শনিবার, ১৬ জুলাই, ২০২২ ০০:০০ টা

ভয়ংকর কিশোর গ্যাং রুখবে কে?

আবু সালেহ সেকেন্দার

ভয়ংকর কিশোর গ্যাং রুখবে কে?

শিক্ষকতা ও গবেষণার নানা ব্যবস্থায় নিয়মিত গ্রামে যাওয়ার সুযোগ না হলেও বিভিন্ন উৎসব-পার্বণে গ্রামে ফেরা হয়। মা ও মাটির সোঁদা গন্ধের ছোঁয়া নিতে তাই এবার ঈদের ছুটিতেও গিয়েছিলাম গ্রামে। সরকারি দলিল-দস্তাবেজে আমার জন্মভূমি খুলনার ফুলতলা উপজেলার গাড়াখোলাকে এখনো গ্রাম হিসেবে চিহ্নিত করা হলেও বাস্তবে একে উপশহর বলা যায়। বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিল বিলডাকাতিয়ার প্রান্তভূমিতে অবস্থিত হওয়ায় এ গ্রামের অধিকাংশ মানুষ গোল্ডেন ফিশ খ্যাত চিংড়ি চাষ করে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী। দেশে ও বিদেশে চিংড়ির জোগান দিয়ে তারা প্রায় সবাই অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল। যদিও নব্বইয়ের দশকে লবণপানিতে বিলডাকাতিয়া ডুবে গেলে এর প্রান্তভূমির সব গ্রামের মানুষের মতোই এ গ্রামের মানুষ ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে। কিন্তু এখন চিংড়ি চাষে সাফল্যের মুখ দেখায় তাদের দিন পাল্টেছে। অর্থনৈতিক সচ্ছলতার কারণে প্রতিদিনই ঘরে ঘরে ঈদের সুখ বিরাজ করে। একসময় কাঁচা মাটির রাস্তা থাকলেও বর্তমান সরকারের নানা উদ্যোগের ফলে সব রাস্তা পাকা হয়েছে। ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে গেছে। অর্থনৈতিক সচ্ছলতা থাকায় প্রায় সব মানুষই মোবাইল ফোন-ইন্টারনেট ব্যবহার করে। বাংলাদেশের অন্য অনেক গ্রামের মতোই এ গ্রামের মানুষ মুহূর্তের মধ্যে দেশে-বিদেশের নানা খবর জানতে পারে। ফলে তাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় পরিবর্তন হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে এ গ্রামের মানুষের জীবনযাত্রার পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, তাদের রুচিবোধ ও সংস্কৃতিতে পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে। এ ক্ষেত্রে ইন্টারনেটের প্রভাব সুস্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। অর্থনৈতিক সচ্ছলতা থাকায় বিগত প্রায় এক যুগ ধরে এ গ্রামের মানুষ তাদের গ্রামকে সুখশান্তি আর প্রশান্তিময় স্বর্গোদ্যানে পরিণত করেছে। কিন্তু সম্প্রতি আমার নিজ গ্রামসহ পুরো উপজেলা ভ্রমণের অভিজ্ঞতা বলছে, স্বর্গোদ্যানে নরকের ছায়া পড়েছে। মানুষের চোখে-মুখে আতঙ্কের ছায়া। কিশোর গ্যাং নামে এক নতুন উৎপাতে উপজেলাবাসী অতিষ্ঠ। সাধারণ মানুষ তাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে আতঙ্কিত। স্কুল-কলেজ পড়ুয়া নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তানরা কিশোর গ্যাংয়ে যুক্ত হচ্ছে। গ্রাম বা পাড়া ভিত্তিক নতুন নতুন কিশোর গ্যাং গড়ে উঠছে। চুরি, ছিনতাই, মাদক ব্যবসাসহ নানা অপরাধ কার্যক্রমের নেতৃত্ব দিচ্ছে এই কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। মাদক প্রধানত ইয়াবা ব্যবসা এদের আয়ের প্রধান উৎস। মাদক বিক্রির পাশাপাশি নিজেরাও নানা মাদক গ্রহণ করছে। কিশোর-তরুণদের মাদক কেনার অর্থের জোগান দিতে গিয়ে অনেক পরিবার সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ছে। অনেক কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য মাদকের অর্থ জোগাড় করতে গিয়ে বিলডাকাতিয়ার চিংড়ি ঘেরে হামেশা বিষ দিয়ে প্রকাশ্য দিবালোকে চিংড়ি লুটে নিচ্ছে ফলে চিংড়ি চাষিরা ভয়াবহ অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। খুন-খারাবিও নিয়মিত ঘটছে। কিছুদিন আগে প্রকাশ্য দিবালোকে তুচ্ছ ঘটনা কেন্দ্র করে ফুলতলা এমএম কলেজের মাঠে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের হাতে অন্য এক কিশোর নিহত হয়েছে। এ ঘটনায় আজও সাধারণ মানুষের মনে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে।

হঠাৎ কিশোর গ্যাংয়ের উত্থানের জন্য সাধারণ মানুষ পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসনের নীরবতাকে দায়ী করছে। অভিযোগ রয়েছে, দুর্নীতিতে যুক্ত পুলিশের এক নিম্নপদস্থ কর্মকর্তার ছত্রচ্ছায়ায় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা তাদের বেপরোয়া কার্যক্রম চালাচ্ছে। পুলিশের উপর্যুক্ত নিম্নপদস্থ কর্মকর্তা কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের মাধ্যমে মাদক ব্যবসা করে প্রতি মাসে লাখ লাখ টাকা আয় করছেন। চুরি-ছিনতাইয়ের ভাগও তাদের পকেটে যায় বলে অভিযোগ রয়েছে। ফলে সাধারণ মানুষ অভিযোগ নিয়ে থানায় গেলে নানা অজুহাতে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের বিরুদ্ধে পুলিশ কোনো অভিযোগ গ্রহণ করে না বলে অভিযোগ রয়েছে। কখনো-সখনো অভিযোগ গ্রহণ করলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে তার কোনো প্রতিকার কেউ পায় না। কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের পক্ষে ওই কর্মকর্তার যুক্তিতর্কের বাহাস আমার নিজ কানে শোনার পর শর্ষের মধ্যে ভূত প্রবাদের কথাই কেবল মনে পড়ছে। পুলিশের নিম্নপদস্থ কর্মকর্তার সঙ্গে চিহ্নিত মাদক কারবারির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক টক অব দ্য উপজেলা হলেও দেখার যেন কেউ নেই। স্থানীয়রা মাদক কারবারিদের বিরুদ্ধে, বিলডাকাতিয়ার চিংড়ি ঘেরে বিষ প্রয়োগ করে প্রকাশ্য দিবালোকে মাছ ডাকাতির বিরুদ্ধে বহুবার প্রতিবাদ করলেও এর কোনো প্রতিকার কেউ কখনো পায়নি। মাদক কারবারিদের শক্তির উৎস যে ওই নিম্নপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তা তা কয়েক দিন ওই এলাকায় ভ্রমণ করার পর আমার বুঝতে আর অসুবিধা হয়নি। বেড়ায় যদি খেত খায় তাহলে সাধারণ মানুষের কীই বা করার আছে?

কিশোর গ্যংয়ের কুপ্রভাবে স্কুল-কলেজ থেকে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার হার বাড়ছে। ফুলতলা এমএম কলেজে সম্প্রতি শিক্ষার্থী খুনের ঘটনায় আতঙ্কিত হয়ে অনেক অভিভাবক সন্তানদের নিরাপত্তার কথা ভেবে স্কুল-কলেজে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। তাই অভিভাবকদের মনে আস্থা ফিরিয়ে আনতে কিশোর গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি হয়ে পড়েছে। কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের অস্ত্র কেনার, মহড়া দেওয়ার অর্থের মূল উৎস মাদক ব্যবসা ও ঘেরে বিষ দিয়ে মাছ ডাকাতি বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ এখন সময়ের দাবি। মাদক ব্যবসায়ীদের সাজা হলে, মাদক ব্যবসার স্পটগুলোয় নিয়মিত পুলিশি অভিযান হলে, সন্ত্রাসীরা আইনের আওতায় এলে কিশোর গ্যাংয়ের কার্যক্রম বন্ধ হবে তা নিশ্চিত করে বলা যায়। কিশোর গ্যাংয়ের মাদক ব্যবসা ও সন্ত্রাসী কার্যক্রম সম্পর্কে স্থানীয় পুলিশ-প্রশাসন-রাজনীতিবিদরা অবহিত নন এমনটি বিশ্বাসযোগ্য নয়। তাই তারা যদি আন্তরিক হন তাহলে কিশোর গ্যাংয়ের সব কার্যক্রম এক দিনেই বন্ধ করা সম্ভব। কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা বন্ধ করে স্বর্গোদ্যানের ওপর থেকে নরকের ছায়া দূর করে সাধারণ মানুষের সুখী ও শান্তিময় জীবন নিশ্চিত করতে সরকারের সুদৃষ্টিও কামনা করি।

 

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

[email protected]

সর্বশেষ খবর