শনিবার, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

পরিমিতির কৃষি অনুশীলনে নেদারল্যান্ডসের রয়্যাল আইকোলকাম্প

শাইখ সিরাজ

পরিমিতির কৃষি অনুশীলনে নেদারল্যান্ডসের রয়্যাল আইকোলকাম্প

কৃষি গবেষণা ও প্রযুক্তি উদ্ভাবনে নেদারল্যান্ডস বিশ্বপরিচিত। আগামীর কৃষি ও পরিবর্তিত জলবায়ুর প্রস্তুতি নিয়ে নানারকম কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে দেশটি। সরকারি-বেসরকারি সহায়তা নিয়ে কৃষিপ্রযুক্তির সম্প্রসারণে নেদারল্যান্ডসের যে কটি প্রতিষ্ঠান কাজ করছে তার মধ্যে রয়্যাল আইকোলকাম্প অন্যতম। গত এপ্রিলে রয়্যাল আইকোলকাম্পের বহুমুখী কার্যক্রম দেখে আসার সুযোগ হয়েছিল। ১১১ বছরের পুরনো রয়্যাল আইকোলকাম্প একটি পারিবারিক প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে সাড়ে ৬ হেক্টর জমিতে তাদের নানামুখী কার্যক্রম। কৃষিভিত্তিক বিভিন্ন প্রযুক্তি ও উপকরণের ম্যানুফ্যাকচারিংই তাদের মূল ব্যবসা। এর পাশাপাশি কৃষির মূল উপকরণ মাটি, পানি ও জলবায়ু পরিবর্তনের নানান অনুষঙ্গ নিয়ে তারা বিস্তর গবেষণা করছে। এপ্রিলের এক সোনালি বিকালে উপস্থিত হই নেদারল্যান্ডসের গিসব্যাকে অবস্থিত রয়্যাল আইকোলকাম্প অ্যাকাডেমিতে। আমাদের অভ্যর্থনা জানান রয়্যাল আইকোলকাম্পের বর্তমান কর্ণধার ফোন্স আইকোলকাম্প ও এ প্রতিষ্ঠানের কয়েকজন গবেষক। ফোন্স আইকোলকাম্প আমাদের নিয়ে যান দ্বিতল একটি ভবনে। কৃষির মূল প্রাণ মাটি ও পানি নিয়েই যত কাজকারবার এ প্রতিষ্ঠানটির। মাটির স্বাস্থ্য ও পানির গুণাগুণ পরীক্ষা-নিরীক্ষার আধুনিক সব যন্ত্রপাতি থরে থরে সাজানো। ফোন্স আমাদের বিভিন্ন যন্ত্রপাতি দেখালেন। ব্যাখ্যা করলেন একেকটির প্রয়োজনীয়তা ও কৃষিকাজে এর ব্যবহার। ফোন্স আমাদের দেখালেন নানারকম সেন্সর। যেগুলো মাটির গুণাগুণ, পানির পরিমাণ এবং মাটিতে বিদ্যমান পানির গুণাগুণ সম্পর্কে সার্বক্ষণিক ধারণা দেয়। ফোন্স একটি সেন্সর দেখিয়ে বললেন, ‘এ সেন্সরটা বসানো থাকে মাটির ১৫০-২০০ মিটার গভীরে। সেখান থেকে মাটি ও পানি সম্পর্কিত তথ্য আপনাকে পাঠিয়ে দেবে আপনার কম্পিউটার বা মোবাইল ফোনে। অফিসে বসে থেকেই আপনি সেচের ব্যবস্থা করতে পারবেন। মাঠে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। মাটির ক্ষয়ের পরিমাণ মাপার সেন্সর দেখালেন ফোন্স। ওই সেন্সরে লাগানো আছে মাইক্রোফোন। বাতাসে মাটি কী পরিমাণ আলগা হচ্ছে, কত গতিতে আঘাত হানছে তা পরিমাপের মাধ্যমে বলে দেওয়া যাচ্ছে জমিতে মাটির কী অবস্থা। অথচ আমাদের কৃষক মাটি পরীক্ষা করার মাধ্যমে ফসলের জন্য জমি তৈরি করছে না। সে সুযোগও আমরা অবশ্য করে দিতে পারছি না। নিয়মিত মাটি পরীক্ষার মাধ্যমে ফসল চাষ করলে অনেক অপচয় যেমন রোধ করা যেত ফলনও বাড়ত।

যা হোক, এরপর ফোন্স আমাদের ইনোফিল্ডসে নিয়ে গেলেন। ইনোফিল্ডস হচ্ছে নতুন ইনোভেশনের জায়গা। ভূমির কোন অংশে কৃষি, কোন অংশে শিল্পকারখানা বা বসতি হবে তা গবেষণাপূর্বক নির্ধারণ করার কাজটিও করছে এ প্রতিষ্ঠান। যেতে যেতে কথা হচ্ছিল ফোন্সের সঙ্গে। বলছিলেন, ১৯১১ সালে ফোন্স আইকোলকাম্পের দাদা এ প্রতিষ্ঠানটি শুরু করেন। তিনি ছিলেন মূলত এলাকার কামার। সে সময় কৃষিযন্ত্রপাতি নির্মাণের মাধ্যমে এ প্রতিষ্ঠানের যাত্রা। বংশপরম্পরায় আধুনিক যান্ত্রিক কৃষি ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের ব্যবসা এখন ফোন্সের হাতে। তিনি অঙ্ক কষছেন আগামীর কৃষি ধারণা নিয়ে। আধুনিক কৃষি মানেই প্রযুক্তির কৃষি। এখানে কায়িক শ্রমের চেয়ে কারিগরি দক্ষতা বেশি প্রয়োজন। ফলে তরুণরাও এগিয়ে আসছে দারুণ আগ্রহে। আমরা গিয়ে পৌঁছেছিলাম একটা গবেষণা প্লটে। উচ্ছল এক তরুণ, প্রতিষ্ঠানটির বিজনেস লাইন ম্যানেজার বব ক্লাইন লাংকহর্সট দেখাশোনা করছেন এ স্মার্ট ফার্মিংয়ের বিষয়াশয়। তিনি আমাদের দেখালেন ফার্মবোট নামক একটি রোবট। বীজ বোনা থেকে শুরু করে জমিতে পানি দেওয়া, আগাছা পরিষ্কার সবই সম্পন্ন করতে পারে এ রোবটটি। বব বলছিলেন, ‘রোবট যেহেতু আগাছা পরিষ্কার করছে আপনার কেমিকাল ব্যবহারের কোনো প্রয়োজন নেই। যেহেতু মাটি গুণাগুণসম্পন্ন আমরা কেমিক্যাল সার ব্যবহার করি না। জৈব সার ব্যবহার করি। আর কোনোরকমের কীটনাশক ব্যবহার করতে হয় না। প্রকৃতি যেভাবে মাটিকে সমৃদ্ধ করে, অনুর্বর হয়ে যাওয়ার পর পুনরায় উর্বর করে আমরাও সেটা প্রযুক্তির সাহায্যে করার চেষ্টা করছি কোনোরূপ কেমিক্যাল ব্যবহার ছাড়াই। আমরা মাইক্রোস্কোপ দিয়ে কম্পোস্টের জৈবগুণ বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা করি। তারপর মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিই। আর পুরো কাজটা করি মেশিনের সাহায্যে।

বব আমাদের নিয়ে গেলেন যেখানে তাঁরা ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদন করছেন সে জায়গায়। একটা প্লটে কেঁচো দেখিয়ে বব বলছিলেন, ‘এই যে দেখুন কী চমৎকার কেঁচো। এগুলোর যথেষ্ট পরিমাণ খাবার আছে এ মাটিতে। ওরা খাবার খায় আর ওদের বিষ্ঠায় মাটি তার জৈবগুণ ফিরে পায়। দেখুন মাটির আর্দ্রতাও কেমন ঠিকঠাক আছে। এতে প্রচুর কার্বন আছে, ক্লাইমেটের জন্য খুবই প্রয়োজনীয়। কারণ আপনি জানেন মাটিতে কার্বনের পরিমাণ বেশি থাকলে তার পানিধারণ ক্ষমতা বাড়ে।’

এরপর আমরা গেলাম আরেকটি দফতরে। যেখানটায় মাটির জীববিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা হয়। এ অংশটির দায়িত্বে আছেন স্তেরা আইটারাইক। সয়েল বায়োলজি অ্যানালাইসিস করে দেখাল স্তেরা। মাইক্রোস্কোপে দেখা গেল নেমাটোড মুভ করছে। ব্যাকটেরিয়া আছে। মিনারেল আছে। কেমিক্যাল ইনপুট ছাড়াও মাটির নিজস্ব অনেক উপাদান আছে যা ফসল ফলাতে সক্ষম। বিভিন্ন রকমের জৈবকণা ও অণুজীব দেখলাম আমরা স্তেরার সাহায্যে। অ্যামিবাও দেখা গেল। আসলে মাটির জীববৈচিত্র্যের একটি ভারসাম্য আছে যেটা মাটির জন্য বেশ উপকারী। এ কাজটি খুবই দক্ষতার সঙ্গে করতে হয়, তেমনটাই বলল স্তেরা।

সেখান থেকে বের হয়ে ফোন্স আমাদের নিয়ে এলেন মাঠে। দেখালেন রেইনফল ডিটেক্টর। সোলার এনার্জিতে চলে। বৃষ্টির পরিমাণ ও বাতাসের গতি সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায় সেখান থেকে। আইকোলকাম্পের বিজনেস ইনোভেশন স্ট্র্যাটেজি বিভাগের ড. ইয়োখেন ফ্রুবিখ বলছিলেন, মাঠে যে ইভাপোরিমিটার রয়েছে তার তথ্য অনুযায়ী ৬৫% বৃষ্টির পানিই বাষ্পীকরণ হয়ে যায়। মাটিতে কী পরিমাণ পানি আছে, কী পরিমাণ পানি প্রয়োজন, বৃষ্টির পানি কতটা মাটি ধরে রাখতে পারছে এসব তথ্য কৃষিকাজের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মাটিতে পানির মাত্রা সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকা খুব জরুরি। ফোন্স বললেন, ‘ছয় বছর আগে ইভাপোরিমিটার আবিষ্কার না হলে জানতেই পারতাম না যে নেদারল্যান্ডসের ৬৫% পানি বাষ্পীকরণ হয়।’ এসব খুঁটিনাটি তথ্য যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা বলার বাইরে। বিগডেটা নিয়ে কাজ করতে গিয়ে তাদের কাছে ধরা পড়ছে প্রকৃতির সব বিস্ময় যা পরিবেশের জন্য মঙ্গলজনক। পৃথিবীর সব হাইড্রোলজিক্যাল এক্সপেরিমেন্টগুলো করে দেখতে চায় তারা। সেন্সরের সাহায্যে সব রিয়েল-টাইম ডেটা চলে যায় তাদের কন্ট্রোল সেন্টারে। ফলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে মাটি ও পানির ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে। মাটিতে কী পরিমাণ পানি আছে তা তারা সব সময়ই পরিমাপ করতে থাকে সেন্সরের সাহায্যে। ফলে সেচ দেওয়ার প্রয়োজন আছে কি না, থাকলেও কতটুকু সেচ দিতে হবে তা নির্ধারণ করে দিচ্ছে যন্ত্র। অফিসে বসে থেকেই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এজন্য তরুণদের কাছে এ ধরনের কৃষি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। তরুণরা কৃষিতে অংশ নিচ্ছে। কৃষি তাদের কাছে বেশ আকর্ষণীয় একটা পেশা। আর এ সবই সম্ভব হয়েছে প্রযুক্তির কল্যাণে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যে সমস্যাগুলো বিশ্ব মোকাবিলা করছে তার কিছুটা সমাধান পাওয়া যাচ্ছে প্রযুক্তির ব্যবহারে। তাদের গবেষণা আগামীতে আরও বেশি কার্যকর ভূমিকা রাখবে।

আগামীর কৃষি প্রযুক্তির কৃষি- এ সত্য উপলব্ধি করে নেদারল্যান্ডসের মতো দেশগুলো এগিয়ে এসেছে বহুপথ। জলবায়ু পরিবর্তনের কথা মাথায় রেখে তারা রচনা করছে নতুন কৃষির ধারণা। আধুনিক কৃষি-কৌশলের সঙ্গে প্রতিনিয়তই পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে তাদের কৃষক ও কৃষি উদ্যোক্তাদের। চলছে চিরকালীন ঐতিহ্যময় কৃষির সঙ্গে নতুন নগরকৃষির মেলবন্ধন রচনার প্রচেষ্টা। কৃষি সাফল্যই ভবিষ্যৎ অর্থনীতির মূল- এ কথাটিই স্পষ্ট হয়ে ওঠে তাদের সব কৃষিমুখী কর্মকান্ডে। যার উৎকৃষ্ট উদাহরণ রয়্যাল আইকোলকাম্প। আমাদের কৃষি অনুশীলন, গবেষণা ও কৃষি-বাণিজ্যের সম্প্রসারণে এ প্রতিষ্ঠানের কর্ম-দর্শন জোগাতে পারে অসীম অনুপ্রেরণা।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব

[email protected]

সর্বশেষ খবর