বৃহস্পতিবার, ২০ জানুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা

উদারতার শিক্ষা দেয় ইসলাম

এম এ মান্নান

উদারতার শিক্ষা দেয় ইসলাম

ইসলাম ধর্মীয় সহিষ্ণুতার ক্ষেত্রে যে উদাহরণ সৃষ্টি করেছে তা সর্বযুগে অনুসরণীয়। রসুল (সা.) যে মদিনা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন তার সংবিধান হিসেবে বিবেচিত হয় ঐতিহাসিক মদিনা সনদ। যেখানে বলা হয় হজরত মুহাম্মদ (সা.) বিশ্ববাসীর এবং যারাই তাঁর সঙ্গে যোগ দেবে সবাইকে এ সনদ দিচ্ছেন যে মদিনার ইহুদি, খ্রিস্টান, পৌত্তলিক ও মুসলমান সবাই নিজ ধর্ম পালন করবে, কেউই বিনা অনুমতিতে কারও সঙ্গে যুদ্ধ করবে না। নিজেদের মধ্যে কোনো বিরোধ উপস্থিত হলে আল্লাহ ও রসুলের মীমাংসার ওপর সবাইকে নির্ভর করতে হবে। বাইরের কোনো শত্রুর সঙ্গে কোনো সম্প্রদায় গুপ্ত ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হবে না। মদিনা নগরীকে পবিত্র মনে করবে এবং যাতে তা কোনোরূপ বহিঃশত্রুর দ্বারা আক্রান্ত না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখবে।  রসুল (সা.) ইসলামের দাওয়াত দেওয়ার পর মক্কার পৌত্তলিক কুরাইশদের দ্বারা নিগৃহীত হন। মুসলমানদের ওপর তাদের অব্যাহত নির্যাতন-নিপীড়নের পরিণতিতে তিনি মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করতে বাধ্য হন। হিজরির দ্বিতীয় বর্ষে বদর যুদ্ধে মুসলমানরা জয়ী হয়। ছয় বছর পর অষ্টম হিজরিতে মুসলমানরা মক্কা জয় করে। অষ্টম হিজরির ২০ রমজান রসুল (সা.) তাঁর বাহিনী নিয়ে মক্কায় প্রবেশ করেন। মক্কার মুশরিকরা পরাজয় মেনে নেয়। কুরাইশরা আশঙ্কায় ছিল রসুল (সা.) মুসলমানদের ওপর মুশরিকদের নির্যাতন-নিপীড়নের প্রতিশোধ গ্রহণ করবেন। কিন্তু তিনি পরাজিতদের সঙ্গে যে উদার আচরণ করেন তা ইতিহাসে বিরল। তিনি উপস্থিত সবার উদ্দেশে প্রশ্ন করেন, ‘হে কুরাইশ! তোমাদের কী ধারণা আমি তোমাদের সঙ্গে কীরূপ আচরণ করব?’ সবাই বলে ওঠে, ‘উত্তম, আপনি স্বয়ং করিম, দয়ালু করিমের বংশধর। তাই আপনার কাছে আমরা উত্তমই প্রত্যাশা করি।’ হুজুর (সা.) বলেন, ‘আমি তোমাদের কাছে সে কথাই বলতে চাই, যা হজরত ইউসুফ (আ.) তাঁর ভাইদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘লা তাসরিবা আলাইকুমুল ইয়াওমা’ অর্থাৎ আজ তোমাদের প্রতি কোনোই অভিযোগ নেই, যাও তোমরা মুক্ত।’

ষষ্ঠ হিজরিতে সিনাইয়ের সেন্ট ক্যাথরিন মনাস্ট্রি থেকে একটি প্রতিনিধি দল রসুল (সা.)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে যে কোনো ধরনের আক্রমণ থেকে তাঁর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করে। তিনি তাদের আবেদনে সাড়া দিয়ে তাদের অধিকার সংরক্ষণে একটি অঙ্গীকারনামা প্রদান করেন। এ অঙ্গীকারপত্রটি বর্তমানে সিনাই পর্বতের পাদদেশে অবস্থিত বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন খ্রিস্টান মঠ সেন্ট ক্যাথরিন মনাস্ট্রিতে সংরক্ষিত আছে।

মুহাম্মদ (সা.)-এর আদেশে হজরত আলী (রা.) কর্তৃক লিপিবদ্ধ এবং মহানবীর হাতের ছাপ দ্বারা সিলমোহরকৃত এ অঙ্গীকারনামা ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের যার যার ধর্ম পালনের স্বাধীনতা, কর্মের স্বাধীনতা এবং মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মূল্যবান দলিল। অঙ্গীকারনামায় বলা হয়-

‘সেন্ট ক্যাথরিনের প্রতি প্রতিশ্রুতি : এটি মুহাম্মদ ইবন আবদুল্লাহর কাছ থেকে একটি বার্তা।...

খ্রিস্টানদের প্রতি কোনো ধরনের জোরজবরদস্তি করা যাবে না। তাদের কোনো বিচারককে চাকরি থেকে অপসারণ করা যাবে না, কোনো সন্ন্যাসীকে তার মঠ থেকে সরানো যাবে না। শুধু তাদের ধর্মের কারণে ঘরবাড়ি ধ্বংস কিংবা ক্ষতিগ্রস্ত করা যাবে না অথবা সেখান থেকে কোনো জিনিস কোনো মুসলমানের ঘরে নেওয়া যাবে না। যদি কেউ কোনো কিছু নেয় সে যেন আল্লাহর চুক্তির বরখেলাপ করল এবং তার রসুলকে অমান্য করল। নিশ্চয়ই তারা আমার মিত্র এবং তারা যা ঘৃণা করে তার বিরুদ্ধে আমার নিশ্চিত চুক্তি রইল। কেউ তাদের কোথাও যেতে বা যুদ্ধে যোগদান করতে বাধ্য করবে না। মুসলমানরা তাদের জন্য লড়াই করবে। কোনো খ্রিস্টান নারীর সম্মতি ছাড়া কোনো মুসলমান পুরুষ তাকে বিয়ে করতে পারবে না। প্রার্থনার জন্য গির্জায় যাওয়া থেকে তাকে বাধা দেওয়া যাবে না। তাদের গির্জার সম্মান রক্ষা করতে হবে। এটি মেরামত করতে কিংবা চুক্তির পবিত্রতা অক্ষুণœ রাখা থেকে তাদের বাধা দেওয়া যাবে না। এ জাতির (মুসলিম) কেউ কিয়ামত পর্যন্ত এ চুক্তির অবাধ্য হবে না।’

মহানবী (সা.) কতটা মহানুভব ছিলেন তার প্রমাণ : একবার জায়েদ নামের এক ইহুদি যাজক তাঁর সঙ্গে একটি অগ্রিম কেনাবেচা করে। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের দু-তিন দিন আগেই এসে সে পণ্য পরিশোধের দাবি করে বসে। এমনকি চরম বেআদবি করে। সেখানে উপস্থিত ছিলেন ওমর (রা.)। নবীর সঙ্গে লোকটির এ অশিষ্ট আচরণ দেখে তিনি ক্রোধান্বিত হয়ে তাকে ধমক দেন। কিন্তু রসুল (সা.)-এর মুখে ছিল হাসি। তিনি ওমর (রা.)-কে বলেন, ‘ওমর! আমি এবং এ ব্যক্তি তোমার থেকে ভিন্ন আচরণের হকদার ছিলাম। দরকার তো ছিল তুমি আমাকে সত্বর তার প্রাপ্য আদায় করার পরামর্শ আর তাকে কথায় ও আচরণে নম্রতা অবলম্বনের তাগিদ দেবে।’ এরপর তিনি ওমর (রা.)-কে প্রাপ্য পরিশোধের নির্দেশ দেন এবং তাকে আরও বেশি অর্থ দিতে বলেন, যা ছিল ওমর (রা.) কর্তৃক লোকটিকে ধমক দেওয়ার বদলা। মহানবী (সা.)-এর এ মহানুভবতা লোকটির ইসলাম গ্রহণের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যাওয়ার পথে সে ওমর (রা.)-কে বলে, ‘হে ওমর! আমি হচ্ছি ইহুদি-পন্ডিত জায়েদ ইবনে সানা। আসলে লেনদেন আমার উদ্দেশ্য ছিল না, বরং মহানবীর ক্ষমা ও সহিষ্ণুতা পরীক্ষা করাই ছিল মূল উদ্দেশ্য। কারণ শেষ নবীর অন্যতম গুণ হবে এই যে, তাঁর ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা ক্রোধের ওপর প্রবল থাকবে, যতই রূঢ় আচরণ করা হবে তাঁর ক্ষমা ততই বৃদ্ধি পাবে। অতএব ওমর! আমি যা চেয়েছি তা পেয়ে গেছি।’ এরপর তিনি রসুল (সা.)-এর হাতে হাত রেখে ইমান আনেন এবং তাঁর অঢেল সম্পদের অর্ধেক উম্মতের জন্য দান করে দেন। মুসনাদে আহমদ।

                লেখক : ইসলামবিষয়ক গবেষক।

সর্বশেষ খবর