শুক্রবার, ১২ আগস্ট, ২০২২ ০০:০০ টা

দেশের আর্থিক পরিস্থিতি সত্যই কি স্বাভাবিক?

রণেশ মৈত্র

দেশের আর্থিক পরিস্থিতি সত্যই কি স্বাভাবিক?

সরকার কারও নাম উল্লেখ না করে বলে যাচ্ছে, ‘দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি উদ্বেগজনক’- এমন দাবি তথ্যভিত্তিক নয় বরং উদ্দেশ্যমূলক প্রচারিত গুজব মাত্র। তাদের দাবি প্রকৃত সত্য ওই গুজবের সম্পূর্ণ বিপরীত। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আদৌ উদ্বেগজনক নয়, বরং অত্যন্ত স্বাভাবিক। আসলে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, তার পরবর্তীতে বিশ্বব্যাপী নানা সংকটে বহু দেশ জর্জরিত- এটা স্বীকৃত সত্য। আমাদের দেশও তার ব্যতিক্রম নয়। তবে ভিতরে ভিতরে আমরা যে বছর বছর অধিকতর পরিমাণে বৈদেশিক ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ছি তেমন কোনো তথ্য অন্তত আমার হাতে ছিল না। পদ্মা সেতুর উদ্বোধন নিয়ে ব্যাপক প্রচারে দেশ দিন কয়েকের জন্য সত্যই মেতে উঠেছিল এবং বাদবাকি সব ভুলে অনেকেই পরিস্থিতি পদ্মা সেতুর মতোই উজ্জ্বল বলে ভেবে নিরুদ্বেগ থাকছিলেন। কিন্তু অকস্মাৎ বিদ্যুতের রেশনিং, ১ ঘণ্টার বদলে ১০ ঘণ্টা করে প্রতিদিন বিদ্যুতের অনুপস্থিতি এই গরমে মানুষকে যে দুর্বিষহ পরিস্থিতির সম্মুখীন করেছে তাতে শুধু ঘরে বাস করাই নয়, কৃষকের কৃষিকাজে, কারখানায় উৎপাদনে এবং সর্বত্র সামগ্রিক অর্থেই জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে মানুষের দৈনন্দিন জীবন-জীবিকা নির্বাহ করার ক্ষেত্রেও সমস্যা সংকট হয়ে পড়েছে ব্যাপক। প্রতিদিন দ্রব্যমূল্য হুহু করে বেড়ে যাওয়ায় এ সংকট অসহনীয় হয়ে উঠেছে।

একই সঙ্গে ডলারের মূল্য যেভাবে বেড়ে যাচ্ছে তার ফলে অর্থনীতিতে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে বাধ্য। ক্রমাগতভাবে ডলারের সরকারি-বেসরকারি মূল্যবৃদ্ধি বাজারে দ্রব্যমূল্যের ক্ষেত্রেও প্রতিকূল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে চলেছে। এর সঙ্গে দুর্নীতি, অর্থ পাচার তো বাধাহীনভাবে অব্যাহত থাকছেই। এহেন পরিস্থিতিতে কোনো মহল থেকে প্রচারিত ‘গুজব’ মানুষকে উদ্বিগ্ন করে তুলছে, নাকি বিদ্যমান সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিই মানুষকে উদ্বিগ্ন করে তুলছে?

এ উৎকণ্ঠার মুখে ‘এক বছরে সরকারের রেকর্ড পরিমাণ বিদেশি ঋণ’ শিরোনামে একটি জাতীয় দৈনিকে ২৮ জুলাই প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত প্রতিবেদন আমাদের এক উদ্বেগজনক সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে-

এক বছরে সরকারের নেওয়া বিদেশি ঋণে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। বিদায়ী ২০২১-২২ অর্থবছরে সরকার বিভিন্ন দাতা সংস্থা ও দেশ থেকে ১০ বিলিয়ন ডলারের বেশি ঋণ নিয়েছে। টাকার অঙ্কে যা প্রায় ৯৫ হাজার কোটি। (১ ডলার ৯৫ টাকা হিসেবে) এর আগে এক অর্থবছরে কখনো বিদেশ থেকে এত পরিমাণ ঋণ নেয়নি বাংলাদেশ। দাতা সংস্থাগুলোর মধ্যে সর্বাধিক ঋণ দিয়েছে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) আড়াই বিলিয়ন ডলারের বেশি।

এদিকে টাকার দরপতনে বিদেশি ঋণের বোঝা অনেক বেড়ে গেছে। এ কারণে প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকা বেশি শোধ করতে হবে। মোট বিদেশি ঋণের পরিমাণ ৯ হাজার ৫০০ কোটি (৯৫ বিলিয়ন) ডলার। এর মধ্যে সরকারি ঋণ ৭ হাজার কোটি (৭০ বিলয়ন) ডলার। আর বেসরকারি খাতে ঋণ ২ হাজার ৫০০ কোটি (২৫ বিলিয়ন) ডলার। পাঁচ বছরের ব্যবধানে বিদেশি ঋণ বেড়ে দ্বিগুণের বেশি হয়েছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বিদেশি ঋণের পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ৫৮১ কোটি (৪৫.৮১ বিলিয়ন) ডলার। ৩০ জুন শেষ হওয়া ২০২১-২২ অর্থবছরে সেই ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ৫০০ কোটি ডলারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৪৫.৮১ বিলিয়ন ডলার বিদেশি ঋণের মধ্যে ৩৬.৭৮ বিলিয়ন ছিল দীর্ঘমেয়াদি ঋণ। আর স্বল্পমেয়াদি ঋণ ছিল ৯.৬ বিলিয়ন ডলার। ২০২০-২১ অর্থবছরে সেই ঋণ হয় ৮১.৫৭ বিলিয়ন ডলার। ২০২১-২২ অর্থবছর শেষে মোট বিদেশি ঋণ ৯৫ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে।

দেশে এখন সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাতেও বাড়ছে বিদেশি ঋণ। ২০১৭ সালের শেষে দেশের বেসরকারি খাতে বিদেশি ঋণের পরিমাণ ছিল ১২.২৮ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু ২০২১-২২ অর্থবছর শেষে তা প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৫ বিলিয়ন ডলারে। বেসরকারি খাতে বিদেশি ঋণের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি বেড়েছে করোনা মহামারির সময়। তখন প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার ঋণ নেওয়া হয়েছে, যার ৭০ ভাগই স্বল্পমেয়াদি।

‘বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত আইএমএফের কাছে কোনো অর্থ সহায়তা চায়নি। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের এহেন মন্তব্যের তিন দিন পর আইএমএফকে সরকারের পক্ষ থেকে চিঠি পাঠানো হয়েছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের কাছে ৪.৫ বিলিয়ন ডলার ঋণের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে অনুরোধ জানানো হয়েছে। মূলত অর্থমন্ত্রী ব্যালান্স অব পেমেন্ট ও বাজেট সহায়তা হিসেবে এ অর্থ চেয়েছেন। এ ছাড়া বাংলাদেশের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কমানোর বিষয়টিও কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে নথিতে।

আইএমএফের কাছে সরকারের চিঠি পাঠানোর পর কবে মিলবে ওই ঋণ বা ঋণ পেতে কী কী করতে হবে এসব প্রশ্ন সামনে আসছে। এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদেরা মনে করছেন, আবেদন দিলেও ঋণ পেতে অনেক অপেক্ষা করতে হবে বাংলাদেশকে। এ বিষয়ে আইএমএফের শীর্ষ কর্মকর্তা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান সাংবাদিকদের বলেন, ‘প্রথমত বিষয় হচ্ছে, সরকার আইএমএফের ঋণ নিতে অকেটাই লুকোচুরি করেছে। কারণ কয়েকদিন আগে যখন আইএমএফ প্রতিনিধি দল ঢাকা সফরে আসে, তাদের সঙ্গে বৈঠকের পর অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন আইএমএফ থেকে এখনই ঋণ নিতে চায় না বাংলাদেশ। অথচ ভিতরে ভিতের ঋণ চেয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। আমার কথা হচ্ছে, ঋণ নিতে এত লুকোচুরি কেন? তিনি মুখে বললেন এক কথা, কাজ করলেন আর এক রকম। আমার মনে হয় সরকার ঋণ নেওয়ার বিষয়টি ওপেন বলতে চাচ্ছে না কিন্তু এসব বিষয় তো চাপা থাকে না।’

আইএমএফের ঋণ পাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, সবে আবেদন পাঠানো হয়েছে, ঋণ পাওয়ার বিষয় অনেক পরে। আগে দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনা হবে। আলোচনার জন্য সরকার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। সে ব্যাপারে আইএমএফকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। আশা করা যায়, এখন খুব অল্প দিনের মধ্যে আইএমএফের একটি প্রতিনিধি দল বালাদেশে আসবে। হয়তো কয়েকদিন আগে যারা ঘুরে গেলেন তারাই আসবেন। তাদের সঙ্গে শর্তসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হবে। আলোচনা ফলপ্রসূ হলে ঋণের জন্য ফরমাল চিঠি দিতে হবে। এসব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে তবেই মিলবে ঋণ।

এদিকে আইএমএফের কাছে ঋণ চেয়ে আবেদন করার বিষয়টি প্রকাশ পাওয়ার পর বুধবার আবারও কথা বলেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এদিন ক্রয় কমিটির বৈঠক শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আইএমএফের কাছে ঋণ চেয়েছি তার মানে এই নয় যে দেশের অর্থনীতি বড় সংকটে আছে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা আইএমএফের কাছে ঋণ চেয়েছি কিন্তু কোনো অ্যামাউন্ট উল্লেখ করিনি।’

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আইএমএফকে দেওয়া চিঠিতে বলা হয়, আন্তর্জাতিক বাজারে ভোগ্যপণ্য, মূলধনি যন্ত্রপাতি এবং শিল্পের কাঁচামালেরও দাম বেড়েছে অনেক। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে পরিবহনসহ অন্যান্য খরচও বেড়েছে ব্যাপক হারে। এ বছরের মে-তে বাণ্যিজ্য ঘাটতি দাঁড়ায় ২ হাজার ৮২৩ কোটি ডলারে।

এভাবে যে যে খাতে অর্থনীতি কমবেশি সংকটে পড়েছে, বিশেষ করে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, করোনাজনিত সংকট সবই উল্লেখ করা হয়।

অর্থাৎ বিদেশিরা কিন্তু নানাভাবেই দেশের সমস্যা সংকট সম্পর্কে অবহিত। তার ওপর তাদের কাছে ও দাতা সংস্থাগুলোর কাছে যখন ঋণের তাগিদ দেওয়া হয় তখন তো চিঠিপত্র এবং মৌখিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই তারা আমাদের অর্থনীতি সম্পর্কে আনুষ্ঠানিকভাবে অবহিত হতে পারছে।

এ ব্যাপারে কোনো সমালোচনা হলে তৎক্ষণাৎ সরকারি নেতা-মন্ত্রী-এমপি বা তার বা তাদের ওপর হামলে পড়ার কোনোই যুক্তিসংগত কারণ দেখি না। বস্তুত গণতন্ত্রে বিশ্বাসী কোনো মহলই তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাবে এমন কিছু আদৌ কাম্য নয়। বরং সরকারের উচিত সব রাজনৈতিক দল, অর্থনীতিসংক্রান্ত সংগঠন ও সুশীলসমাজ, বিশেষ করে সাংবাদিক সমাজকে ডেকে আনুষ্ঠানিক, অনানুষ্ঠানিকভাবে মতবিনিময় করে দেশের অর্থনীতির বিরাজমান সংকট মোকাবিলার পথ খুঁজে বের করা এবং সে অনুযায়ী সরকারি কার্যক্রম গ্রহণ।

এ প্রসঙ্গে আরও বলা যায়, দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিষয়ে সব তথ্য জানতে বাংলাদেশের সব নাগরিক সমভাবে অধিকারী। তাই কোনো গুজব বা প্রচারণাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য না করে নিয়মিত সময়ের ব্যবধানে প্রকৃত পরিস্থিতির বিবরণ অত্যন্ত স্বচ্ছতার সঙ্গে গণমাধ্যমে তুলে ধরা উচিত। এই বা এ-জাতীয় পদক্ষেপ অধিকতর বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করে মানুষের মনে আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করবে।

আপাতত দেশের সর্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে সরকার একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করলে হয়তো জনগণ পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্যক অবহিত হতে পারবে এবং এভাবেই যে-কোনো সন্দেহভাজন মহলের অপপ্রচার বা গুজব ছড়ানোর মাধ্যমে কোনো হীন উদ্দেশ্য সফল করার উদ্যোগ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে পারে।

                লেখক : সাংবাদিকতায় একুশে পদকপ্রাপ্ত

সর্বশেষ খবর