বাংলাদেশে রঙিন মাছ চাষের অগ্রপথিক হিসেবে যে কজনের নাম আসে তার মধ্যে অন্যতম ছিলেন সাতক্ষীরার সাইফুল্লাহ গাজী। রুপালি বিপ্লবকে যারা বর্ণিল রঙে রাঙিয়ে তুলেছেন তাঁদের মধ্যে রয়েছেন রংপুরের মৃদুল রহমানও। ক্রমেই তাঁদের হাত থেকে রঙিন মাছের চাষ ছড়িয়ে পড়ল সারা দেশে। এখন দেশের নানা প্রান্তে পুকুর, চৌবাচ্চা, এমনকি বাড়ির ছাদেও চলছে রঙিন মাছের চাষ। গত শতাব্দীর আশির দশকে যখন মাছ চাষের প্রচারণা চালাই, শুরুতে কৃষক মুখ ফিরিয়ে নেয়। বিস্ময় নিয়ে জানতে চায় ‘মাছের আবার চাষ কী!’ যখন উদাহরণ দিয়ে বললাম ‘ওই গ্রামের ফরিদ তো মাছ চাষ করে বেশ টাকা কামাচ্ছেন।’ তখন বলত, ‘মাছ চাষ এত সোজা নাকি! ভীষণ ঝামেলার কাজ। সময়মতো খাবার দিতে হবে, পানিতে নেমে কীসব করতে হয়! ধান-বনের কাজ লেগেই থাকে, এত সময় কই আমাদের!’ শেষে মাছ চাষে আগ্রহী করে তুলতে ‘হাকিম আলীর মৎস্য খামার’ শিরোনামে বিজ্ঞাপনের মতো একটি ভিডিও বানালাম। বিটিভিতে প্রচার হতে থাকল। এর প্রভাব তৈরি হলো ম্যাজিকের মতো। সারা দেশের তরুণরা মাছ চাষে আগ্রহী হয়ে উঠল। শুরু হলো রুপালি বিপ্লব। আর আজ চাষের মাছ উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। শুধু তাই নয়, কয়েক বছর ধরে অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ের মাছ আহরণে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ।
নব্বইয়ের দশকের সূচনায় যেসব তরুণ মাছ চাষ করে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে দেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধ করেছেন তাঁদের একজন নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারের মকবুল মোল্লা। টানা ২৫ বছরের মাছ চাষের অভিজ্ঞতা তাঁর। বলা চলে, টানা সাফল্যের মধ্যেই আছেন তিনি। মাছ চাষের নিত্যনতুন কৌশল থেকে শুরু করে বাজার পরিস্থিতি রপ্ত করেছেন। সেই মকবুল মোল্লাও বর্তমানে বেশ ব্যস্ত রয়েছেন রঙিন মাছের চাষ নিয়ে। গত সপ্তায় ঘুরে দেখে এলাম রঙিন মাছ নিয়ে তাঁর কর্মকান্ড। শীতের সকালের মিষ্টি রোদের আমেজ গায়ে মেখে মকবুলের খামারের সামনের অংশে বসে শুনছিলাম তাঁর মাছ চাষের সূচনার গল্প। তাঁর কথার সূত্র ধরে মনে পড়ে গেল সেই নব্বইয়ের দশকের আরেক মাছ চাষ উদ্যোক্তা সামসুদ্দিন ছমার কথা। সে সময় তাঁর ওপর প্রতিবেদন নির্মাণ করতে গিয়েছিলাম। পাঁচদোনা হাইস্কুলের দফতরি ছিলেন সামসুদ্দিন ছমা। টেলিভিশনে ‘হাকিম আলীর মৎস্য খামার’ দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে বর্ষাকালে স্কুলের পাশে ডোবায় মাছ চাষ করে সে সময় আয় করেছিলেন ১৫ হাজার টাকা। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। দফতরির চাকরি ছেড়ে পুকুর লিজ নিয়ে পুরোদমে শুরু করেন মাছ চাষ। তারপর গড়েন মাছের হ্যাচারি। এখন সামসুদ্দিন এলাকার সম্পদশালী একজন। সেই সামসুদ্দিন ছমার হ্যাচারি থেকেই পোনা এনেই মাছ চাষ শুরু করেন মকবুল মোল্লা। এ যেন একজন আরেকজনের সঙ্গে গভীর সুতোয় বাঁধা। ঠিক ২৫ বছর পর টেলিভিশনে সাতক্ষীরার সাইফুল্লাহ গাজীর রঙিন মাছের চাষ দেখে মকবুল এখন শুরু করেছেন রঙিন মাছের চাষ।
‘করোনার সময় রঙিন মাছের চাহিদা অনেক বেড়ে গেছে’ বলছিলেন মকবুল। ‘স্কুল-কলেজ ছিল বন্ধ, ছেলেমেয়েদের ঘরে রেখেই প্রকৃতির কাছাকাছি রাখতে বাবা-মায়েরা ঘরে অ্যাকোরিয়ামের ব্যবস্থা করেন। আর তাতেই রঙিন মাছের ব্যাপক চাহিদা তৈরি হয়।’ কথা বলতে বলতে এগিয়ে গেলাম জাল ফেলা হয়েছে এমন একটি পুকুরের দিকে। জেলেরা জাল টেনে আনছিলেন। ভেবেছিলাম হয়তো রুই-কাতলা জাতীয় মাছ তোলা হচ্ছে। কিন্তু জাল গুটিয়ে আনতেই চোখে পড়ল জালভর্তি রঙিন মাছ। কোনোটা সোনালি, কোনোটা লালচে গোলাপি, কোনোটিতে আবার দু-তিনটি রঙের মিশ্রণ। সূর্যের আলোয় চিকচিক করছে রঙিন মাছ। এ এক অপরূপ দৃশ্য!
খাওয়ার মাছের আকারের একেকটি আকর্ষণীয় রঙের মাতৃমাছ। এসব মাছের একেকটির দামও অনেক। মকবুল হাতে তুলে নিয়ে এলেন উজ্জ্বল রঙিন একটি মাছ। জানতে চাইলাম কেমন দাম এর? মাছটির ওজন ১ কেজির মতো। বললেন, ‘কম করে হলেও ২ হাজার টাকা হবে।’ শুনে অবাক হলাম। এমন একটি কাতল মাছের দাম ২০০ টাকার বেশি হবে না। কী বলেন! জানালেন, ‘মা মাছটি ২৫০ গ্রামের মতো ডিম দেবে। সে ডিম থেকে ২৫-৩০ হাজার পোনা হবে। প্রতিটি পোনার দাম ৫ টাকা হলে মিলবে দেড় লাখ টাকা।’ মকবুল একদমে বলে গেলেন কথাগুলো। বললাম, আরও ধীরে, একটু গুছিয়ে বলুন। তিনি তাঁর আড়াই বিঘার একটি পুকুরের সামনে নিয়ে গেলেন। বললেন, ‘আগের পুকুরটি ছিল মাতৃমাছের। এটি পোনার পুকুর। ৮০ শতাংশের এ পুকুরে ছাড়া হয়েছে দেড় লাখ পোনা। দুই মাস ১০ দিনে ৩ ইঞ্চি সাইজ পোনায় রূপান্তরিত হবে। প্রতিটি পোনা বিক্রি করছি ৪ টাকা করে। অর্থাৎ ৬ লাখ টাকা। এটা তিন মাসের। বছরে তিনটি ফলন অনায়াসে সম্ভব। সে হিসেবে বছরে ১৮ লাখ টাকা এ পুকুর থেকে আয় করা অসম্ভব নয়। সব মিলিয়ে খরচ ২-৩ লাখ টাকা। নিট লাভ থাকছে ১৫ লাখ টাকা।’ জানতে চাইলাম, যদি খাওয়ার মাছ চাষ করতেন তাহলে কত লাভ পেতেন?
বললেন, ‘পাবদা বা গুলশা চাষ করলেও ৮০ শতক থেকে লাভ থাকত ২ লাখ থেকে সর্বোচ্চ ৩ লাখ টাকা।’
বলতেই হবে এখন যুগসন্ধিকাল। মাছ চাষ নিয়ে নানারকম ভাঙচুর চলছে। নানা প্রযুক্তির ব্যবহার হচ্ছে। মকবুলের এখানে এসে দেখা মিলল বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষে সাফল্য অর্জনকারীদের একজন নারায়ণগঞ্জের জহিরুল হকের। জহিরুল হক এ খামারে মাছের প্রাকৃতিক প্রজননের কারিগরি বিষয়গুলো দেখেন। তিনি এখান থেকে মাতৃমাছের শুক্রাণু সংগ্রহ করছেন। সত্যিকার অর্থে মানুষের চাহিদার শেষ নেই। খাদ্য চাহিদা পূরণের পরপরই আসে চিত্তের চাহিদার বিষয়। ঠিক সে প্রশ্নেই আসে শৌখিন মাছ চাষ। এখানে মকবুল মোল্লার দু-একটি পুকুর থেকে বহু পুকুরের মাছ চাষের সমান আর্থিক সাফল্য অর্জন করছেন রঙিন মাছ থেকে।
প্রশ্ন হলো, রঙিন বা শৌখিন মাছের যে উৎপাদন সম্ভাবনা সে বিবেচনায় আমরা বাইরের বাজার ধরার দিকে এগিয়ে যেতে পারছি কি না?
মকবুল বললেন, ‘আমরা কোয়ালিটি ঠিক রাখতে পারছি না। জাপানের রঙিন মাছের কোয়ালিটি সবচেয়ে ভালো। রপ্তানি করতে হলে আমাদের কোয়ালিটিও সে পর্যায়ে যেতে হবে। এর জন্য যে টেকনিক্যাল সাপোর্ট প্রয়োজন তা নেই। নেই প্রশিক্ষণ। এ বিষয়ে সরকারের সহযোগিতা থাকলে বহুদূর পর্যন্ত যাওয়া যাবে।’ তবে আশার কথা, রঙিন মাছের বাজার বাড়ছে। দেশের চাহিদা যেমন বাড়ছে, একই হারে বাড়ছে উদ্যোক্তা। মকবুল মোল্লার রঙিন মাছের প্রকল্পের সঙ্গে বাজার বিপণনের দায়িত্ব পালন করেন রেদোয়ান উল্লাহ। তাঁর সঙ্গে কথা বলেছি। তরুণ এক ছেলে। কথা বলে বুঝলাম রঙিন মাছের বাজার নিয়ে তাঁর ধারণা যেমন স্বচ্ছ, স্বপ্নও বুনেছেন বিশাল।
‘এ মুহূর্তে দেশের অ্যাকোরিয়াম মাছের বাজার ২০০ কোটি টাকার।’ জানালেন রেদোয়ান উল্লাহ। বললেন, ‘আমরা চাষের মাছগুলো তিন ক্যাটাগরিতে ভাগ করি। এ, বি, সি। এ ক্যাটাগরির মাছগুলো ব্রুডিংয়ের জন্য রাখি। আর বি ও সির মাছগুলো বিক্রি করে দিই। দেশের মোট চাহিদার একটা অংশ মেটাচ্ছি আমরা, এখনো থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, চীন থেকে রঙিন মাছ আমদানি হচ্ছে। কোয়ালিটি বাড়াতে পারলে আমরা রপ্তানি বাজার ধরতে পারব।’ আত্মবিশ্বাসের ধ্বনি পাওয়া গেল রেদোয়ানের কণ্ঠে।
নব্বইয়ের দশকে দেশে মাছ চাষে বিপ্লব ঘটে গেছে। বহু উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছেন। সে সময়ের সাফল্যের ধারাবাহিকতায় আজ মাছ উৎপাদনে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছি। এ মাছকে আমরা শুধু প্রাণিজ আমিষের সবচেয়ে উৎকৃষ্ট ক্ষেত্র ভেবেছি, কিন্তু এ রঙিন মাছ এখন সৌন্দর্য ও রুচির বাহক হিসেবে কাজ করছে। শিশু থেকে শুরু করে সব বয়সী মানুষের কাছেই রঙিন মাছের আবেদন রয়েছে। রকমারি বাহারি মাছের বিচরণ চিত্তের সুখের জন্য রাখতে পারে বড় অবদান। মাছের এ চাঞ্চল্যের প্রভাব ঘটে মানুষের মধ্যেও। তাই তো একশ্রেণির শৌখিন মানুষের কাছে এ মাছ অতীব প্রিয়। আজকের দিনে, ল্যান্ডস্কেপ ডিজাইনের ক্ষেত্রে স্থপতিদের কাছে রঙিন মাছ এক অপরিহার্য উপাদান। এভাবেই বহু ব্যবহারে রঙিন মাছের বাজার যেমন বাড়ছে, একইভাবে অল্প দিনে এর একটি রপ্তানি বাজারও গড়ে উঠবে বলে আমার বিশ্বাস।
লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।