সোমবার, ১৬ মে, ২০২২ ০০:০০ টা

আসন্ন নির্বাচন এক অগ্নিপরীক্ষা

মেজর জিল্লুর রহমান (অব.)

আসন্ন নির্বাচন এক অগ্নিপরীক্ষা

বাংলাদেশকে আগামী নির্বাচনে মারপ্যাঁচ কেটে ওঠার অগ্নিপরীক্ষা দিতে হবে বলে মনে হচ্ছে। সহি নির্বাচন প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করতে বৈশ্বিক মেরুকরণ, আঞ্চলিক উত্তেজনা, অভ্যন্তরীণ রাজনীতির আগে পিছে পরিণতি ভেবে বাংলাদেশকে নির্বাচনী পদক্ষেপ নিতে হবে। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের মতো সংবিধানের দোহাই দিয়ে জবরদখলের দৃষ্টিকটু নির্বাচন করা সম্ভব হবে না। আমেরিকার রাষ্ট্রদূত পিটার হাস ঈদের আগে এক সেমিনারে খোলামেলা বললেন, দুই দেশের সম্পর্ক জোরদার করা হবে তবে আমি যা বুঝলাম নিষেধাজ্ঞা উত্তোলন দূরের পথ। তিনি মুশকিলের বাণী শুনিয়েছেন, তারা আসন্ন নির্বাচনে কারও পক্ষ নেবেন না। তারা এমন প্রক্রিয়া চান যার মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণ সিদ্ধান্ত নেবে দেশ কে চালাবে। তার মানে জনগণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার থেকে যেন বঞ্চিত না থাকে। জনগণের সিদ্ধান্ত আর গণভবনের সিদ্ধান্ত বিগত নির্বাচনে দুই মেরুতে দেখেছে জনগণ। আবার তা হলে মুশকিল হবে।

আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নির্বাচন মানে ভোটের দিন ভোট হতে হবে। আগের রাতে নয়। এক কথায় তিনি সরকারকে শর্তের বড় জালে আটকে ফেলেছেন মনে হয়। স্বাধীন মতামত প্রকাশ, সুশাসন, মানবাধিকার, সুশীলসমাজের জনমত তৈরি করার পরিবেশ পর্যন্ত চেয়েছেন। দুই দেশের অংশীদারি ও সহযোগিতা বাড়ানোর উপায় নিয়ে অনুষ্ঠিত সেমিনারে নির্বাচনের ওপর অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। এ যেন কোকিল কণ্ঠে ধান ভানতে গিয়ে শিবের গীত গেয়েছেন।

কয়েক দিন আগে রাজধানীর অভিজাত এক হোটেলে সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডি আয়োজিত জার্মান-বাংলাদেশ সম্পর্ক ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে এক সেমিনারে নিমন্ত্রণ পেয়ে উপস্থিত ছিলাম। সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী, রাষ্ট্রদূত, সুশীলসমাজ, একাডেমিশিয়ান, সামরিক অফিসার, আমলা, সাংবাদিক, এনজিও বিজ্ঞজনদের বক্তব্য শুনলাম, আমার নিজের বক্তব্য তুলে ধরলাম।

এক সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী তাঁর বক্তব্যে বললেন, বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের অবস্থান পরিষ্কার করে নেওয়া জটিল ও কঠিন। সূক্ষ্ম বুদ্ধিমত্তার সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় আমরা মুখোমুখি। এশিয়া নিয়ে মার্কিন-ভারত সমঝোতা কিছুদিন চলেছে। পাকিস্তানের অবস্থান দেখে আমেরিকা আর ভারতের ওপর এ অঞ্চল ছেড়ে দিচ্ছে না। এখন মার্কিনিরা দেখছে এশিয়ার অনেক দেশ রাশিয়া-চীনের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। চীন দক্ষিণ এশিয়ার দেশে দেশে মেগা প্রজেক্টের নামে ঋণ দিয়ে গলায় বড়শি গেঁথে টানছে। মার্কিনিরা তাই নড়াচড়া করে এ অঞ্চল কবজায় নেওয়ার জন্য গলগল করে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, সুশাসন, ন্যায়বিচার, আইনের শাসন, মতপ্রকাশের অবাধ পরিবেশের বয়ান শুরু করেছে। তাদের কথায় কাজে দৃঢ়তার প্রকাশ সরকারের ভাবনার কারণ। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে বালামুসিবত দূরীভূত করতে ভারত যে ঝাড়ফুঁক দিয়েছিল সামনে সে তেলেসমাতি দেখানোর মতো জল ভারতের ঘটিতে নেই। ভারতের কেরামতি আমেরিকা ছোঁ মেরে নিয়ে গেছে। তাদের মাতব্বরি রহিত করেছে।

চীন রাশিয়া মিয়ানমার নিয়ন্ত্রণ করতে বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান মার্কিনিদের কাছে লোভনীয় ঘাঁটি। এ অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করতে বাংলাদেশের অবস্থানগত গুরুত্ব বেশি।

আশঙ্কার বিষয় সবে আমরা কোমর খাড়া করে দাঁড়িয়েছি। এখন যদি সরকার হটানো, বসানো, সরকার অনুগত করার কারিগরের বিরাগভাজন হই তা আমাদের উদ্বেগের সৃষ্টি করে। আমেরিকা যা চায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন সেদিকে চলে। সৌদি আরব আরও দুই কদম এগিয়ে থাকে তাদের সুখী করতে। জাপানের সামরিক, পররাষ্ট্র নীতি পরোক্ষভাবে তারাই চালায়। জাতিসংঘ, আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক নেপথ্যে তারাই চালায়। আমাদের আর্থিক পত্তন সৌদি রেমিট্যান্স, ইউরোপ-আমেরিকায় খলিফাগিরির আয়। জাপানের জাইকা আমেরিকাকে খুশি করে চলে।

বেয়াড়া হলে মোড়লরা বেকায়দায় ফেলে যা পাকিস্তানে করেছে। আমেরিকা ইশারা করলে আমরা পাশে থাকার বন্ধু পাব না। রোহিঙ্গা নিয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতা আমাদের হয়েছে। রিজার্ভ না থাকলে দেশের টাঁকশালে টাকা ছাপালে সেটা টাকা নয়। যে ভুল শ্রীলঙ্কা করেছিল ট্যাক্স হ্রাসের ফলে রাজস্ব কমে যাওয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক টাকা ছাপিয়ে সর্বনাশ ত্বরান্বিত করেছে।

পাহাড়সম বৈদেশিক রিজার্ভ, কেউ গৃহহীন, ঠিকানাহীন নেই, মেগা প্রজেক্ট সেøাগান অকার্যকর হয়ে পড়বে।

অতীতে বাক্সভর্তি ভোট দেখে সরকারি দলের অনেকের বেহুঁশ ‘বৃহৎ উল্লম্ফন’ জনগণ দেখেছে। ক্ষমতাসীন দলের কর্মী-সমর্থক দলীয় সদস্য ও সমর্থকরা বগল বাজিয়ে বিজয়ের আনন্দে পুলকিত বোধ করেছিলেন।

বিএনপি নামক বস্তুটির অন্য সমস্ত সু বা কু গুণের কথা বাদ দিলেও বিরোধী দল হয়ে ওঠার কোনো যোগ্যতাই যে তারা রাখে না বারবার তা প্রমাণ করেছে, মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত। রিজভী সাহেবের চিত্রনাট্য, সংলাপ, গয়েশ্বর বাবুর কর্মী চাঙা করার হুঙ্কার, পল্টন আর প্রেস ক্লাবের চত্বরে কর্মসূচি সীমিত রেখে সেই সত্য তাঁরা প্রতিনিয়ত প্রমাণ করে চলেছেন। আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থাকলে তাদের এমন বন্দিদশা বিএনপি ক্ষমতায় থেকে করে দেখাতে পারবে না। বিরোধী দলের কোনো প্রতিবাদ নেই, মাঠছাড়া, ঘরবাড়ি ছাড়া বেহাল অবস্থা। এমন ফাঁকা মাঠে সরকারি দল জনগণের সমর্থন আদায়ে উজ্জীবিত। বড় বিরোধী দলের নেতৃত্ব বাংলা থেকে বিলাত পর্যন্ত বিস্তৃত। ক্ষমতাসীনদের দল ভাঙনের লোভনীয় টোপ ফেলা তো আছেই, তার মধ্যে দল পরিচালনা কঠিন। তার ওপর মামলা-জেল-জরিমানায় কর্মীরা জর্জরিত। তাদের নেত্রী মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে বন্দি-অসুস্থ, জেল মাথায় নিয়ে নিভৃতে অজগরের মতো পেঁচিয়ে ধরে কষে শ্বাসরোধের মতো অবস্থায় দলের কমান্ড। দলের দুর্দিনের লক্ষণ কর্মীদের আশাহত করে। তার পরও দল এখনো ঐক্যবদ্ধ থাকায় বিএনপি সাধুবাদ প্রাপ্তির দাবিদার। বিরোধীদের ঘর রাখি না শ্যাম রাখি পরিস্থিতিতে গদিনশিনদের প্রাণে লম্বা সময় ক্ষমতায় থাকার আশার মুকুল জাগিয়েছিল। তা তাদের চলন-বলন বাহু ঝাঁকুনি দেখলে বোঝা যায়। পিটার হাস সে আশায় সংশয় সৃষ্টি করেছেন।

আমি গত সপ্তাহে নিজের কাজে এক অফিসে ছিলাম, একটু পরে সাবেক এক প্রধান নির্বাচন কমিশনার এলেন। তিনি এখন অবসরে। সৌজন্য শুভেচ্ছা বিনিময় ভদ্রলোকের সঙ্গে। ফেসবুকে তাঁকে নিয়ে দুই লাইন লিখেছিলাম, তাতেই আমি আক্রমণে নাজেহাল হয়ে আন্দাজ করতে পারি সুস্থ সবল নির্বাচন হলে আমজনতা কোন পথে এগোবে।

অনেকেরই ক্ষমতার মেহেরবানিতে চর্মে তৈলাক্ততা, উজ্জ্বলতা। মধ্য প্রদেশ ফুলে সম্মুখে ঝোলা দেখে বোঝা যায় নগদনারায়ণ অহরহ ঘরে আগমন করছে। যার ছিল জরাজীর্ণ ঘর, যা ছিল বাদুড় ব্যাঙ সাপ পোকামাকড়সার আবাসের উপযোগী আরামদায়ক স্থান। সেই ভূতের ভঙ্গুর ঘর রাতারাতি পাকা হয়ে রঙের ঝলকানি প্রসব করছে। বড় বড় গাড়ি, দুই হাতে টাকা ওড়ান, এ টাকার উৎস কী- ভোটারের মনে হাজারো প্রশ্নের উদ্রেক করে। তাদের দৃশ্যমান কোনো আয়-রোজগার নেই, আঙুল ফুলে কলাগাছ হয় কী করে!

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের ব্যঙ্গ উক্তি ঘোচানোর জন্য মাঠে থাকার মুরোদ নেই। বর্তমান রাজনৈতিক ছবিটা যা দাঁড়িয়েছে তাতে বিরোধী দলের শক্তি বৃদ্ধি খুবই জরুরি। গণতন্ত্রের স্বার্থই জনগণের স্বার্থ। জোরদার বিরোধী দল মাঠে থাকলে হবুচন্দ্র-গবুচন্দ্ররা নেতা হওয়ার খোয়াব দেখত না। জনগণের অর্থের সর্বনাশ করতে পারত না। আগামী নির্বাচনে কষ্টিপাথরে প্রার্থীদের যাচাই করবে জনগণ।

নেত্রীর কাঁধে সওয়ার হয়ে আর পার পাওয়ার আশা ত্যাগ করে জনপ্রিয়তা পাওয়ার ব্যাকুলতা এখন জরুরি। নিজের আলো না থাকলে চন্দ্রসূর্যের কাছ থেকে ধার করা আলো দিয়ে অন্ধকারে কত পথ চলা যায়? নেত্রী ছাড়া নিজের যোগ্যতায় এলাকায় যাওয়ার সাহস অনেক নেতার নেই।

লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

[email protected]

সর্বশেষ খবর