বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সংকটের ধকল বাংলাদেশকেও পোহাতে হচ্ছে। জীবন ধারণ এক প্রকার দুঃসাধ্যই হয়ে পড়েছে আমাদের জন্য। বছরখানেক আগে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির খবর প্রকাশ করতে গিয়ে একটি জাতীয় দৈনিক প্রধান শিরোনাম করে এভাবে- ‘কোথায় যাবে মানুষ!’ আসলেই তো। তেল থেকে নুন পর্যন্ত সবকিছুর অতি উচ্চমূল্যে মানুষের যাওয়ার সব দুয়ার বন্ধ হয়ে গেছে। একটা সময় ছিল গ্রামে অল্প পয়সায় চলা যেত। কিন্তু করোনাকালে গ্রামেও ব্যাপক দাম বেড়েছে জিনিসপত্রের। ফলে কি শহর কি গ্রাম, কোথাও স্বস্তি ছিল না। কিন্তু এবার যা হলো, যেভাবে নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে, ‘মানুষের মরা ছাড়া কোনো গতি নেই’। মরা ছাড়া গতি নেই কথাটি আমার নয়। সম্প্রতি বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে জনসাধারণ যেসব প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে, তাদেরই বাক্য এটি।
সপ্তাহখানেক আগের ঘটনা। সকাল ১০টা। কাজের উদ্দেশে বেরিয়েছি। একটি সাত-আট বছরের ছেলে আমাকে দেখে মায়া মায়া কণ্ঠে ডাক দিল। এই যে আঙ্কেল! একটা কথা বলব? বোঝাই যাচ্ছে আনাড়ি ছেলে। সীমাহীন সংকোচ মনে। আমি হেসে বললাম, কী বলবা বাবা! সে বলল, ১০টা টাকা দেবেন? একটা রুটি খাব! ভিক্ষা ব্যাপারটা আমার কখনই পছন্দ নয়। ছোট্ট ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম, টাকা দেব না। তোমাকে নাশতা খাওয়াব।
নাশতা শব্দটা শুনে ছেলেটার মনে কেমন যেন বাজল! বলল, আজ তো অনেক দিন হলো সকালে নাশতা খাওয়া হয় না। এবার আমার বুকটা ধক করে উঠল। মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম, তোমার বাসা কোথায়? বলল, পাশেই আমরা থাকি। মেলা দিন হলো বাসায় আম্মু নাশতা বানায় না। সকালে আমরা পানি খেয়ে থাকি। প্রতিদিনের মতো আজও চার গ্লাস পানি খেয়ে বের হলাম। মানুষের কাছে চাইতে লজ্জা পাই। কিন্তু পেটের ক্ষুধাও সহ্য হয় না। সরল গলায় ছেলেটির কথা শুনে হৃদয়টা বেদনায় হাহাকার করে উঠল। চোখে পানি চলে এসেছে। হায়! নীরব দুর্ভিক্ষ বলে একটা কথা এত দিন শুধু শুনতাম। এখন সাক্ষী হয়ে গেলাম।ছেলেটাকে নাশতা করিয়ে বিদায় দিলাম। বিষণ্ণ মন নিয়েই অফিসের উদ্দেশে গাড়িতে উঠি। যাত্রাবাড়ী-ওয়ারী-মতিঝিল পার হতে হতে কত শত চিন্তা বিষণ্ণ মনকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে টেরও পাইনি। একবার ভাবী, আমি কি মুসলমান? রসুল (সা.) বলেছেন, যার প্রতিবেশী না খেয়ে থাকে কিন্তু নিজে পেটপুরে খায় এমন মানুষ কখনো মোমিন নয়। আবার মনে হলো, আমারই বা কী দোষ! সমাজটাই তো এ রকম হয়ে গেছে। প্রতিবেশী-আত্মীয়স্বজন নিয়ে ভাবার রীতি উঠে গেছে। তাহলে যে সমাজে বসবাস করছি তা কি মুসলমানের সমাজ নয়? মনে পড়ে গেল সুরা মাউনের প্রথম আয়াতগুলো। সুরাটিতে একটি ইসলামী সমাজ এবং কুফরি সমাজের চিত্র নিয়ে খোলাসা কথা বলা হয়েছে।
আল্লাহ বলেন, আরা আইতাল্লাজি ইউকাজ্জিবু বিদ্দিন। হে নবী! আপনি কি ওই সমাজ চেনেন? যে সমাজ ধর্মকেই অস্বীকার করে বসেছে? ফাজালিকাল্লাজি ইয়াদুউল ইয়াতিম। যে সমাজে গরিব মানুষের কোনো আশ্রয় নেই, অধিকার নেই, সেটিই কুফরি সমাজ। ওয়ালা ইয়াহুদ্দু আলা তআমিল মিসকিন। আফসোস! ওই সমাজের বাসিন্দারা ক্ষুধার্তের ক্ষুধা দূর করার বিষয়ে কোনো কর্মসূচি তো নেয়ই না, উল্টো কেউ এ ধরনের কোনো কাজ শুরু করতে চাইলে বাঁকা চোখে দেখে। টিটকারী করে। বলে, এঃ! কত দেখলাম! ইত্যাদি ইত্যাদি। ফাওয়াইলুল্লিল মুসাল্লিন। জাহান্নাম ওই সমাজের ধার্মিকদের জন্য। আল্লাজিনা হুম আন সালাতিহিম সাহুন। তারা মাতালের মতো না বুঝে ধর্ম পালন করে। আল্লাজিনাহুম ইউরাউন। তাদের ধর্মকর্ম সবই ভাইরাল হওয়ার অভিনয় মাত্র। ওয়ামনাউনাল মাউন। তাদের আসলে মনই ছোট। আয়াতগুলোর হুবহু অনুবাদ নয়। ব্যথিত মনে ভাব কথাগুলো জেগে উঠল। নিজের অজান্তেই কেঁপে উঠলাম। আমরা আসলে মুসলমান নই। মুসলমান সাজার অভিনয় করছি কেবল। আর যা-ই হোক মুসলমানের সমাজে মানুষ তো বটেই এমনকি পশুপাখিও ক্ষুধার্ত থাকবে তা কখনই মেনে নেওয়া যায় না। রসুল (সা.)-এর সংগ্রামই ছিল ক্ষুধামুক্ত-দারিদ্র্যমুক্ত সমাজ গঠনের। সেটিই যেহেতু হারিয়ে গেছে, তাহলে আমরা কী নিয়ে পড়ে আছি। প্রশ্ন রইল পাঠকের বিবেকের কাছে।
লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ মুফাসসির সোসাইটি। পীর সাহেব, আউলিয়ানগর।