রকে ডি.লিট প্রদানের প্রস্তাবে বাধা এসেছিল খুব অশালীনভাবেই। ‘ঢাকা প্রকাশ’ খোঁচা দিয়ে এমনও লিখেছিল : ‘শ্রীযুক্ত চট্টোপাধ্যায় মহাশয় চরিত্রহীন, গৃহদাহ প্রভৃতি উপন্যাস রচনা করিয়া ডি.লিট উপাধি পাওয়ার যোগ্য বিবেচিত হইয়াছেন। এমতাবস্থায় “লন্ডন রহস্য” প্রণেতা মি. রেনলড্স আজ বাঁচিয়া থাকিলে তাঁহাকে কি উপাধি প্রদান করিলে শোভন হইতে পারে, সে চিন্তায় কেহ কেহ যে উষ্ণমস্তিষ্কে অসংখ্য বিনিদ্ররজনী যাপন করিতেন না এমন নহে।’ শরৎচন্দ্রের ডি.লিট প্রাপ্তি প্রশ্নে রবীন্দ্রনাথও খুশি হননি। অসুস্থতার অজুহাতে তিনি পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে উপস্থিত হননি। অর্থনীতিবিদ ভবতোষ দত্তের অনুমান- শুধু একা রবীন্দ্রনাথকে ডি.লিট দিলে তিনি যেতেন। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, নজরুল ইসলাম, জসীমউদ্দীন প্রমুখ এবং প্রগতিশীল মুসলমানদের সংগঠন ঢাকার ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ শরৎচন্দ্রকে ডি.লিট দেওয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করে। রবীন্দ্রনাথ নন বরং শরৎচন্দ্রই গুরুতর অসুস্থ ছিলেন। অসুস্থ শরীরেও ঢাকা সফর করে মুসলমান সম্প্রদায়ের আতিথেয়তায় শরৎচন্দ্র খুবই প্রীত হন।

তিন. ১৯২১ সালে শিক্ষা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বিতর্ক হয়েছিল। সাংবাদিক নলিনীকান্ত সরকার তাঁর ‘আসা যাওয়ার মাঝখানে’ বইটিতে এ ব্যাপারে স্মৃতিচারণা করেছেন। ইউরোপ ও আমেরিকা ভ্রমণ শেষে কবিগুরু ১৯২১ সালের ১৬ জুলাই কলকাতা প্রত্যাবর্তন করেন। ফিরে আসার পর তিনি ‘শিক্ষার মিলন’ নামে একটি প্রবন্ধ পাঠ করেন। এ প্রবন্ধে অসহযোগ আন্দোলনের প্রতি কটাক্ষ থাকায় শুরু হলো প্রতিক্রিয়া। কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তখন হাওড়া জেলা কংগ্রেসের সভাপতি। ‘শিক্ষার বিরোধ’ প্রবন্ধ লিখে শরৎচন্দ্র রবীন্দ্রনাথের ‘শিক্ষার মিলন’ প্রবন্ধের জবাব দিলেন। ‘শিক্ষার মিলন’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন- ‘এ কথা মানতেই হবে যে, আজকের দিনে পৃথিবীতে পশ্চিমের লোক জয়ী হয়েছে। পৃথিবীকে তারা কামধেনুর মতো দোহন করছে, তাদের পাত্র ছাপিয়ে গেল। আমরা বাইরে দাঁড়িয়ে হাঁ করে তাকিয়ে আছি, দিন দিন দেখছি আমাদের ভোগে অন্নের ভাগ কম পড়ে যাচ্ছে।... বিশ্বকে ভোগ করার অধিকার ওরা কেন পেয়েছে? নিশ্চয়ই যে কোন একটা সত্যের জোরে।’ শরৎচন্দ্র লিখলেন, ‘আমরা উপবাসী রয়েছি সত্যই কিন্তু তাই বলেই কি এই কথা মানতেই হবে যে, এই অধিকার পেয়েছে তারা নিশ্চয়ই একটা সত্যের জোরে? এবং এই সত্য তাদের কাছ থেকে আমাদের শিখতেই হবে।’

‘শিক্ষার মিলন’ প্রবন্ধের কথাগুলোকে আরও স্পষ্ট করার জন্য পরবর্তীতে রবীন্দ্রনাথ ‘সত্যের আহ্‌বান’ শীর্ষক আরেকটি প্রবন্ধ লেখেন। প্রবন্ধটিতে রবীন্দ্রনাথ মহাত্মা গান্ধীর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা প্রদর্শন করলেও গান্ধীর রাজনৈতিক কর্মকান্ডের তীব্র সমালোচনা করেন। বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথ বিদ্যালয় বর্জন, চরখা, বিলিতি কাপড় পোড়ানো ইত্যাদি কাজের তীব্র সমালোচনা করেন।

ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লব ও বিপ্লবীদের উসকে দেওয়ার অভিযোগে ১৯২৭ সালের জানুয়ারিতে শরৎচন্দ্রের বিখ্যাত উপন্যাস ‘পথের দাবি’ নিষিদ্ধ হয়। শরৎচন্দ্র এ ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথকে তাঁর পাশে চেয়েছিলেন। তিনি নিজে তাঁর বই রবীন্দ্রনাথকে পৌঁছে দেন। রবীন্দ্রনাথ শরৎচন্দ্রকে চিঠি লিখে জানান যে, বইখানি উত্তেজক। অর্থাৎ ইংরেজদের সম্পর্কে পাঠকের মনকে অপ্রসন্ন করে তোলে। রবীন্দ্রনাথ আরও লেখেন- ইংরেজরা যথেষ্ট সহিষ্ণু, যা আর কোন দেশে দেখতে পাওয়া যায় না। কলম বন্ধ না করে শক্তিকে স্বীকার করেই কলম চালানোর কথা বলেন রবীন্দ্রনাথ। যাই হোক, তাঁর উপন্যাস নিষিদ্ধ করার মতো অন্যায়ের বিরুদ্ধে নোবেলজয়ী কবিকে পাশে না পেয়ে দুঃখিত হয়েছিলেন শরৎচন্দ্র।

চার. কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তিনি কবিতা, উপন্যাস, ছোটগল্প, নাটক, গানসহ সৃজনশীল সাহিত্যের প্রতিটি শাখাতেই লিখেছেন। রবীন্দ্রনাথের লেখার সংখ্যা, মান ও দার্শনিক গভীরতায় তাঁর কাছাকাছি কাউকে পাওয়া মুশকিল। বলতে গেলে একক প্রচেষ্টায় কবিগুরু বাংলা ভাষাকে বিশ্বের দরবারে একটি সম্মানজনক আসন করে দিয়েছেন। আর শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন শুধু উপন্যাস ও গল্প। জনপ্রিয়তার বিচারে তিনি অপ্রতিদ্ব›দ্বী কথাসাহিত্যিক। তাঁর ‘দেবদাস’ নিয়ে দুই বাংলা এবং বলিউডে বিগ বাজেটের চলচ্চিত্র হয়েছে। তবে যুগসঞ্চিত রক্ষণশীলতা ও কূপমন্ডুকতার বিরুদ্ধে তাঁর সহজ সরল ভাষার লেখনী সমাজের সাধারণ মানুষের মধ্যে নিঃসন্দেহে যৌক্তিক ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে সহায়ক হয়েছিল। এখানেই কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্রের সার্থকতা। বিশ্বমানের সাহিত্য রচনা, বাঙালির আনন্দ-বেদনা, প্রেম-বিরহ ও আবেগের ভাষা নির্মাণ, তার চিন্তা ও চেতনার ন্যারেটিভ তৈরি ইত্যাদি কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে আলাদা ও এককভাবে সম্মানজনক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করলে ভালো হতো। তাতে বিশ্বকবিও খুশি হতেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বটিও যথাযথভাবে পালন করা হতো। তবে এভাবেও বিষয়টিকে দেখা যেতে পারে যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও যদুনাথ সরকারের সঙ্গে সম্মানজনক ডক্টরেট ডিগ্রি নিলে তিনি খাটো হতেন না, বরং বৃহৎ মানুষের উদার মনের পরিচয়ই বহন করত। কেননা যে-যার যোগ্যতায় ইতিহাসে স্থান করে নেন। কারও স্থান কেউ নিতে পারে না।

লেখক : অধ্যাপক আইন বিভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সর্বশেষ খবর