শনিবার, ৩০ জুলাই, ২০২২ ০০:০০ টা

আধুনিক কৃষিতে ড্রোনের ব্যবহার

ড. মো. জামাল উদ্দিন

আধুনিক কৃষিতে ড্রোনের ব্যবহার

আধুনিক কৃষি মানে আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার। ড্রোন সে রকমই একটি আধুনিক যন্ত্র, যা মনুষ্যবিহীন বায়বীয় আকাশযান নামে পরিচিত। এটি দেখতে অনেকটা পাখির মতোই। কম্পিউটার দ্বারা সম্পূর্ণভাবে পরিচালিত হওয়ায় ড্রোনগুলো সম্পূর্ণ নির্ভুলভাবে কাজ করতে সক্ষম। এই যানের সঙ্গে ভালো-মানের ক্যামেরা ফিট করা থাকে। যন্ত্রটি প্রথম ব্যবহার হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে শত্রুপক্ষের যোদ্ধা ও বিমানগুলোকে আকাশপথ থেকে পর্যবেক্ষণ করার জন্য। বর্তমানে ড্রোনের সঙ্গে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কাজে লাগিয়ে এর বহুমুখী ব্যবহার লক্ষণীয়। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব এর সুফল হিসেবে বিশ্বব্যাপী কৃষিতে ড্রোনের ব্যবহার বাড়ছে। এতে সুবিধাও আছে বেশ। বিশ্বব্যাপী কৃষির যান্ত্রিকীকরণ নিয়ে দ্রুততর অগ্রসর হচ্ছে। আমাদের দেশও এগিয়ে যাচ্ছে দুর্বার গতিতে। কৃষিতে ড্রোন ব্যবহার করে ফসল খেতের সার্বিক অবস্থার মনিটরিং, বালাইনাশক স্প্রে, ড্রিপ ইরিগেশনসহ অনেক কিছু করা সম্ভব। ড্রোনের সঙ্গে কাস্টমাইজ করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে ইন্টিগ্রেট করলে ড্রোন একবার কোনো এলাকার ফসলের খেতের ওপর দিয়ে উড়ে গেলে অক্ষাংশ দ্রাঘিমাংশসহ ওই এলাকার সার্বিক অবস্থা জানান দিতে সক্ষম। মাটির আর্দ্রতা নির্ণয়, বিভিন্ন উপাদানের উপস্থিতি যাচাই, জমির পরিমাণ অনুসারে শস্য রোপণের ডিজাইনও ড্রোনে করা যায়। অনেক সময় বড় আকারের জমিতে শস্য রোপণের সময় প্রচুর জায়গার অপচয় হয়, কিন্তু ড্রোনের মাধ্যমে আগে থেকেই যদি কোথায়, কীভাবে, কী পরিমাণ রোপণ করা হবে সেটা হিসাব করে নেওয়া যায়, তবে জায়গার অপচয় কমানো সম্ভব। জমি সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য সংগ্রহের পর বীজ রোপণেও ড্রোনের ব্যবহার রয়েছে। বর্তমানে বীজ রোপণের প্যাটার্ন ঠিক রেখে ড্রোনগুলো ৭০ শতাংশের বেশি বীজ নির্ভুল জায়গায় রোপণ করতে সক্ষম বলে জানা যায়।

ইমেজিং প্রযুক্তির ব্যবহার ঘটিয়ে শস্যের নির্দিষ্ট কোনো অংশে যদি পোকার আক্রমণ ঘটে সেটা বের করা যায়। ড্রোনে ব্যবহৃত ক্যামেরার তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে সহজেই কোনো নির্দিষ্ট পোকার আক্রমণ ঘটেছে কি না, কোন অংশে কী পরিমাণ শস্য আক্রমণের শিকার সেটা জানা যায়। ড্রোন ভারতের বাজারে বেশ দ্রুত প্রবেশ করেছে। সে দেশ কৃষিক্ষেত্রে কীটনাশক স্প্রে করার জন্য ড্রোন ব্যবহারের জন্য স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং পদ্ধতি (এসওপি) জারি করেছে। ড্রোনগুলো অনেক সময় এবং শ্রম সাশ্রয় করে-যা মাত্র ১৫ মিনিটে প্রায় ১ একর জমিতে কীটনাশক স্প্রে করতে সক্ষম। ড্রোন পরিষেবা প্রাথমিকভাবে ব্যয়বহুল হলেও ড্রোনের মাধ্যমে স্প্রে করার বিপরীতে ম্যানুয়াল স্প্রে করার ক্ষেত্রে আমাদের মানবস্বাস্থ্যের খরচও বিবেচনায় রাখতে হবে। কোন অংশে কম সেচ প্রদান করা হয়েছে, ড্রোনের সাহায্যে অতি সহজেই তা নজর রাখা যায়। এ ছাড়া ফসলের উৎপাদন কোথায় কতটা হলো তাও বোঝা যায়। খামারিরা মোবাইল ফোনে অ্যাপ দিয়ে নিজেরাও যাতে এসব ড্রোন পরিচালনা করতে পারেন, সে ব্যবস্থাও চালু করার চেষ্টা চলছে অনেক দেশে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে গত বছর এক সেমিনারে কৃষিবিষয়ক গবেষণায় ড্রোন প্রযুক্তির ব্যবহার বাংলাদেশে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে উল্লেখ করে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. গিয়াসউদ্দীন মিয়া বলেন, কৃষিবিষয়ক গবেষণায় ড্রোন প্রযুক্তির ব্যবহার বাংলাদেশে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। দেশের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের মধ্যে বশেমুরকৃবি সর্বপ্রথম এ প্রযুক্তি ব্যবহার করেছে বলে তিনি দাবি করেন। বাংলাদেশ সরকারের প্রতিরক্ষা ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিয়ে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, নেদারল্যান্ডসের টুয়েন্ট বিশ্ববিদ্যালয় এবং আন্তর্জাতিক ভুট্টা ও গম উন্নয়ন কেন্দ্র যৌথভাবে ‘স্টারস’ প্রকল্পের আওতায় দেশের কৃষি গবেষণায় আধুনিক, উন্নত ও কার্যকর প্রযুক্তি হিসেবে ড্রোন ব্যবহার করা হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ছোট্ট বাগানের নির্দিষ্ট সীমানার ওপর নজর রাখা গেলেও বৃহৎ এলাকা নজরদারি করতে সমস্যা দেখা দেয়। সেই সমস্যারই সমাধান করছে ড্রোন। নিজে উপস্থিত না হতে পারলেও পুরো বাগানোর ওপর নজর রাখছে দূর থেকে পরিচালিত ছোট এই উড়ন্ত যন্ত্রটি। স্মার্ট ফার্মিংয়ে ড্রোন ব্যবহারের মাধ্যমে ফসলের ফলন বাড়াচ্ছে বহু দেশ। ড্রোন ব্যবহার করে বেশ উপকৃত হচ্ছে আফ্রিকার স্থানীয় ফার্মগুলো। সম্প্রতি মিডিয়া ব্যক্তিত্ব শাইখ সিরাজ তাঁর এক প্রবন্ধে নেদারল্যান্ডসের ওয়ার্ল্ড হর্টি সেন্টারে ড্রোন ব্যবহারের কথা চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন। তিনি বলেন, স্মার্ট ফার্মিংয়ে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। কৃষি এখন পুরোপুরি বাণিজ্যিক হয়ে যাচ্ছে, ফলে এখানে বিনিয়োগ দরকার। তাঁর মতে, আমাদের দেশে সাধারণ কৃষকের পক্ষে এত বিনিয়োগ সম্ভব নয় বিধায় নেদারল্যান্ডসসহ উন্নত দেশগুলো কৃষিতে বিনিয়োগে আরও এগিয়ে এলে আমাদের কৃষিও পুরোপুরি বাণিজ্যিক ও স্মার্ট কৃষিতে রূপান্তর হতে বেশি সময় লাগবে না।

বিজ্ঞানীদের মতে, ড্রোন দ্বারা কৃষি উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। সম্প্রতি আফ্রিকার এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, আগামী ২০৫০ সালের মধ্যে পৃথিবীর জনসংখ্যা পৌঁছবে ১০ বিলিয়নে। এই বিপুলসংখ্যক মানুষের খাদ্যের জোগান দিতে পৃথিবীর কৃষি উৎপাদন অন্তত ৭০ শতাংশ বাড়াতে হবে। তবে আমাদের দেশের কৃষিতে ড্রোন ব্যবহারের বেশকিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তার মধ্যে প্রযুক্তিগত জ্ঞান, ড্রোন পরিচালনা ও তথ্য বিশ্লেষণের জন্য দক্ষ জনবল, ইন্টারনেট সুবিধাসহ খরচের ব্যাপার তো রয়েছেই। সেসব বিষয় মাথায় রেখে ড্রোনের মতো প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে পারলে তরুণ প্রজন্মের কাছে কৃষিকে আকর্ষণীয় করে তোলা সম্ভব হবে।

লেখক : প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বারি। সাবেক ন্যাশনাল কনসালট্যান্ট, এফএও, জাতিসংঘ।

সর্বশেষ খবর